এবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষকসহ মোট সাতজনকে হত্যার হুমকি দিয়েছে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসায় ডাক যোগে ওই হুমকির চিঠিটি পাঠানো হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলীও ওই চিঠি পান৷
এতে তালিকার শীর্ষে একে আজাদ চৌধুরীর পরেই লেখা রয়েছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নাম৷ লাল কালিতে চিঠিতে নামের তালিকার উপরে লেখা ‘সেকেন্ড লিস্ট অফ ডেথ'৷ সবার নামের পরে লেখা আছে ‘মাস্ট ইউ উইল প্রিপেয়ার ফর ডেথ'৷ তালিকার প্রতিটিনামের ডান পাশেই ভিন্ন ভিন্ন ট্যাগ লেখা আছে৷
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর নামের পাশে লেখা ‘ইসলামিক এনিমি'৷ এরপরেই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল-এর নামের পাশে লেখা ‘মিনিস্টার ট্রেইটর বিডি'৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন – ‘অ্যান্টি ইসলাম রাইটার'৷ অভিনেত্রী শমী কায়সার ‘নাস্তিক'৷ আবু মুসা মুহাম্মদ মাসুদুজ্জামান জাকারিয়া মাসুদ ‘অ্যান্টি ইসলাম.ওয়ার্কার'৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. এম আমজাদ আলীর নামের পাশে লেখা ‘ডিফেমার অফ ডিউ'৷ সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের নামের পাশে লেখা আছে ‘ইসলামিক এনিমি'৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ধানমন্ডি থানায় জিডি করেছি৷ আমরা আতঙ্কে আছি৷''
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নুরে আজম মিয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা এখনো হুমকিদাতাদের চিহ্নিত করতে পারিনি৷ তবে আমরা তৎপর রয়েছি৷ আমরা জানার চেষ্টা করছি, কারা হুমকি দিয়েছে৷ এছাড়া যাদের হুমকি দেয়া হয়েছে তাদের নিরাপত্তাও জোরদার করেছি৷''
তিনি বলেন, ‘‘যে জঙ্গি সংগঠনের নামে হুমকি দেয়া হয়েছে, সেই নামে আগেও বিশিষ্ট জনদের হুমকি দেয়া হয়েছিল৷ এ ব্যাপারে শাহবাগ থানায় একটি মামলা রয়েছে৷ আমরা শাহবাগ থানার কাছ থেকেও তথ্য নেয়ার চেষ্টা করছি৷''
সহিংসতায় প্রধান হাতিয়ার ‘পেট্রোল বোমা’
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার সময় পেট্রোল বোমার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে৷ হাতে তৈরি এই বোমা ব্যবহার করে গাড়িতে আগুন দেয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
পেট্রোল বোমায় পুড়ছে জীবন
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ৷ নির্বাচনসংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এসময়৷ হরতাল, অবরোধ চলাকালে ব্যাপক আকারে ব্যবহার হয়েছে পেট্রোল বোমা৷
ছবি: imago/imagebroker/theissen
যেভাবে তৈরি হয় এই বোমা
কাঁচের বোতল, পেট্রোল আর কিছু ভাঙা কাঁচ বা মার্বেলের টুকরা ব্যবহার করে পেট্রোল বোমা তৈরি করছে দুর্বৃত্তরা৷ এরপর সুযোগ বুঝে সেগুলো নিক্ষেপ করছে যাত্রীবাহী গাড়িতে৷ ফলে গাড়ি পুড়ছে, সঙ্গে পুড়ছে মানুষ৷ সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: picture alliance/abaca
রয়েছে অন্য বোমাও
তবে শুধু পেট্রোল বোমাই নয়, লাল বা কালো টেপে মোড়া ককটেলও ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে৷ ককটেল তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এবং ছোট পেরেক বা লোহার টুকরা৷ এছাড়া বোমা তৈরিতে গান পাউডারও ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বোমা বাণিজ্য
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সময় হাতে তৈরি বোমার চাহিদা বেড়ে যায়৷ তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ছাড়াও পেশাদারি গ্রুপও বোমা তৈরি করে৷ চড়া দামে এসব বোমা বিক্রিও করা হয়৷ গত বছর পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, একেকটি হাত বোমার দাম ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত৷
ছবি: Reuters
বড় পর্যায়ে বোমা হামলা
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আত্মঘাতী বা বড় পর্যায়ে বোমা হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ তবে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷
ছবি: dpa - Bildfunk
আত্মঘাতী হামলা
১৭ আগস্টের সেই সিরিজ হামলার পর কয়েকটি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনাও ঘটে৷ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেসময় ‘‘বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত হন৷’’ তবে নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর হাতে জঙ্গিবাদের উত্থান দমনে সক্ষম হয়৷ ২০০৭ সালে জেএমবির কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়৷
ছবি: AP
বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম
ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানান, বাংলাদেশ পুলিশের শক্তিশালী বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম রয়েছে৷ তাদের কাছে আধুনিক সরঞ্জামও রয়েছে৷ ইতোমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের বোমা নিষ্ক্রিয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছে পুলিশের এই টিম৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
তবে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা প্রাথমিক তদন্তে এর আগে ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিককে হত্যার হুমকি কারা দিয়েছে, তা চিহ্নিত করতে পারিনি৷ তবে এখন আমরা মামলার তদন্ত করছি না৷ তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগকে৷''
ওদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) জাহাঙ্গির আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘তদন্ত চলছে, তবে এখনো অপরাধীদের চিহ্নিত বা আটক করা যায়নি৷''
এর আগেও মে মাসের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ দশজনকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল আল-কায়েদা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩ নামের সংগঠনটি৷ উল্লেখ্য, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে গত সপ্তাহে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর বলেন, ‘‘আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও বিষয়টি জানিয়েছি৷ আগের হুমকির ব্যাপারে পুলিশ তদন্তের কোনো অগ্রগতি জানায়নি৷ আমরা আশা করছি অপরাধীরা আটক হবে৷''
প্রসঙ্গত, প্রক্টর ড. এম আমজাদ আলী দু'টি মামলারই বাদি৷