ক’দিন আগে দেশে গিয়েছিলাম দুই জার্মান সহকর্মীকে নিয়ে৷ সন্ধ্যার দিকে কক্সবাজারে ঢোকার মুখে যানজটে আটকে আছি৷ বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে তাদের ব্যাপক আগ্রহ৷ আর আমার আগ্রহ দেশের মানুষ সম্পর্কে যতটা ইতিবাচক কথাবার্তা বলতে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশিরা বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ, পরোপকারী৷ এসব জ্ঞান তাদের যখন দিচ্ছি, তখন দেখি আমাদের গাড়ির অন্য পাশে এক অটোরিকশা দাঁড়িয়ে৷ আর সেই অটোরিকশা দিয়ে মুখ বের করে রেখেছে অল্প বয়সি এক বালিকা৷ তার ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখভর্তি মেকআপ৷ প্রচণ্ড গরমে ঘামিয়ে উঠেছে বালিকা৷ ফলে মেকআপ, লিপস্টিক মিলেমিশে একাকার অবস্থা৷
বাঙালি নারীর দশ গুণ
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ নারীর গুণ সম্পর্কে জানিয়েছেন ডয়চে ভেলের পাঠকরা৷ তাঁদের মতামত এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বাঙালি নারীর দশগুণ নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
আবেগী, স্বাধীনচেতা
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ আবেগ যেমন তাঁদের দ্রুত স্পর্শ করে, তেমনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কিন্তু তাঁরা সত্যিকার অর্থে অনড়৷ নিজের সত্ত্বা নিয়ে অহংকার তাঁদের আছে বটে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে রয়েছে অসীম ধৈর্য্য৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
শাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাড়ি৷ সেই শাড়ি বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলে চমৎকারভাবে৷ বিভিন্নভাবে শাড়ি পরতে জানেনও তাঁরা৷ আর ‘উপহার হিসেবে শাড়ি’? – কোন বাঙালি মেয়ে না চায় বলুন?
ছবি: DW/A. Islam
উৎসব প্রেমী
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন৷ নববর্ষ, ঈদ কিংবা দুর্গা পূজা – সব উৎসবই যেন বাঙালি নারীর জন্য তৈরি৷ প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে মানানসই পোশাক পরতে এবং সেই উৎসবের উপযুক্ত রান্নায় পারদর্শী তাঁরা৷ ডয়চে ভেলের পাঠক সুজন খানের কথায়, ‘‘বঙ্গের নারী লাজুক প্রকৃতির, কিন্তু যে কোনো উপলক্ষ্যেই প্রাণ খোলা হাসি উপচে পড়ে তাঁদের৷’’
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
‘নো ডায়েট’
বাঙালি নারী ‘ডায়েট’ করছেন, এমনটা বেশ বিরল৷ তাই খাওয়ার ব্যাপারে তাঁরা বেশ উদার৷ কথায় বলে না, মাছে-ভাতে বাঙালি? অবশ্য মাছ-ভাতের পাশাপাশি ফুসকা কিংবা চটপটি পেলে তো আর কথাই নেই৷ আসলে টক, ঝাল, নোনতা, মিষ্টি, এমনকি তেতোও পছন্দ এই নারীদের৷
ছবি: Debarati Mukherji
রান্নার শখ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই ধরুন৷ দেশ সামলানোর কঠিন দায়িত্ব পালনের মাঝেও রান্না ঘরে যেতে ভোলেন না তিনি৷ গত বছর ছেলের জন্য রান্না করার সময় তোলা তাঁর এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিল৷ বাঙালি মেয়েরা রাঁধতে যে ভীষণ ভালোবাসেন!
ছবি: Sajeeb Wazed
অল্পতেই সন্তুষ্ট
বাঙালি মেয়েদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা কি খুব কঠিন? না৷ সকলেই জানেন যে, কাজটা সহজই৷ একটি লাল গোলাপ পেলে কিংবা প্রিয় রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেই তাঁরা সন্তুষ্ট৷ ডয়চে ভেলের পাঠক রন্জু খালেদের মতে, বাঙালি নারীর মধ্যে ‘একইসাথে দৃঢ়তা ও নমনীয়তা এবং প্রজাপতির চপলতা’ রয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
কাজল কালো চোখ
জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কিংবা রবি ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকলি’ – বাঙালি নারীর কাজল কালো চোখের প্রশংসা পাবেন অনেক কবির কবিতাতেই৷ সত্যি বলতে কি, বাঙালি নারীর চোখ পুরুষকে টানে সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: N.Seelam/AFP/GettyImages
বাকপটু
বাংলাদেশের কিংবা ভারতের মেয়েরা চুপ করে বসে আছেন – এমন দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন৷ তাঁরা কথা বলতে ভালোবাসেন৷ রান্না থেকে রাজনীতি – সব বিষয়েই একটা মতামত আছে তাঁদের৷ ডয়চে ভেলের পাঠক জিএনএস নয়নের কথায়, ‘‘নারী পুরুষের যে কোনো কষ্ট অতি সহজে ভুলিয়ে দিতে পারে৷ এই গুণই আমাকে মুগ্ধ করে, আবার সাথে অবাকও করে৷’’
ছবি: DW/A. Islam
নারীবাদী
বাঙালি মেয়েরা নারীবাদী৷ বিতর্কিত বাঙালি লেখিকা তসলিমা নাসরিন তাঁদের অনেকেরই প্রিয়৷ নাসরিনের ‘আমার মেয়েবেলা’ পড়েনি এমন নারী পাওয়া মুশকিল৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভ্রমণপ্রিয়
বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় বাঙালি নারীর গুণ কি আর অল্পতে জানানো যায়, বলুন? কিছু গুণ না হয় অজানাই থাক৷ তবে একটির কথা বলে শেষ করি, বাঙালি মেয়েরা কিন্তু ঘুরতে খুব ভালোবাসেন৷ তথ্য সহায়তা: ডয়চে ভেলে ফেসবুক পাতা, ইন্ডিয়াওপাইন্স, স্কুপহুপ
ছবি: DW/A. Islam
10 ছবি1 | 10
আমাদের আলোচনা ক্রমশ সেই বালিকা ঘিরে শুরু হলো৷ আমি জানালাম এরকম বালিকা-কিশোরী-তরুণীদের মুখভর্তি মেকআপ কিংবা লিপস্টিক ব্যবহার করতে দেয়ার ঘোর বিরোধী আমি৷ কারণ এতে করে অল্প বয়সেই তাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয় যে সুন্দর হতে হলে মেকআপ এবং লিপস্টিক অপরিহার্য ব্যাপার৷ আর এই ধারণা একসময় তাদের মনে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি করবে যে মেকআপ ছাড়া সে দেখতে মোটেই সুন্দর নয়৷
আমার জার্মান সহকর্মী নাওমী কনরাড কোন কিছু বলার আগে কিছুটা সময় নেন৷ কিছুটা ভেবে নিয়ে তিনিও বললেন একান্ত চেহারার কোন খুঁত ঢাকতে না চাইলে কিংবা প্রফেশনের প্রয়োজনে দরকার না হলে মেকআপ আসলে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷
নাওমীর সঙ্গে আমিও একমত৷ আমি তখন ভাবতে শুরু করি, মানুষের সৌন্দর্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আমরা কি ক্রমশ একটা ভ্রান্ত ধারনা দিচ্ছি? ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করা এই প্রজন্মের মধ্যে নিজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে মেকআপ, ফেসঅ্যাপসহ নানা ডিজিটাল ফিল্টার ব্যবহারের তীব্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলে যে একটা কথা আছে সেটা মনে হচ্ছে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে৷
এতে অবশ্য লাভবান ব্যবসায়ীরা৷ উঠতি বয়সের মডেল কন্যাদের সাজ-পোশাকে নিত্য নতুন পরিবর্তন এনে তাদের অনুসারী প্রজন্মকে সেসব সাজপোশাক কিনতে বাধ্য করার এই প্রবণতায় বড় ভূমিকা পালন করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যম৷ বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে জাস্টিন বিবার, কেইলি জেনার কিংবা আরিয়ানা গ্রান্ডের মতো তারকাদের অনুসরন না করলে আপনি যেন অনেকটা সমাজচ্যুতই হয়ে যাচ্ছেন৷
আমার মনে হয় এই পরিস্থিতির একটা পরিবর্তন দরকার৷ আর সেই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বকীয়তা, সামর্থ্য আর সৌন্দর্য্যজ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়া উচিত৷ একজন বাংলাদেশি মেয়ের গড় উচ্চতা পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি বা একজন পুরুষের উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার৷ আর এই স্বাভাবিকতাকে মেনে নিয়ে শ্যামলা কিংবা মোটা যেকোন অবস্থাতেই নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন সম্ভব৷
ফর্সা মানেই সুন্দর কিংবা লম্বা মানেই সুপুরুষ - এগুলো ব্যবসায়ীরা নানাভাবে আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে৷ যেকারণে দেশে ফেয়ার এন্ড লাভলি কিংবা হরলিকসের এত কদর৷ আদতে আপনি আপনার জন্মগতভাবে প্রাপ্ত শারীরিক রং, উচ্চতা নিয়েই সুন্দর হতে পারেন৷ আর সেজন্য দরকার আত্মবিশ্বাস৷ আমাদের বিজ্ঞজনদের উচিত বাঙালির সেই আত্মবিশ্বাসে আঘাত না হেনে বরং উৎসাহিত করা৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷