বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের অবকাঠামো পদ্মা বহুমুখী সেতুর যাত্রা শুরু হলো৷ শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎসবমুখর আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেতুটি উদ্বোধন করেন৷
বিজ্ঞাপন
মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে দেশের বৃহত্তম এ সেতুর উদ্বোধনে জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যার অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই, এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব৷’’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-কনক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক৷ এ সেতু বাংলোদেশের জনগণের৷ এর সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়, জেদ৷ যে জেদের কারণে আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণে সক্ষম হয়েছি৷’’
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, মানুষের সমর্থন আর সাহসেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজ সম্ভব হয়েছে৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনারা সবাই জানেন, এ সেতু নির্মাণ করতে যখন আমরা যাই, অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হয়, মিথ্যা অপবাদ, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবারকে যে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আমার মেয়ে সায়মা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলাম ড. মসিউর রহমানকে, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া… যারা এর সাথে জড়িত ছিল, তাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়, তাদের পরিবারসহ যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমি তাদের প্রতি সহমর্মিমতা জানাই৷’’
পাশাপাশি পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সব প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশি-বিদেশি পরামর্শক, ঠিকাদার, প্রযুক্তবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি৷
পদ্মা সেতু নিয়ে ১০ বছরের কিছু কথা ও ‘কুকথা’
গত ১০ বছর ধরেই বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে, সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচিত একটি বিষয় পদ্মা সেতু। নানা সময়ে এ নিয়ে রাজনীতিবিদ ও রাজনীতির বাইরের অনেকে অনেক কথা বলেছেন। সেসব নিয়েই এই ছবিঘর...
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
ঋণ চুক্তি বাতিলের সময় বিশ্ব ব্যাংকের বক্তব্য
২০১২ সালের ৩০ জুন বিশ্ব ব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে বিবৃতি দেয়। তাতে সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তা, এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ আছে- দাবি করে বিশ্বব্যাংক বলে, ‘‘কেবল তখনই একটি প্রকল্পে আমরা অর্থায়ন করবো, যখন আমরা যথেষ্ট নিশ্চয়তা পাবো যে, প্রকল্পটি পরিষ্কার ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হবে। ’’
ছবি: AFP/Getty Images/E. Baradat
খালেদা বললেন, দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবার জড়িত, এ আমলে পদ্মা সেতু হবে না
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের দিন চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিতে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর পরিবারই জড়িত। এই সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক আর টাকা দেবে না বলে দিয়েছে। ফলে এই সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না।’’
ছবি: Reuters
সাত সদস্যের বাইরে পরিবার নেই: শেখ হাসিনা
এর তিন দিন পর যেন খালেদার এই কথারই জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদে তিনি বলেন, “আমি, আমার ছোট বোন এবং আমাদের পাঁচ ছেলে-মেয়ে ছাড়া আমার আর কোনো পরিবার নেই। এর বাইরে আমার কেউ নেই। পরিবারের মোট সাত সদস্যের কেউ দুর্নীতিতে জড়িত নয়।” তাদের নাম ভাঙিয়ে কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে জানাতেও অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা। অভিযোগ জানানোর জন্য দুটি ফোন নম্বর এবং একটি ইমেইল ঠিকানাও দিয়েছিলেন তিনি।
ছবি: Reuters
দুর্নীতির অভিযোগ ফালতু: মুহিত
২০১২ সালের ৮ এপ্রিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর সঙ্গে প্রাক বাজেট আলোচনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী, প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত।বলেছিলেন, “পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি, আর এ ক্ষেত্রে তাদের (বিশ্ব ব্যাংক) পদক্ষেপ পুরোপুরি ভুল। কেউ কেউ বলছে, সেখানে দুর্নীতি হয়েছে। এটা একেবারেই ফালতু কথা।”
ছবি: Thomas Koehler/photothek.net/picture alliance
ঋণ চুক্তি বাতিল পরোক্ষভাবে বেশ ক্ষতিকর: আকবর আলী খান
বিশ্ব ব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর আকবর আলী খান বলেন, পরোক্ষভাবে এটি বাংলাদেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর হবে। ভবিষ্যতে নতুন প্রকল্প নেওয়া হলে তাতে দুর্নীতি সংক্রান্ত সম্ভাব্য বিষয়গুলোর জন্য নতুন শর্ত যুক্ত হতে পারে। এতে প্রকল্প অনুমোদন, প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অপেক্ষাকৃত কম দামে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো। এটি কারিগরি ও তদারকির দিক থেকেও অনেক উন্নত হতো। ’’
ছবি: Samir Kumar Dey
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি মির্জা ফখরুলের
পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল হওয়ার আগেই ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল বিএনপির সেই সময়কার ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। মন্ত্রীর এপিএস-এর গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এসব দুর্নীতির সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে দায় স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিৎ।”
ছবি: DW/S. Hossain
মসিউরের পদত্যাগ চেয়েছিলেন এরশাদ
২০১২ সালের আগস্টে পদ্মা সেতু ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে বলে ছিলেন সেই সময় ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছিলেন। সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসাইন প্রথমে ছুটিতে যান, পরে গ্রেপ্তার হন। সেই সময় ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর বিশ্ব ব্যাংককে ফেরাতে মসিউরের পদত্যাগ চান এরশাদ।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কারণে অন্য সব অগ্রাধিকার প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সরকারকে সতর্ক করেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল সিপিডিকে উদ্বৃত করে ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার মত তিন গুরুত্বপূর্ণ খাতের অতিরিক্ত বরাদ্দ খেয়ে ফেলতে পারে পদ্মা সেতু। এ সবে আশঙ্কাজনকভাবে বরাদ্দ কমে যেতে পারে।
ছবি: bdnews24.com
নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ নিছক ‘কল্পনাবিলাস’: মওদুদ
২০১২ সালের ৮ জুলাই নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখা সংসদে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই রূপরেখাকে ‘কল্পনাবিলাস’ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ। পরের বছর ১২ জানুয়ারি মওদুদ বলেন, পদ্মা ‘‘সেতুর কাজ শুরুর আগেই মন্ত্রী, আমলারা ১০ শতাংশ হারে ২ হাজার কোটি টাকা ঘুস নিয়েছেন। এ কারণে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে।’’
ছবি: bdnews24.com
জোড়া-তালির পদ্মা সেতুতে উঠবেন না: খালেদা
২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না।’’
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. M. Ahad
সেতু তো জোড়া দিয়েই হয়: শেখ হাসিনা
খালেদা জিয়ার মন্তব্যের জবাবে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘সেতু তো বিভিন্ন পার্ট (অংশ) তৈরি করে করে নির্মাণ হয়। এ ক্ষেত্রে তো জোড়া দিয়েই সেতু করা হয়। জোড়া না দিলে তো সেতু হয় না। উনি (খালেদা জিয়া) জোড়াতালি দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তবে বাংলাদেশে তো একটা প্রচলিত কথা রয়েছে, পাগলে কিনা কয়, ছাগলে কিনা খায়। আমার মনে হয়, এ ধরনের পাগলের কথায় বেশি মনোযোগ না দেওয়াই ভালো।’’
ছবি: Xinhua News Agency/picture alliance
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ইউনূসের হাত?
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে নোবেল বিজয়ী ইউনূসের ভূমিকার কথা নানা সময়ে উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়কেও ‘ভয় দেখানো’ হয়েছিল; বলা হয়েছিল ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরালে পদ্মা প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ ছাড়াও ‘অসুবিধা হবে।
ছবি: Getty Images/S. Vlasic
ইউনূস সেন্টারের অস্বীকার
একই বছরের ১৯ জুন ইউনূস সেন্টারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রফেসর ইউনূস পদ্মা সেতু প্রকল্পে দূর্নীতির সম্ভাবনা বিষয়ে প্রকাশ্যে বা ব্যক্তিগতভাবে কখনো কারো কাছে কোনো বিবৃতি দেননি। সরকারের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ তৈরিতে তিনি কখনোই কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন না।
ছবি: DW
পদ্মা সেতু নির্মাণের পর মির্জা ফখরুলের দাবি
গত ৫ জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, ‘‘পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন খালেদা জিয়া।’’ তবে এই দাবি নাকচ করে দেন খালেদা সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা। ২০০৫ সালের ৬ অগাস্ট হুদা একটি ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০০৬-এর মার্চে হওয়ার কথা ছিল। তবে তার চার বছর আগে ২০০১ সালের ৪ জুলাই শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
ছবি: bdnews24.com
14 ছবি1 | 14
অপমানের প্রতিশোধ: ওবায়দুল কাদের
উদ্বোধনী আয়োজনে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই সেতু বঙ্গবন্ধু পরিবার ও বাঙালিদের অপমানের প্রতিশোধ৷
কাদের বলেন, ‘‘গোটা জাতি আপনাকে স্যালুট করে৷ সারা বিশ্বে আজ আপনি প্রশংসিত৷ আপনি প্রমাণ করেছেন ইয়েস উই ক্যান৷ নিজের টাকায় পদ্মাসেতু নির্মাণ করেছি৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাথা নত করেনি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘অপবাদ দিয়েছে দুর্নীতির৷ আজকে বঙ্গবন্ধু পরিবার, সাবেক উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সচিব অনেককে অপমান করা হয়েছে৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা আমি মনে করি সক্ষমতার প্রতীক, এটা সত্য৷ তার চেয়ে বড় সত্য আমরা আমাদের প্রতিশোধ নিয়েছি৷’’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘‘সেতু নির্মাণে অন্য কারও কোনো কৃতিত্ব নেই৷ একমাত্র কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার৷ তার নামে পদ্মা সেতুর নাম হওয়ার কথা ছিল৷ সারাবাংলার দাবি ছিল এটা৷ কিন্তু তিনি নাকচ করে দিয়েছেন৷”
বাংলাদেশ সময় বেলা ১২ টার দিকে মাওয়া প্রান্ত থেকে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পর প্রথম যাত্রী হসিবে টোল পরশিোধ কর গাড়ি বহর নিয়ে সেতু পার হন প্রধানমন্ত্রী৷
বাংলাদেশের বিশাল অর্জন: বিশ্ব ব্যাংক প্রতিনিধি
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী আয়োজন অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি মার্সি টেম্বন৷
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার৷ আমরা এই সেতুর গুরুত্ব বুঝতে পারি৷ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘পদ্মা সেতুর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে৷ ভ্রমণের সময় কমে আসবে৷ কম সময়ে কৃষক তার খামারে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ করতে পারবেন৷ সবমিলে পদ্মা সেতু এই অঞ্চলের সমৃদ্ধি বয়ে আনবে, দারিদ্র্যও কমিয়ে আনবে৷”
উল্লেখ্য, শুরুতে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক৷ এই সেতু নির্মাণে প্রাক্কলিত খরচের বড় অংশই তাদের দেয়ার কথা ছিল৷ পরবর্তীতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রকল্পটি থেকে সরে আসে তারা৷ পরে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়৷
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার নির্মিত সেতুর উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণে মার্সি টেম্বন বলেন, ‘‘আমরা খুবই খুশি, এই সেতুর নির্মাণ শেষে উদ্বোধন করা হচ্ছে৷ দীর্ঘ দিনের উন্নয়নের বন্ধু হিসেবে আমরা উচ্ছ্বসিত৷”
গৌরবান্বিত বোধ করছি: জাফরুল্লাহ
‘পদ্মা সেতুর' নাম নিজের নামের করার দাবি নাকচ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী৷ এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো তিনি ‘প্রজ্ঞার' পরিচয় দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন৷
শনিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘‘আমি ব্যক্তি হিসেবে বলি, ইতিহাসে অনেক কিছু দেখেছি, শুধু একটা জিনিস ছাড়া, সাতই মার্চে দেশে ছিলাম না৷ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছে৷ আজকে এটা উদযাপনের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে৷”
পদ্মা সেতুর জন্য দেশের মানুষ ‘গর্বিত’ মন্তব্য করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা৷ তিনি বলেন, ‘‘উনার প্রজ্ঞাটা অন্য কারণে, সবাই উনাকে বলছিল- এটার নাম হাসিনা ব্রিজ করা হোক৷ উনি করেননি, উনি করেছেন পদ্মা ব্রিজ৷”
‘‘এটা ভবিষ্যৎ সুদূরপ্রসারী..., প্রমাণ করেছেন উনি, সাহসী৷ উনি জাতিকে যে উপহার দিয়েছেন, আমরা তাকে মাথায় উঠিয়ে রাখব৷ আমরা গৌরবান্বিত বোধ করছি৷”
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘‘উনি বড় কাজগুলো করেই ফেলেছেন৷ এখন উনাকে নজর দিতে হবে দেশের ছোট মানুষগুলোর দিকে৷ উনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি, উনার সুস্থতা কামনা করছি৷ আমরা একত্রে মিলে সুন্দর বাংলাদেশের অব্যাহত স্বপ্ন দেখছি৷”
এফএস/আরকেসি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
অনেক স্বপ্নের, অনেক প্রথমের পদ্মা সেতু
এক দশক ধরে বহু আলোচনা, অসংখ্য সংবাদের জন্ম দিয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প৷ নানা বাধা আর চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে অবশেষে সেই সেতু দিয়ে পদ্মা পরাপারের স্বপ্ন হতে যাচ্ছে সত্যি৷ এই প্রকল্প নিয়ে কিছু তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
যেভাবে শুরু
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে প্রথম সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা হয় ১৯৯৮-৯৯ সালে৷ দ্বিতীয় সম্ভাব্যতা পরীক্ষাটি হয়েছে ২০০৩-০৫ সালে৷ বিস্তারিত নকশা, ক্রয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে৷ ২০১২ সালের জুলাইয়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়৷ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় নির্মাণকাজ৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
‘নিজস্ব অর্থায়ন’
শুরুতে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, আইডিবি এই প্রকল্পে অর্থায়নের কথা ছিল৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের৷ দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পরবর্তীতে তারা এই প্রকল্প থেকে সরে গেলে বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সরকার সেতু নির্মাণ শুরু করে৷ শেষ পর্যন্ত খরচ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৮৭ কোটি ডলার বা ত্রিশ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা৷ নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের প্রথম কোন মেগা প্রকল্প৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
সবচেয়ে বড়
মূল সেতু দৈর্ঘ্যে ছয় দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার, ভায়াডাক্ট তিন দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার (সড়ক) ও ৫৩২ মি (রেল)৷ সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক এক-দুই কিলোমিটার৷ মূল সেতু নির্মাণের দায়িত্বে ছিল চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পো. লি.৷ নদীশাসনের কাজ করেছে চীনের সিনোহাইড্রো কর্পো.৷ দুই প্রান্তের সংযোগ সড়ক তৈরি করেছে এএমএল-এইচসিএম জয়েন্ট ভেঞ্চার৷ বঙ্গবন্ধু সেতুকে পেছনে ফেলে এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
আধুনিক স্থাপত্য
খরস্রোতা পদ্মার উপর এই সেতু নির্মাণে আধুনিক স্থাপত্য কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে৷ প্রকল্প কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নদী তলদেশে মাটির ১২০-১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর পাইল৷ ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন, যার কারণে রিখটার স্কেলে নয় মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে সেতুটির৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
যা থাকছে
সেতুতে থাকছে চার লেনের সড়ক, ডুয়েল গেজ একমুখী রেল ট্র্যাক৷ মধ্যে ৪০ টি সহ মোট ৪২ টি স্প্যানের উপর দাঁড়িয়ে সেতুটি৷ সড়ক, রেলপথ ছাড়াও গ্যাস ট্রান্সমিশন লাখ, ফাইবার অপটিক ও টেলিফোন লাইন গেছে এর উপর দিয়ে৷ ছয় দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার সেতুটি পার হতে লাগবে মাত্র ছয় মিনিট৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
খরচ উঠবে কবে
সরকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতুর টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে এক শতাংশ হার সুদে সরকারকে ফেরত দিতে হবে৷ সম্ভাব্যতা নিরীক্ষা অনুযায়ী, ২৪ থেকে ২৫ বছরে মধ্যে নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে৷ তবে এখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ১৬-১৭ বছরের মধ্যেই টাকা উঠে আসবে৷ এরইমধ্যে সেতু দিয়ে যানবাহন পার হওয়ার টোলও নির্ধারণ করেছে সরকার৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
অপেক্ষা যান চলাচলের
শুক্রবার উদ্বোধন হলেও পদ্মা সেতুতে সবার জন্য যান চলাচল শুরু হচ্ছে পরের দিন৷ ঢাকা থেকে যেসব গাড়ি শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে দক্ষিণের বিভিন্ন গন্তব্যে যায়, সেগুলো সেতু দিয়ে পদ্মা পার হতে পারবে৷ এমনকি ভারতের পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে পণ্য পরিবহণেও ব্যবহৃত হবে এই সেতু৷ এডিবির ধারণা অনুযায়ী, শুরুর দিকে প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে৷ পরবর্তীতে তা আরও বাড়বে৷