1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বপ্নের সৌদি আরবে ক্যাম্পবন্দি জীবন

৩১ আগস্ট ২০২২

বিদেশে গেলেই ভাগ্যের পরিবর্তন হবে৷ ধরা দেবে স্বপ্নের সোনার হরিণ৷ এমন আশায় বিদেশে গিয়ে কারও কারও জীবন বন্দি ক্যাম্পের চার দেওয়ালের মধ্যে৷

Mekka I Eine Million Pilger zum Hadsch erwartet
প্রতীকী ফাইল ফটোছবি: Mohammed Salem/REUTERS

সম্প্রতি সৌদি আরবে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতায় পড়েছেন অনেক বাংলাদেশি৷ ক্যাম্পের মধ্যেই কাটছে তাদের দিন-রাত্রি৷ ব্র্যাকের হিসাব অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ৩২ হাজারের বেশি মানুষ সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছেন৷

চুয়াডাঙ্গার ওসমান আলী ভাগ্য বদলের আশায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে গেছেন সৌদি আরব৷ সোমবার তার ছয় মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে৷ এখনও যোগ দিতে পারেননি কাজে৷ ক্যাম্পের মধ্যেই কাটছে তার সময়৷ মাঝে কয়েকদিন সুইপারের কাজ করলেও পেয়েছেন পাঁচ-ছয়শ রিয়াল৷ ডয়চে ভেলের কাছে ক্যাম্পবন্দি জীবনের কথা বলতে গিয়ে ওসমান বলছিলেন, "কখনও খেয়ে, কখনও না খেয়ে দিন কাটছে৷ খুবই কষ্টে আছি ভাই৷ কেউ না দেখলে বুঝবে না কতটা কষ্টে কাটছে দিন৷ আমাদের ক্যাম্পে দুইশ' জনের মতো বাংলাদেশি আছেন৷ যখন এখানে আর ধরে না তখন কাউকে কাউকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷ এদের অনেকগুলো ক্যাম্প আছে৷ কেউ ছয় মাস, কেউ আট মাস, কেউবা চার-পাঁচ মাস ধরে আছেন৷ কাজ জুটছে না৷ এত টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে কিভাবে খালি হাতে ফিরব? ভাই আমরা অনেক কষ্টে আছি৷''

ক্যাম্প থেকে মুক্ত হতেও লাগে টাকা

সৌদি আরবে এই শ্রমিকদের পাঠিয়েছে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি৷ চার লাখ টাকা দিয়ে চার মাস আগে সৌদি আরব গেছেন গাজীপুরের কোনাবাড়ির নজরুল ইসলাম৷ তার স্ত্রী পারভীন আক্তার একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আড়াই লাখ টাকা এনজিও থেকে ঋণ করে, নিজের গহনা বিক্রি করে আর জমানো টাকা দিয়ে স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়েছি৷ ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের এমডি মোশায়েদ হাসানের কাছেই এই টাকা দিয়েছি৷ চার মাস ক্যাম্পে রেখেও তারা যখন চাকরি দিচ্ছিল না, তখন সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন আমার স্বামী৷ এর জন্যও ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা নাসির হোসেনকে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে৷ এখন চাকরির খোঁজে আমার স্বামী সেখান থেকে বেরিয়ে গেছেন৷ স্বামী চাকরি না পেলেও প্রতি মাসে এনজিওর ঋনের কিস্তি দিতে হচ্ছে৷ কীভাবে দিচ্ছি তা একমাত্র আল্লাহ জানেন৷ ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে এখন আমাদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে৷”

একই কোম্পানির মাধ্যমে গত ৭ জুলাই সৌদি আরব গেছেন মুজিবর রহমান৷ তাকেও কোনো কাজ দেওয়া হয়নি৷ ক্যাম্পেই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তার৷ বিষয়টি পরিবারকে জানালে তার চাচাতো বোন তাফসিনা ইয়াসমিন যোগাযোগ শুরু করেন৷ তিনি বিষয়টি জানিয়ে একই সঙ্গে ই-মেইল করেন সৌদি আরবে বাংলাদেশের দূতাবাস, জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষন ব্যুরো (বিএমইটি), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গায়৷ পুলিশ নিয়ে হাজির হন রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে৷ এতসব তৎপরতার পর মুজিবরের আকামা করে দেয় এজেন্সি৷ তারপরও কাজ দেয়নি৷ তার অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৩ আগস্ট শুনানির আয়োজন করে বিএমইটি৷ সেখানে এজেন্সির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন৷ শুনানি গ্রহণ করেন বিএমইটির উর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মাসুদ রানা৷

‘এনজিও থেকে ঋণ করে স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়েছি’

This browser does not support the audio element.

তাফসিনা ইয়াসমিন ডয়চে ভেলের কাছে অভিযোগ করেন, "শুনানির শুরুতেই আমার সার্বিক অভিযোগ আমলে না নিয়ে আমার ভাইয়ের বিষয়টি সমাধানের কথা বলেন তারা৷ তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, আমি অভিযোগ করে ভুল করেছি৷ আমি অভিযোগ করেছি, এই এজেন্সি গত এক বছরে যাদের সৌদি আরব পাঠিয়েছে তাদের একজনকেও চাকরি দিতে পারেনি৷ সেখানে এজেন্সির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাকেই বলা হলো, সার্বিক বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য তারা শুনবেন না৷ শুধু আমার ভাইয়ের বিষয়ে কিছু বলার থাকলে যেন বলি৷ তখন আর কী করা? আমি বললাম তারা যেন আমার ভাইকে ছেড়ে দেয়, আমি অন্য কোথাও চাকরির ব্যবস্থা করব৷ সেভাবেই তারা অভিযোগের নিষ্পত্তি করে দিল৷ এই প্রতিষ্ঠানটির পাঠানো মানুষগুলো গত এক বছরে এক টাকাও রেমিটেন্স পাঠায়নি৷ তাহলে তারা কিভাবে লোক পাঠাচ্ছে, সেই প্রশ্নটি আমি তাদের করেছিলাম৷ কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ নেই বিএমইটির কর্মকর্তাদের৷”

জানতে চাইলে বিএমইটির উর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মাসুদ রানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তারা নিজেরাই আলোচনা করে একটা সমঝোতায় এসেছেন৷ আমরা সেটা বাস্তবায়ন করে দিয়েছি৷ উনি সমঝোতা না করলে আমরা আমাদের মতো সিদ্ধান্ত নিতাম৷ সেই সুযোগ তো তিনি দেননি৷ বরং তিনি অভিযোগের নিষ্পত্তি করে গেছেন৷”

প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধাররা

মানবপাচার ও জিম্মির মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগে গত ১৯ মে গ্রেপ্তার হন ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশায়েদ হাসানসহ (২৬) পাঁজ কর্মকর্তা৷ অন্যরা হলেন, গোলাম আজম সৈকত (৪২), মেহেদী হাসান শান্ত (২৩), মোহসিন হোসেন (২৬) ও নাইফ উদ্দিন রুদ্র (২০)৷ পল্টন থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাব৷ পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য প্রমাণ পাওয়ায় পল্টন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়৷ এই পাঁচজন এবং সৌদি আরবে অবস্থানরত এই চক্রের আরেক সদস্য (ক্যাম্পের দায়িত্বপালনকারী) মো. নাসির উদ্দিনসহ (৫০) মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়৷ পরে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ৷

মামলার বাদি পলি আক্তার লিজা অভিযোগ করেন, তার স্বামী কামরুল আহসান এবং সঙ্গে আরও পাঁচজনকে কাজের চুক্তিতে সৌদি আরবে পাঠায় ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল৷ যাওয়ার সময় জোর করে তাদের ব্যাগে চার-পাঁচ কেজি জর্দা দিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটির লোকজন৷ কিন্তু সৌদি আরবে যে কোম্পানির জন্য পাঠানো হয়, তারা তাদের গ্রহণ করেনি৷ তবে চক্রের সদস্য মো. নাসির উদ্দিন গ্রহণ করে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যান৷ এরপর দীর্ঘদিন সেই ক্যাম্পে তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়৷ সেই সঙ্গে দাবি করা হয় মোটা অংকের টাকা৷ স্বামীকে নির্যাতন থেকে বাঁচাতে কিছু টাকাও দেন তিনি৷ পাশাপাশি ওই ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের মালিক এবং কর্মকর্তাদের বিষয়টি সমাধানের জন্য জানান৷ কিন্তু তারা সমাধান না করে উল্টো টাকা না দিলে নির্যাতন চলবে বলে হুমকি দেন৷ বাধ্য হয়ে তিনি মামলা দায়ের করেন৷

কয়েকদিনের মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেয়ে বাদির সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি৷ ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশায়েদ হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ভুল বোঝাবুঝির কারণে মামলাটি হয়েছিল, বাদির সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়ে গেছে৷” অন্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "কাজ করতে গেলে ভুল হতে পারে৷ আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ নেই, সেটা বলব না৷ তবে কারও সমস্যা হলে আমরা সমাধান করে দেই৷ মুজিবরের বোনের সঙ্গেও আমাদের সমঝোতা হয়ে গেছে৷”

গত এক বছরে ৭০০ থেকে এক হাজার মানুষকে তারা সৌদি আরব পাঠিয়েছে দাবি করে মোশায়েদ হাসান বলেন, "আমরা যাদের পাঠিয়েছি, তারা অধিকাংশই ভালো আছে৷ দু'একজনের সমস্যা হলে সমাধান করে দিচ্ছি৷”

ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও আসছে ওয়ার্ক পারমিট

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর রেজা ই রাব্বি ডয়চে ভেলের কাছে সাম্প্রতিক সংকটের কথা স্বীকার করেছেন৷ তিনি বলেন, "আগে আমাদের জানতে হবে সমস্যার মূলটা কি? সমস্যার মূলে হচ্ছে করোনার সময় সৌদি আরবে ছোট, বড়, মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে৷ অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন৷ পরবর্তীতে সৌদি সরকার উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কোম্পানী খোলা এবং ঋণ প্রাপ্তি সহজ করেছে৷ মাত্র এক হাজার ১৫০ রিয়েল দিয়েই ঘরে বসে অনলাইনে একটা কোম্পানী খোলা যায়৷ এর ফলে গত বছরের এপ্রিল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এক বছরে এক লাখ ২ হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে৷ এই কোম্পানিগুলোর কোনো কাজ নেই৷ তারা অপেক্ষায় আছে কোন প্রজেক্টে সাপ্লাইয়ের কাজ পাওয়ার জন্য৷ এরাই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ভিসা দিচ্ছে৷ এর মধ্যে আবার এখানে সৌদিকরণ চলছে৷ এটা এমন যে, কোন কোম্পানিতে ৩০ শতাংশ সৌদি নাগরিককে নিয়োগ দিতে হবে৷ তা না হলে ওই কোম্পানিকে রেড ঘোষণা করা হচ্ছে৷ এর ফলে তারা কোন কাজ পাবে না৷ এদের কোন কর্মীকে আকামা দেওয়া হবে না৷ আবার এখানে কর্মীদের ওয়ার্ক পারমিট রিনিউ করতে ১২ থেকে ১৩ হাজার রিয়াল খরচ হয়৷ এই বিপুল টাকা তারা এখন দিতে পারছে না৷ ফলে কর্মীরা বেকার হয়ে যাচ্ছে এবং দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে৷”

এর মধ্যেও তাহলে নতুন মানুষ কীভাবে যাচ্ছেন? তাদের আটকানো হচ্ছে না কেন? জানতে চাইলে জনাব রাব্বি বলেন, "আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি৷ যারা আসছে তারা যেন চেক করে আসে৷ এত মানুষকে একমোটেডে করার সুযোগ এখানে নেই৷ গত পাঁচ-ছয় বছরে ২৫ লাখ কর্মী এখানে এসেছে৷ কিছু অসাধু এজেন্সি ফ্রি ভিসার নামে আনছে৷ এখন এখানে কেউ স্পন্সরের বাইরে কাজ করতে পারে না৷ এখানে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার সুযোগ নেই৷ ফলে কিছু এজেন্সি শুধু লোক পাঠিয়ে উপার্জনের ধান্দা করছে৷”

সংকটময় এই পরিস্থিতিতে বিএমইটি কী করছে? জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক শহীদুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বর্তমানে দু'একটি কোম্পানি, যাদের নিজেদের কারখানা নেই, তারা অন্য কোম্পানিতে সাপ্লাই দিতে লোক নিচ্ছে৷ এই অনুমতিটা সেই দেশের ব্যাপার৷ ভিসা পাওয়াটাও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ নিয়োগকারী দেশের যদি ইচ্ছে থাকে কাজ ছাড়াও কর্মী আনা যাবে, তাহলে সেটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের৷ এখন এখান থেকে তো বোঝা মুশকিল কে মূল কোম্পানি আর কে সাপ্লায়ার? এটা নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে৷''

যারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তাদের ব্যাপারে বিএমইটি কী করছে? জানতে চাইলে জনাব আলম বলেন, "কেউ ফিরে আসলে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারে৷ এমনকি সচিব বরাবর ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে পারেন৷ আমরা তখন আইনগতভাবে তাদের প্রতিকার দেব৷ তবে যারা যাচ্ছেন তাদেরও যাচাই বাছাই করে যেতে হবে৷ তারও কিছু দায়িত্ব আছে৷ এখন বিশ্বব্যাপী যে রেমিটেন্স বা বৈদেশিক মুদ্রার হিমশিম অবস্থা, সেখানে আমরা যদি প্রমোট না করে কন্ট্রোল করতে যাই হয়ত কিছু মানুষের আপাত ভালো হতে পারে৷ কিন্তু মূল স্রোতধারা বাধাগ্রস্থ হয়, এমন কিছু করার সময় এখন না৷ এখন যারা বাইরে যাচ্ছে তাদের কিছু মানুষের সমস্যা হলে সেটারও সমাধান করতে হবে৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ