‘ম্যারিটাল রেপ’ কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিত? ভারতে স্বামীর হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অনেক স্ত্রী৷ কিন্তু তাতে স্বামীদের বিচারের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না৷ ভারতীয় আইনে এই ধর্ষণ অপরাধ কিনা তা নিয়েই রয়েছে বিতর্ক৷
বিজ্ঞাপন
‘‘আমি ঘুমিয়ে থাকলেও আমাকে জোর করে তুলতো৷ এরপর জোর করে যৌনসঙ্গম করতো৷ আমার শরীর খারাপ, নাকি ঘুমাচ্ছি, কোনোকিছুই আমলে নিতো না,'' বলেন ২০ বছর বয়সি প্রিয়া৷ ভারতীয় এই নারী স্বামীর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন একাধিকবার৷ এখন তিনি বিচার চান৷
প্রিয়া একাই এমন অবস্থার শিকার নন৷ ৬০ বছরের সুরেশও ২০ বছর ধরে ম্যারিটাল রেপের শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতন থেকে বাঁচতে স্বামীর সঙ্গ ত্যাগ করেছেন তিনি৷ সুরেশ বলেন, ‘‘সে মদ্যপান করে এসব করতো৷ জোর করে করতো৷ যেখানে করার কথা নয়, সেখানেও করতো৷''
নারী অধিকার কর্মী চৈতালী ম্যারিটাল রেপের শিকার নারীদের নতুন চাকুরি বা বসবাসের আশ্রয় খুঁজে দেন৷ তবে আইনি সহায়তা দিতে পারেন না৷ কেননা, ভারতে যদি একজন স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে জোর করে যৌনসঙ্গম করে, তবে তা এখনো কার্যত অপরাধ নয়৷
ভারতীয় ছবি ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুর্কা'-তে নারীর যৌনজীবনের পাশাপাশি ম্যারিটাল রেপের ইস্যুটি তুলে ধরা হয়৷ ভারতের সেন্সরবোর্ড শুরুতে ছবিটি নিষিদ্ধ করলেও পরে বেশ কয়েকটি কাটছাটের পর মুক্তি পায় সিনেমাটা৷ ছবির পরিচালক অলংকৃতা শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘বিবাহের মধ্যে বড় ধরনের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ সম্পর্কের মধ্যেও ঘটে৷ তবে বিয়ের মধ্যে বেশি ঘটে৷ এর থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন, কেননা, সেগুলো মিটমাট করে ফেলতে বলা হয়৷''
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
আশার কথা হচ্ছে, ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ম্যারিটাল রেপের বিষয়টি আমলে নিয়েছে এবং শীঘ্রই এটাকে বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচনার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে৷ তবে ভারতীয় সমাজ এখনো বিষয়টি নিয়ে বিভক্ত৷ এমনকি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও পাওয়া গেল দু'ধরনের বক্তব্য৷ এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘‘যৌতুক আইনের অপব্যবহারের অনেক ঘটনা ঘটেছে ভারতে৷ মেরিটাল রেপের আইনের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে৷''
আরেক শিক্ষার্থীর মতে, ‘‘দৈহিক ঘনিষ্ঠতা একটি দম্পতির ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ কিন্তু তা যদি ধর্ষণ হয়, তাহলে তা অবহেলার সুযোগ নেই৷''
উল্লেখ্য, ধর্ষণ ভারতে এক বড় সমস্যা৷ ২০১২ সালে নতুন দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার এক তরুণীর মৃত্যুর পর ধর্ষণ রোধে পুলিশের তৎপরতা বাড়লেও আইনি জটিলতায় এখনো এ ধরনের অপরাধের শাস্তি অনেক সময় নিশ্চিত করা যাচ্ছে না৷ দেশটিতে এখনো প্রতি ২০ মিনিটে একটি ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটছে বলে জানাচ্ছে পরিসংখ্যান৷
প্রিয় পাঠক, এই বিষয়ে আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷