ডয়চে ভেলেকে দেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ রোস্তারাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসানের কথায় উঠে এসেছিল হতাশার কথা৷ তবে সরকার ভ্যাট ১৫ শতাংশ না করে আগের মতো ৫ শতাংশই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়ায় স্বস্তি ফিরেছে তার মনে৷
বিজ্ঞাপন
তবে শঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি...
গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর । প্রজ্ঞাপনে রেস্তোরাঁর খাবারের বিলের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এ সিদ্ধান্তে তীব্র আপত্তি জানায় রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তারা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচিও ঘোষণা করে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। তবে এ কর্মসূচির মাঝেই রেস্তোরাঁর ওপর থেকে বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানায় এনবিআর৷ এনবিআরের সদস্য (মূসক বা ভ্যাট নীতি) বেলাল হোসাইন চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ। আবার সরকারেরও রাজস্ব আয় বাড়ানো দরকার। তাই কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষ রেস্তোরাঁর খাবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই জনস্বার্থে রেস্তোরাঁর ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে আমরা সরে এসেছি।''
স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশ রোস্তারাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসানের সামনে রাখতে হয় নতুন প্রশ্ন:
রোস্তারাঁ মালিক সমিতির মহাসচিবের মুখে তবুও শঙ্কার কথা
ইমরানহাসান: ১৫ শতাংশ ভ্যাট হতো। এখন সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় আমাদের ৫ শতাংশ দিতে হবে। এই ৫ শতাংশ আগেই ছিল। আগামী রবিবার হয়ত এনবিআর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি। সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আবাসিক হোটেলের ভ্যাট প্রত্যাহার হবে না। সেটা নিয়ে আমাদের কোনো দাবিও ছিল না।
রেস্তোরাঁর খাবারের বিলের ওপর ভ্যাট আগের মতো ৫ শতাংশ রাখার সিদ্ধান্তে অনেকটা স্বস্তি ফিরলেও ইমরান হাসান মনে করেন, মূল্যস্ফীতির এই বাজারে অস্বস্তি তবু থাকবে, কারণ, ‘‘আসলে আরো অনেক পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এলপি গ্যাসের দামও বেড়ে গেছে। বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। তার প্রভাব রেস্তোরাঁ ব্যবসায় পড়ছে। কিন্তু রোস্তোরাঁয় সাপ্লিমেন্টাারি ডিউটি আছে।
এখন সাপ্লিমেন্টারি ডিউটিরও প্রত্যাহার চান তারা৷ এমন প্রত্যাশার পক্ষে যুক্তিটা অবশ্য আগের সাক্ষাৎকারেই দেখিয়েছিলেন রেস্তোরাঁ মালিকদের এই প্রতিনিধি, ‘‘আমরা করোনার সময় একবার ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমাদের ব্যবসা তখন বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। করোনার পর আমরা ঘুরে দঁড়াচ্ছিলাম। এখন আবার মূল্যস্ফীতি। শিল্প গ্যাসের দাম আবার বেড়েছে। দেশে এখন একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতি, ফলে ব্যবসায় মন্দা।'' ইমরান হাসান জানান, ভ্যাটের বাইরে সেলস ট্যাক্সও দিতে হয় তাদের৷ এ কারণে বড় এক শঙ্কার কথাও উঠে আসে তার কথায়, ‘‘ভ্যাটের বাইরে আমাদের সেলস ট্যাক্স দিতে হয়। বছর শেষে আমাদের বিক্রির ওপরে ৩৫ শতাংশ লাভ ধরে একটা ট্যাক্স নেয়। আর এটা এমন জটিল যে, সঠিকভাবে সেই ট্যাক্স দিতে হলে ব্যবসা তো দূরের কথা , আমাদের ঘর-বাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে।
পণ্য ও সেবায় শুল্ক-ভ্যাট বাড়ানোর কিছু প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি মোবাইল ফোন ব্যবহার, এলপি গ্যাস, হোটেলসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে৷ এই নিয়ে জনমনের প্রতিক্রিয়া জেনে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: DW
‘আইএমএফ-এর চাপে অন্তর্বর্তী সরকার ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়িয়েছে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘‘আইএমএফ-এর চাপে অন্তর্বর্তী সরকার ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়িয়েছে৷ সরকারের অন্যান্য জায়গা থেকেও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করার সুযোগ ছিল৷ ভ্যাট হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়াশীল কর৷ মানে যার যা আয় হোক না কেন, সবার উপরে সমানভাবে পড়ে৷ ফলে এতে নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের উপর বড় রকমের অভিঘাত পড়বে, কারণ, তারা মূল্যস্ফীতির দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে আছে৷’’
ছবি: DW
‘সবসময়ের মতো মধ্যবিত্তের উপরই প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তায়্যিব-উল-ইসলাম সৌরভ বলেন, ‘‘ক্ষেত্রভেদে শতকরা ৫০ থেকে ২০০ বা তারও বেশি হারে শুল্ক-ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে৷ সবার মতোই আমারও জিজ্ঞাসা- এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে কেন এই ব্যাপক বর্ধন? এই বৃদ্ধি সব শ্রেণির উপরই প্রভাব ফেলবে এবং সব সময়ের মতো মধ্যবিত্তের উপরই প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি৷’’
ছবি: DW
‘ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ানোতে সমস্যা নেই, লাগামহীন যেন না হয়’
ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নাজিয়া ওহাব বলেন, ‘‘পৃথিবীর সব দেশই হয়ত প্রয়োজনে ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়িয়ে থাকে৷ ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ানোতে সমস্যা নেই, কিন্তু তা যেন লাগামহীন না হয়৷ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সাথে এই বাড়তি সংযোজনের সামঞ্জস্য হওয়া উচিত৷ ১৬ বছরের জঞ্জাল আমরা রাতারাতি সংস্কার করতে পারবো না৷ তাই ধীর নীতি গ্রহণ করাই কাম্য৷’’
ছবি: DW
‘ভ্যাট বাড়লেও আমাদের আয় তো আর বাড়ে নাই’
চাকরিজীবী সাবিলা আলাউদ্দিন আঁখি বলেন, ‘‘কিছুদিন আগেই দেশ অস্থিতিশীল ছিল, বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা বন্ধ হয়েছে৷ এর মধ্যে অর্থবছরের মাঝামাঝি হুট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো এক ধরনের অ্যাগ্রেসিভ সিদ্ধান্ত৷ সামনে রমজান আসছে, এতে করে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষদের সমস্যা বাড়বে৷ ভ্যাট বাড়লেও আমাদের আয় তো আর বাড়ে নাই৷’’
ছবি: DW
‘নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর ট্যাক্স বাড়ানোটা জুলুমের পর্যায়ে পড়ে’
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোঃ আজগর বলেন, ‘‘ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ছে, কিন্তু আমার তো ইনকাম বাড়েনি৷ মানুষের হাতে টাকা নেই, তাই বিক্রিও কম৷ এতে করে আমার উপার্জনও নেই৷ ধনীদের ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়াতে পারে, যেমন গয়না কিংবা আবাসন সামগ্রীর উপর ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়াতে পারে৷ কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর ট্যাক্স বাড়ানোটা জুলুমের পর্যায়ে পড়ে৷’’
ছবি: DW
‘খিদা নিয়ে পরিবারের অনেকে কাজে যায়’
গৃহিণী খোরশেদা বেগম বলেন, ‘‘ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ায় আমাদের জিনিসপত্র কম কিনতে হয়৷আগে আমরা যা খেতাম, এখন তার অর্ধেক খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে৷ খিদা নিয়ে পরিবারের অনেকে কাজে যায়৷’’
ছবি: DW
‘একটা হতাশা কাজ করছে’
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মো. আব্দুল বাতেন বলেন, ‘‘সবার মধ্যে একটা হতাশা কাজ করছে৷ নতুন সরকার আসছে অনেক দাপট দেখিয়ে, কিন্তু ফলাফল শূন্য৷ নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা যা ছিল, ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়াতে তা হতাশায় পরিণত হয়েছে৷’’
ছবি: DW
‘আমাদের কথার কোনো দাম নেই’
সিএনজি চালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের উপার্জনের উপায় কম৷ আমরা যা উপার্জন করি, তা দিয়ে সংসার চালানো অনেক কঠিন৷ তার মধ্যে আবার ভ্যাট, ট্যাক্স বেড়েছে৷ আমরা একটা ভালো জিনিস কিনে খেতে পারি না৷ মানুষের হাতে টাকা নেই৷ রাস্তাঘাটে যাত্রী দেখা যায় না তেমন৷ আমাদের কথা কেউ শোনে না, আমাদের কথার কোনো দাম নেই৷’’
ছবি: DW
‘ভ্যাটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে’
এদিকে, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমরা ওষুধ, রেস্তোরাঁর মতো কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসের উপর ভ্যাট আবার পর্যালোচনা করবো৷ সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসের উপর ভ্যাটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে৷’’