গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই খেরসন দখল করে রাশিয়া৷ নভেম্বরের শুরুর দিকে শহরটি পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেন৷রুশ সৈন্যরা চলে যেতেই খেরসনবাসীদের কাছ থেকে আসতে থাকে যৌন সন্ত্রাসসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ৷সম্প্রতি সেসব অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছেন ইউক্রেনের আইনজীবীরা৷ হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা গ্লোবাল রাইটস কমপ্লায়েন্সের একটি দল এ কাজে সহায়তা করছে তাদের৷

ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় বলছে, খেরসনের বাসিন্দারা রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে ৫০ হাজারেরও বেশি অভিযোগ করেছেন৷অভিযোগগুলোর মধ্যে গণহত্যা এবং নানা ধরনের আগ্রাসী আচরণের অভিযোগ অসংখ্য৷ সেরকম অভিযোগগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধা আদালত আইসিসি-তেও হতে পারে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয়৷ ওপরের ছবিতে খেরসনের একটি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ঘুরে দেখছেন এক তদন্তকারী৷

ইউক্রেনের যৌন সন্ত্রাস সংক্রান্ত অপরাধ বিচারের ইউনিটের সহকারি প্রধান আনা সোসোনস্কার দাবি- রুশ সৈন্যরা খেরসন ছেড়ে না যাওয়া ইউক্রেনীয়দের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে৷ রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়ার সৈন্যরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই যৌন সন্ত্রাস, নির্যাতন, এমনকি হত্যাকাণ্ডও চালিয়েছে৷’’

সম্প্রতি এক রুশ সৈন্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন এক ইউক্রেনীয় নারী৷ গত জুনে সেই মামলার প্রথম প্রাথমিক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়৷ অভিযুক্ত রুশ সৈন্যের অনুপস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হয় শুনানি৷

ক্রাইমিয়া এবং সেভাস্তোপোল পুলিশের তদন্ত বিভাগের সহকারি প্রধান সেরহি ডোরোশিন জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ৭০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে৷তাদের অনেকেই বলেছেন, রুশ সৈন্যরা খেরসনে ১০টির মতো ডিটেনশন সেন্টার গড়ে তুলেছিল৷ সেখানে আটকে রেখেই তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়৷

রাশিয়া সব অভিযোগই অস্বীকার করেছে৷ সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা (ওপরের ছবি) সব অভিযোগকে ‘বানোয়াট’ বলে উড়িয়েই দিয়েছেন৷ জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে রাশিয়ার সৈন্যদের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগের কথা উঠে এসেছে৷ সে বিষয়ে রয়টার্সকে মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘‘এসব অভিযোগ পুরোপুরি গুজব এবং গুঞ্জননির্ভর৷’’

৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার এঙ্গেলস ও ডিয়াগিলেভো বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেন ড্রোন হামলা চালিয়েছে৷ দূরবর্তী এলাকায় হামলা চালাতে এই দুটি বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে রাশিয়া৷

দুটি বিমানঘাঁটিরই অবস্থান ক্রেমলিন থেকে দূরে৷ তাই সেখানে ইউক্রেনের হামলা চালানোর ক্ষমতা বিশ্লেষকদের বিস্মিত করেছে৷ জার্মানির বুন্ডেসভেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাঙ্ক সাউয়ার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়া না দেখানোর বিষয়টি বিস্ময়কর - এটা হতে পারে যে, রাশিয়ার এত ভেতরে এমন হামলা হতে পারে, সেটা রাশিয়া ভাবেনি৷’’

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, ইউক্রেনের ড্রোনগুলো ভূপতিত করা হয়েছে৷ এবং তাদের টুকরোর আঘাতে দুটি রুশ যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ তবে অনলাইনে প্রকাশিত ব্যক্তিগত সার্ভিলেন্স ক্যামেরায় তোলা ভিডিওতে দেখা গেছে, আকাশে কোনো বিস্ফোরণ হয়নি, বরং ভূমিতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে৷

রাশিয়া বলছে, হামলার কাজে ১৯৭০-এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি পর্যবেক্ষণকারী ড্রোন টিইউ-১৪১ (ছবিতে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে) ব্যবহার করা হয়েছে৷ তবে কিয়েভের নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রের বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, পাবলিক-প্রাইভেট যৌথ অংশীদারিত্বের আওতায় ইউক্রেনের তৈরি নতুন ড্রোন দিয়ে ঐ হামলা করা হয়েছে৷

ড্রোন তৈরির কর্মসূচি বিষয়ে ইউক্রেন নীরবতা অনুসরণ করছে৷ তবে ৮ ডিসেম্বর ফেসবুক পোস্টে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ জানান, ‘‘অতীতে আমাদের সামরিক বাহিনীর জন্য বছরে এক-দুটি ড্রোন টাইপের অনুমোদন দেয়া হত৷ তবে গত ৩০ দিনে সাতটি নতুন ড্রোন টাইপের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷’’

রাশিয়ার এত ভেতরে ইউক্রেনের হামলা চালানোর সক্ষমতার বিষয়টি শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ ইউক্রেনের সামরিক বিশেষজ্ঞ ওলেগ কাটকভ বলেন, ‘‘রাশিয়ার এখন তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনরায় মোতায়েন করতে হবে, কিংবা তাদের যুদ্ধবিমানগুলো আরও দূরে নিয়ে যেতে হবে৷ সেক্ষেত্রে আরও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হবে, যা খরচ বাড়াবে৷’’

ইউক্রেন অনেকদিন ধরে পশ্চিমের কাছে দূরে হামলা করার অস্ত্র চাইছে৷ যুক্তরাষ্ট্র দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে সক্ষম ‘হাইমার্স’ ব্যবস্থা দিলেও রাশিয়ার ভয়ে সেটির সীমা কমিয়ে দিয়েছে৷ ফলে শুধু রাশিয়া অধিৃকত এলাকায় সেটি ব্যবহার করা যাবে৷ ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেসন্সের উলরিকে ফ্রাঙ্কে মনে করছেন, রাশিয়ায় হামলা চালিয়ে ইউক্রেন পশ্চিমা বিশ্বকে এই সংকেত দিয়েছে যে, তাদের ছাড়াও তারা হামলা করতে সক্ষম৷