বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানেই আজকাল বিশেষজ্ঞদের রমরমা৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীদের সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়৷ এক জার্মান ভূ-বিজ্ঞানী এমন এক অভিযানের আগে তারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি
03:39
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরে ভাসমান আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন আইএসএস৷ ২০০০ সাল থেকে নভোচারীরা এখানে একটানা কাজ করে চলেছেন৷ জার্মানির আলেক্সান্ডার গেয়ার্স্ট মহাকাশের এই ল্যাবে যাবার আগে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অতীতে মানুষ সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে যেভাবে ভাবতো ওপারে কী আছে, আজ আমরাও ঠিক সেই মনোভাব নিয়ে মহাকাশে যাই৷ তখন মানুষ অজানাকে আবিষ্কার করতে জাহাজে করে পাড়ি দিতো৷ আসলে মানবজাতি আবিষ্কারের নেশায় মত্ত৷''
অ্যামেরিকার টেক্সাস রাজ্যের হিউস্টনে প্রশিক্ষণের একটা অংশ সারা হয়৷ প্রতিটি পদক্ষেপ বার বার অনুশীলন করানো হয়৷ কারণ পরে তো আর পরীক্ষার কোনো অবকাশ নেই৷ ৪ বছর ধরে গেয়ার্স্ট মহাকাশ অভিযানের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন৷ বেশ কয়েক ঘণ্টা স্পেসস্যুট পরে থাকতে হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা সবচেয়ে কঠিন প্রশিক্ষণের অন্যতম৷ প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা এই পোশাক পরে থাকতে হয়৷ প্রবল চাপ থাকে৷ বায়ুশূন্য অবস্থায় এটাই তো রক্ষাকবচ৷ অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের এক তৃতীয়াংশ চাপ থাকে পোশাকের মধ্যে৷ প্রতিটি মুভমেন্ট, হাত দিয়ে কিছু ধরা মানে যেন এক টেনিস বল পিষে দেওয়া৷ বুঝতেই পারছেন, ৭ ঘণ্টা ধরে এমনটা করে গেলে অবশেষে খুব ক্লান্ত লাগে৷''
আইএসএস-এ নভোচারীরা একাধারে বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী৷ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ তাঁদেরই করতে হয়৷ এছাড়া ল্যাবে পরীক্ষার কাজ তো আছেই৷ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ছাড়াও এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলি পৃথিবীতে কাজে লাগে৷ যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বাইরে বিভিন্ন পদার্থের আচরণ গবেষণা করা৷ নভোচারীদের নিজস্ব বিষয়ের বাইরেও অনেক কিছু জানতে হয়৷ গেয়ার্স্ট বলেন, ‘‘স্পেস স্টেশনে নভোচারী হিসেবে আমরা তো শুধু নিজেদের জন্য বিজ্ঞান চর্চা করছি না৷ ভূ-পৃষ্ঠে অনেক বিজ্ঞানীদের সাহায্য করছি৷ প্রত্যেকটি এক্সপেরিমেন্ট এক বিশাল টিমের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে করা হয়৷ এর অর্থ, শুধু আমার বিষয় – অর্থাৎ ভূ-বিজ্ঞান নয়, আরও অনেক বিষয়ে আমাকে গবেষণা করতে হয়৷''
মহাশূন্যে হাত বাড়াচ্ছে ইউরোপ
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
তারা থেকে তারায়
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷ ক্যাপসুলটি প্রথমে চন্দ্র প্রদক্ষিণ করবে৷ তারপর মহাশূন্যে অবস্থান নেবে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু হিসেবে৷ হয়তো মঙ্গলগ্রহ যাত্রার পথে তা কাজে লাগবে৷
ছবি: ESA-D. Ducros, 2012
মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় অভ্যস্ত হওয়া
প্রথমে ইউরোপের নভচারীদের পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস’এ যাত্রা করার পালা৷ এসা’র অ্যাস্ট্রোনট ইটালির লুকা পার্মিতানো একটি জলের চৌবাচ্চায় স্পেস ওয়াক অভ্যেস করছেন৷ স্থান: কোলোনের কাছে ইউরোপীয় নভচারী কেন্দ্র (ইএসি)৷
ছবি: ESA/H. Rueb, 2010
আইএসএস’র জন্য তিন ইউরোপীয় নভশ্চর
লুকা পার্মিতানো আইএসএস’এ থাকবেন এ’বছরের মে মাস থেকে নভেম্বর মাস অবধি৷ ২০১৪ সালে এ’ভাবেই যাবেন জার্মানির আলেক্সান্ডার গের্স্ট৷ তারপরে যাবেন একজন মহিলা, ইটালির সামান্থা ক্রিস্টোফোরেত্তি৷
ছবি: dapd/NASA
মানুষের বদলে মাল পরিবহণ
তিন ইউরোপীয় নভশ্চর আইএসএস’এ যাবেন রুশ সোয়ুজ রকেটে চড়ে৷ এসা ইতিমধ্যে তথাকথিত অটোম্যাটিক ট্রান্সফার ভেহিকেল বা এটিভি’র মাধ্যমে আইএসএস’এ মালপত্র পাঠায়৷ পরের যাত্রা আগামী ১৮ই এপ্রিল৷ এটিভি’তে সাত টন খাদ্য ও সরঞ্জাম পাঠানো যায়৷
ছবি: ESA/S.Corvaja/dapd
চন্দ্রবাসের স্বপ্ন
চন্দ্রপীষ্ঠে এ’ধরনের একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন থেকে এসা এখনও অনেক দূর৷ সেখানে জন পাওয়া গেলে, তা’তে চাঁদের ধুলো মিশিয়ে বাড়িঘর তৈরি করা যেতে পারে৷ এবং চাঁদে জল আছে কিনা, চীনের চাঙ-ই ৩ রোভার চন্দ্রযান তা এ’বছরেই জানতে পারবে৷ চন্দ্রে অবতরণের পর এসা ঐ রোভারে তথ্য পাঠানোর ভার নেবে এবং তার গতিবিধি পরিচালনা করবে৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
ডার্মস্টাট থেকে স্যাটেলাইট পরিচালনা
এসা’র ইউরোপীয় মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা এসক থেকে চাঙ-ই ৩’এর আগের চীনা মহাকাশযানগুলিতে তথ্য পাঠানোয় সাহায্য করা হয়েছিল৷ চীনের আগের মহাকাশযানগুলি চন্দ্র প্রদক্ষিণ করেছে কিন্তু চন্দ্রপীষ্ঠে অবতরণ করেনি৷ এসক থেকে অপরাপর বহু গবেষণা ও যোগাযোগ সংক্রান্ত স্যাটেলাইটের যাত্রার উপর নজর রাখা হয়৷
ছবি: ESA - J. Mai
থ্রি-ডি’তে আমাদের ছায়াপথ
এ’বছরের অক্টোবর মাসে স্পেস প্রোব বা মহাশূন্য অভিযাত্রী যান ‘গাইয়া’ তার যাত্রা শুরু করবে৷ ইন্টারোফেরোমিটারের সাহায্যে আলোকতরঙ্গ থেকে আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জের একটি থ্রি-ডি ছবি তৈরি করবে এবং ‘মিল্কি ওয়ে’ ছায়াপথের অনেক রহস্য উদঘাটন করবে৷ এসা’র গবেষকরা অন্তত এক বিলিয়ন নতুন তারা আবিষ্কার করার আশা করছেন৷ এমনকি তিন বিলিয়নও হতে পারে৷
ছবি: ESA/Medialab
গ্রহাণুর সন্ধানে
রোজেট্টা স্পেস প্রোব’টি ২০০৪ সাল যাবৎ ৬৭/পি চুরজুমভ-গেরাসিমেঙ্কো ধূমকেতু অভিমুখে যাত্রা করছে৷ ২০১৪ সালের সূচনায় মহাকাশযানটি ধূমকেতুটির কক্ষপথে যোগদান করবে৷ তবে ধূমকেতু অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে রোজেট্টা অনেক কিছু দেখবে: নাসা’র ডিপ ইমপ্যাক্ট প্রোজেক্টাইলটি কিভাবে টেম্পল ওয়ান ধূমকেতুতে আঘাত করবে৷ এচাড়া রোজেট্টা দেখবে মঙ্গলগ্রহ এবং স্টাইনস ও লুটেশিয়া নামের দ’টি অ্যাস্টেরয়েড বা গ্রহাণু৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধূমকেতুর উপর অবতরণ
২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে রোজেট্টা ফিলি নামের এই রোবোটটিকে ধূমকেতুর উপরে নামাবে৷ কোলোনে অবস্থিত জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্র ডিএলআর থেকে সেই অবতরণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে৷ কাজটা শক্ত হবে, কেনান ধূমকেতুটির মাধ্যাকর্ষণ খুব বেশি নয়৷ রোজ্ট্টা ধূমকেতুটির রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করবে৷
ছবি: ESA/AOES Medialab
স্যাটেলাইটের রিসাইক্লিং সম্ভব নয়
অর্ধশতাব্দী ধরে মহাকাশে রকেট ও স্যাটেলাইট পাঠানো হচ্ছে৷ এক সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় প্রায় ছ’লাখ নানা ধরনের ও আকারের স্ক্র্যাপ এ’ভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে৷ এসা চাপ দিচ্ছে মহাশূন্যে আবর্জনা কমানোর জন্য: অকেজো স্যাটেলাইটগুলোকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রিতভাবে ভূপাতিত করতে হবে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
নভোচারী হবার আগে আলেক্সান্ডার আগ্নেয়গিরি নিয়ে কাজ করেছেন৷ এখন তিনি ভবিষ্যৎ মঙ্গলগ্রহ অভিযানের ক্ষেত্রে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করবেন৷ মহাকাশের স্বপ্ন শুধু স্পেস স্টেশন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, আরও দূরে পাড়ি দেওয়া প্রত্যেক নভোচারীর স্বপ্ন৷ চাঁদ, গ্রহাণুর বলয়, তারপর মঙ্গলগ্রহ৷ এই মুহূর্তে আমাদের নাগালে মঙ্গলগ্রহই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মহাজাগতিক বস্তু৷ বায়ুমণ্ডলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই গ্রহ এককালে প্রাণের উপযুক্ত ছিল৷ ভূ-পৃষ্ঠে তরল পানি ছিল৷ এখন জায়গাটি মরু অঞ্চলের মতো শূন্য৷ পৃথিবীরও যাতে একই দশা না হয়, তা কীভাবে আমরা নিশ্চিত করবো?''
আলেক্সান্ডার গেয়ার্স্ট আপাতত এক সোয়ুজ রকেটে করে আইএসএস-এর উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবেন৷ কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে৷ মে মাসে অভিযান শুরু হওয়ার কথা৷ ৬ মাসের জন্য তিনি মহাকাশ থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন৷ তৃতীয় জার্মান হিসেবে তিনি আইএসএস-এর বাসিন্দা হবেন৷
বিশেষ ঘোষণা: এই সপ্তাহের অন্বেষণ কুইজে অংশ নিতে ক্লিক করুন এখানে৷