১৯৭১ সাল৷ মুক্তিযুদ্ধ চলছে৷ নিরীহ নিরাপরাধ বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করছে পাকিস্তানি সেনারা৷ তাদের ভয়ে জীবন নিয়ে দলে দলে মানুষ আশ্রয় নেয় সীমান্তের ওপারে, ভারতে৷ খোলা হয় শরণার্থী শিবির৷
বিজ্ঞাপন
প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ওপর৷ ভারতের কিছু রাজ্যের মানুষ এতে নাখোশ হয়৷ শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করতে নানাভাবে তারা সরকারকে চাপ দিতে থাকে৷
ঠিক ওই সময়েই পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ আয়োজনের৷ এতে অংশ নেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বাংলাদেশের ৩৮ জন শিক্ষিত যুবক৷ ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, মুজিবের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় জনমত গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য৷
পদযাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জনসভা করতেন৷ গণহত্যা সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আহ্বান জানাতেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর৷ তাদের সকলের হাতে হাতে শোভা পেত- ‘আমাদের এক কথা-বাংলাদেশের স্বাধীনতা’, ‘মুজিবের মুক্তি চাই’ সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ও জাতীয় পতাকা৷ ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি চলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ৷ দেশি- বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে পদযাত্রার খবর৷ সে খবর ব্যাপক আলোড়নও তোলে৷ এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় তথা বিশ্ব জনমত গড়তে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল৷
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু দুর্লভ ছবি
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-র সংগ্রহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে৷
ছবি: AP
উত্তাল মার্চ
১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ ঢাকার রাস্তায় স্বাধীনতার দাবিতে হারপুন হাতে বিক্ষোভ মিছিল৷
ছবি: AP
যশোরে মুক্তিবাহিনী
২ এপ্রিল ১৯৭১৷ যশোরে মার্চ করছে মুক্তিবাহিনী৷
ছবি: AP
ত্রিপুরায় বাংলাদেশি শরণার্থী
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল৷ প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে ভারতের ত্রিপুরার মোহনপুরের একটি স্কুল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশিরা৷
ছবি: AP
ভারত সীমান্তের কাছে বাংলাদেশিদের অবস্থান
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল৷ ভারত সীমান্তের ৩০ মাইলের মধ্যে কুষ্টিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকেই অবস্থান করছিল৷
ছবি: AP
বেনাপোলের কাছে শরণার্থী শিবির
১৪ এপ্রিল ১৯৭১, যশোরের বেনাপোলের কাছে ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: AP
আহত মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর বোমা হামলায় আহত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাচ্ছেন বেসামরিক মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা৷
ছবি: AP
মুক্তিবাহিনী
১৯৭১ সালের ৩ রা আগস্ট৷ ঢাকার কাছে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হেমায়েতউদ্দীন একটি গোপন ক্যাম্প থেকে মেশিনগান তাক করে রেখেছেন৷
ছবি: AP
১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে প্লাটুন
১৩ নভেম্বর ১৯৭১৷ ফরিদপুরে রাইফেল হাতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ৷ ৭০ সদস্যের একটি প্লাটুন গড়া হয়েছিল সেখানে৷ সেই প্লাটুন দক্ষিণাঞ্চলে সামরিক ও চিকিৎসা দ্রব্য সরবরাহ করত৷ একদম বামে থাকা ১৯ বছর বয়সি তরুণটি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ ৭০ জনের প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি৷
ছবি: AP
মুক্তিবাহিনীর পারুলিয়া দখল
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর৷ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পারুলিয়া গ্রাম দখল করে নেয় মুক্তিবাহিনী৷
ছবি: AP
আখাউড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী
২৯ নভেম্বর, ১৯৭১৷ আখাউড়ায় অস্ত্র পাহাড়া দিচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা৷ তাদের দাবি ছিল, ভারতীয় সৈন্যদের কাছ থেকে এসব অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে৷
ছবি: AP
ভারতীয় সেনাদের হামলা
২ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ যশোরে পাকিস্তানি সেনাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে ভারত ৷ এক পাকিস্তানি সেনাসদস্য রাইফেল নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছে৷ অন্য সেনারা তখন অস্ত্র তাক করে পরিখার মধ্যে রয়েছে৷
ছবি: AP
ভারতীয় সেনা
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর৷ ভারতীয় সীমান্তের কাছে ডোঙ্গারপাড়ায় খোলা মাঠে মেশিনগান তাক করে রেখেছেন এক ভারতীয় সেনা৷
ছবি: AP
ডিসেম্বরেও ঢাকায় পাকিস্তানি সার্জেন্ট
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ রাজধানী ঢাকার অদূরে একটি এলাকায় একজন পাকিস্তানি সার্জেন্ট দুই সেনাকে নির্দেশনা দিচ্ছে৷
ছবি: AP
যুদ্ধবিরতি
রবিবার ১২ ডিসেম্বর. ১৯৭১৷ ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষায় আছেন বিদেশিরা৷ একটি ব্রিটিশ বিমান অবতরণ করেছে৷ ৬ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির সময় বিদেশিদের নিয়ে যাওয়ার জন্যই ঐ বিমানটি পাঠানো হয়েছিল৷
ছবি: AP
ভারতীয় ট্যাংক
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর৷ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যাংক বগুড়ার দিকে রওনা হয়েছে৷
ছবি: AP
চার রাজাকারকে হত্যার পর মুক্তিবাহিনীর প্রতিক্রিয়া
হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা চার রাজাকারকে হত্যার পর আল্লাহ’র উদ্দেশে শুকরিয়া জানাচ্ছেন মুক্তিসেনারা৷
ছবি: AP
16 ছবি1 | 16
পদযাত্রী দলের ডেপুটি লিডার-০২ ছিলেন কামরুল আমান৷ তাঁর বাবা চাকুরি করতেন ঢাকেশ্বরী কটন মিলে৷ সে সুবাদে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে৷ ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন তোলারাম কলেজের ছাত্র৷ নিজ আগ্রহেই যুক্ত ছিলেন ওই সময়কার আন্দোলন সংগ্রামগুলোতে৷ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা আর বর্বরতা কামরুল আমান দেখেছেন খুব কাছ থেকে৷ আলাপচারিতার শুরুটা তাই গণহত্যা দিয়েই৷
তাঁর ভাষায়, ‘২৫ মার্চ, ১৯৭১৷ রাতের মধ্যেই ঢাকার গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে৷ কারফিউ চলছিল৷ তা শিথিল হতেই কাউকে কিছু না জানিয়েই রওনা হই ঢাকার দিকে৷ ডেমরার ডিএনডি মাটির বাঁধ৷ ওই পথেই শত শত লোক পালিয়ে আসছে ঢাকা থেকে৷ সবার মুখে লোক মরার খবর৷ মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে ৭-৮ জনের গলাকাটা লাশ৷ তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানে না৷ দেহ তখনও কই মাছের মতো নড়ছিল৷ এ যেন জিন্দা লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কব্জি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে৷ কার লাশ এটা? কেউ জানে না৷ খবর পেয়ে ছুটে যাই শাঁখারি পট্টিতে৷ আহারে! কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পোড়াইছে৷ কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারি পট্টির প্রবেশমুখ৷ সেটি বন্ধ করে আগুন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা৷ সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ কয়েকটি বাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছিল৷ একটি বাড়িতে পা রাখতেই গা শিউরে ওঠে৷ মানুষ পুড়ে তার চর্বি গলে মেঝেতে পড়ে আছে৷ তাতে পড়েছে আমার পা৷ এর চেয়ে ভয়াবহ আর মর্মান্তিক দৃশ্য আর কী হতে পারে!’
পাকিস্তান আর্মিরা নারায়ণগঞ্জ দখলে নিলে কামরুল ট্রেনিংয়ের জন্য কুমিল্লার রামকৃষ্ণপুর হয়ে চলে আসেন আগরতলায়, গোকুলনগর রিক্রুটিং ক্যাম্পে৷ ট্রেনিং শুরুর দেরি দেখে পরে চলে যান কলকাতায়৷
ওখানে সিপিএম অফিসে তার সঙ্গে পরিচয় হয় দেবেন সিকদারের৷ তার পরামর্শেই তিনি কাজ শুরু করেন যশোরের বেনাপোলে, বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরে৷ সীমান্ত এলাকার শরণার্থীদের সেবা ও সাহায্য করাই ছিল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজ৷ পরে তাদের মাধ্যমেই তিনি রিক্রুট হন ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলটিতে৷
সে ইতিহাস শুনি কামরুল আমানের মুখে৷ তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে পদযাত্রাটি এগিয়ে নেওয়ার সার্বিক পরিকল্পনায় যুক্ত হয় ‘অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডল’ নামের একটি সংগঠন৷ এটি গঠিত হয় মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী আটটি সংগঠনের সম্মিলনে৷ এদের সহযোগিতা করে গান্ধী পিচ ফাউন্ডেশন৷ পদযাত্রার মূল উদ্যোক্তা ভারতের অহিংস সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং আহ্বায়ক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দীনেশ চন্দ্র মুখার্জি৷
আমাদের ৩৪ জন বাছাইয়ে কাজ করেন যশোরের শাহ হাদিউজ্জামান, মরহুম এম রওশন আলী, বিমল রায় চৌধুরী ও শেখ মোখলেসুর রহমান খোকন৷ বনগ্রাম থেকে ১৪ অক্টোবর, ১৯৭১-এ আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে পৌঁছি৷ সেখানে ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরের মাটি ছুঁয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য শপথ নিই৷ বাকি চারজন পরে এসে যোগ দেন মুর্শিদাবাদে৷’
তিনি বলেন- ‘আগের দিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে র্যালিসহ একটি জনসভায় আমাদের অভিনন্দন জানানো হয়৷ রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গান্ধীপন্থি লেখক মৌলভি রেজাইল৷ বক্তব্য দেন মোহাম্মদ একরামুল, শ্রী দেশাই, আবদুল খালেক প্রমুখ৷ পরদিনই বাংলাদেশের পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ আমরা বহরমপুর থেকে গোকর্ণর দিকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি৷ বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার আগাম কর্মসূচি ইংরেজি ও হিন্দিতে গণমাধ্যমগুলোতে জানিয়ে দিতেন উদ্যোক্তারা৷ প্রায় দেড় মাস দলটিকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হতো৷ বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হতো জনসভার৷ উঠোন বৈঠকও হয় অগণিত৷ দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে চলে মতবিনিময়৷ এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তিনিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, আসানসোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, চিত্তরঞ্জন ও বিহার, পাটনা, লখনৌ, আগ্রাসহ প্রভৃতি জায়গায় পদযাত্রা করে৷
৩০ জানুয়ারি ছিল গান্ধী প্রয়াণ দিবস৷ ওইদিন দিল্লির রাজঘাট গান্ধী সমাধিতে পদযাত্রাটি শেষ হবে- এমনটিই ছিল পরিকল্পনা৷ কিন্তু তার আগেই স্বাধীনতা লাভ করায় ১৭ ডিসেম্বর ভারতের উত্তরপ্রদেশে এসে পদযাত্রাটি শেষ হয়৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যদি আরও সময় লাগতো তাহলে এই দলটিকেই প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংগে পাঠানোর চিন্তা ছিল৷
এ নিয়ে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
কামরুল আমান বলেন, ‘পদযাত্রায় স্থানীয় জনগণই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করত৷ পাটনাতে যখন গেলাম ওখানকার চিফ আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন৷ পল্টনের মতো বিশাল একটি মাঠে মিটিং হয়৷ বক্তৃতায় বললাম নিজের অভিজ্ঞতার কথা, গলা কাটা লাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশের মাটিচাপা, পুরান ঢাকার মানুষ পোড়ানো, মানুষের চর্বি গলানো মেঝেতে নিজের পায়ের ছাপ৷ লিডার খালেক বললেন রাজশাহীতে গণহত্যার বর্বরতার কথা৷ বর্ণনাগুলো যখন হিন্দিতে অনুবাদ করে বলা হচ্ছিল তখনই দেখলাম ওখানকার মানুষ হু হু করে কাঁদছে৷
শরীরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা কেবল মনে নয়, শরীরেও বহন করে চলেছেন যুদ্ধের স্মৃতি৷ কারো মনে হতাশা কাজ করলেও দেশ স্বাধীন হয়েছে, বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, এটাই তাদের সান্ত্বনা৷ চলুন শুনি একাত্তরের কয়েকজন যুদ্ধাহতের গল্প৷
ছবি: AFP
মানচিত্র ও পতাকাতেই তৃপ্তি
কুমিল্লার সৈয়দ জানে আলম সাচন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন চার নম্বর ও দুই নম্বর সেক্টরে। রাঙাউটি সীমান্তে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তার বাম হাতে আঘাত হানে, বিচ্যূত হয়ে যায় মেরুদণ্ডের হাড়। সেসময় ভারতে চিকিৎসা নিলেও সুস্থ হননি পুরোপুরি৷ দুটো লাঠি বা হুইলচেয়ার ছাড়া তিনি চলতে পারেন না। তবে এ নিয়ে তার আফসোস নেই। লাল-সবুজের পতাকা ও মানচিত্রই তাকে তৃপ্তি দেয়৷
ছবি: Salek Khokon
‘কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি’
রাজশাহীর মো. বাকি মোল্লা যুদ্ধ করেন সাত নম্বর সেক্টরে। জুন মাসে বাসুদেবপুরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে জানতে পারেন অন্তঃসত্তা স্ত্রী মারা গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাওয়া নিয়ে কথা শুনতে হয় বলে দুঃখ করে বলেন, ‘‘কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি। কিন্তু আজ যদি এক কোটি টাকা দিয়ে আপনার একটা পা কেটে ফেলতে চাই, আপনি কী দেবেন?’’
ছবি: Salek Khokon
‘‘দেশের জন্য রক্ত দিতে পেরে গর্বিত’’
বরিশালের সার্জেন্ট মোহাম্মদ কাঞ্চন সিকদার একাত্তরে সেনাবাহিনীর সিপাহী ছিলেন। যুদ্ধ করেছেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ ১৯৭১-এর ২২ অক্টোবর গৌরনদীর বাটাজোরে পাকিস্তানি ক্যাম্প দখলের সময় ব্রাশফায়ারে তার বাম পা মারাত্মক জখম হওয়ায় হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়। এখন হুইল চেয়ার ও কৃত্রিম পায়ের সহায়তায় চলাফেরা করেন। দেশের জন্য রক্ত দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় গর্বিতএই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
ছবি: Salek Khokon
‘দেশ পাইসি, আর দুঃখ নাই’
গোপালগঞ্জের আলিউজ্জামান যুদ্ধ করেছেন আট নম্বর সেক্টরে, হেমায়েত বাহিনীর অধীনে৷ ঘাগোরে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তার মাথায় লাগায় ডান চোখ হারাতে হয়। তার ভাষায়, ‘‘গাড়ি পামু, টাকা পামু, বাড়ি পামু- এমন চিন্তা তো একাত্তরে ছিল না। চিন্তা ছিল একটাই, পাকিস্তানিগো এই দেশ থেকে তাড়াইতে হবে। দেশরে স্বাধীন করতে হবে। সেই দেশ পাইসি। আমার আর কোনো দুঃখ বা কষ্ট নাই ভাই।’’
ছবি: Salek Khokon
মনের চোখে দেশকে দেখা
ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে ডেমরা, রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সাতারকুল অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় কায়েদপাড়া ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে ডান হাত কনুইয়ের নীচ থেকে উড়ে যায়। মাইনের গ্যাস ঢুকে চোখ দুটিও নষ্ট হয়ে যায়। নিজ চোখে দেখতে পারেননি স্বাধীনতার লাল সূর্যটা। তবুও আফসোস নেই, তিনি দেশকে দেখেন মনের চোখ দিয়ে।
ছবি: Salek Khokon
‘একাত্তরডা মনে পইড়া যায়’
সুনামগঞ্জের মান্নান আলী ট্রেনিং নেন ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে। যুদ্ধ করেছেন পাঁচ নম্বর সেক্টরে৷ ৭ ডিসেম্বর ছাতক থানা অপারেশনে সুরমা নদীর তীরে পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় ডান পায়ের কিছু অংশ। তবে স্বাধীন দেশই তার আনন্দ৷ ‘‘আমি প্রতিষ্ঠিত হই বা না হই, দেশ তো প্রতিষ্ঠিত হইছে, এটাই বড় পাওয়া। সবচেয়ে ভালcf লাগে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর আসলে। তখন একাত্তরডা মনে পইড়া যায়।’’
ছবি: Salek Khokon
‘দেশ ভাল থাকলেই আমরা ভালো থাকি’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জসিম উদ্দিন শুরুতে চার নম্বর সেক্টরে গেরিলা যুদ্ধ, পরে তিন নম্বর সেক্টরে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ২৯ নভেম্বর রামরাইল ব্রিজ অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া গুলি লাগে ডান হাতের কবজিতে৷ এখনও শরীরে ব্যথা অনুভব করেন। তবে স্বাধীনতা তাকে ভুলিয়ে দেয় সব দুঃখ। তার ভাষায়, ‘‘মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা দিসে দেশের জন্য, কিছু পাওয়ার জন্য না। দেশ ভাল থাকলেই আমরা ভালো থাকি।’’
ছবি: Salek Khokon
‘‘সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি’’
নেত্রকোণার মো. ওসমান গণি তালুকদার যুদ্ধ করেন এগারো নম্বর সেক্টরে। ৬ ডিসেম্বর বিজয়পুর ক্যাম্প অপারেশনের সময় মাইনের আঘাতে তার ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হয় বাম পা ও ডান হাতের আঙুল। তার ভাষায়, ‘‘সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি, সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়। আমাদের জন্য এ সরকার অনেক করছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তো রাষ্ট্রীয় কোনো প্রটোকল নাই। এটাই খারাপ লাগে।’’
ছবি: Salek Khokon
‘দায়িত্ব ছিল, করে দিছি’
ময়মনসিংহের মোহাম্মদ তারা মিয়া দুই নম্বর সেক্টর এবং ‘বিচ্ছু বাহিনী’তে গোয়েন্দার কাজও করতেন। ১২ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে তারাবোতে আর্টিলারির আঘাতে জখম হয় মেরুদণ্ড। ধীরে ধীরে ক্ষত বাড়তে থাকায় হুইল চেয়ারই একমাত্র ভরসা। তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীন হইয়া দেশটা তো একা চলছে, আমি চলছি অন্যের সাহায্যে। রক্ত তো দিতেই হইবো। রক্ত ছাড়া কোনো দেশ স্বাধীন হয় নাই। রক্ত দেওয়ার সুযোগটা আমরা পাইছিলাম। দায়িত্ব ছিল, করে দিছি।’’
ছবি: Salek Khokon
‘এই মাটিতে আমাদের রক্তের গন্ধ আছে’
খুলনার লিবিও কীর্ত্তনিয়া যুদ্ধ করেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর খুলনা নিউ মার্কেট এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের রকেট শেলের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার ডান পা। বর্তমানে এ মুক্তিযোদ্ধার জীবন কাটছে শারীরিক নানা সমস্যায়। তবুও দেশ নিয়ে তৃপ্ত তিনি। বললেন, ‘‘এই মাটিতে আমাদের রক্তের গন্ধ আছে, এটা ভাবলেই মন ভরে যায়। দেশ পেয়েছি এটাই বড় কথা।’’
ছবি: Salek Khokon
10 ছবি1 | 10
লখনৌ ইউনিভার্সিটিতে আমাদের বক্তব্য শুনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কণ্ঠ মিলায় ছাত্রছাত্রীরা৷ মুজিবের মুক্তিতে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারও করে তারা৷ এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় জনগণ একাট্টা ছিল৷ তাদের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমর্থনটা ছিল আমাদের জন্য অনেক বড় শক্তি৷
আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদটা মানুষের মনের ভেতরই গাঁথা থাকে৷ কে কোন দেশের, সেটা বড় কথা নয়৷ মানুষের মুক্তির, মানুষের স্বাধীনতার জন্য মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়৷ একাত্তরে এটাই প্রমাণ করেছিল ভারতীয় জনসাধারণ৷’
ভিন্ন অভিজ্ঞতাও ছিল কামরুলদের৷ তার ভাষায়- মুর্শিদাবাদে এক উঠোন বৈঠকে ভারতীয় একদল মুসলমান আমাদের ওপর বেশ রাগান্বিত হয়ে বলেন- ‘পাকিস্তান ছিল একটা মুসলমানের দেশ৷ তোমরা সেটা ভেঙে দিতেছ৷ এক কোটি লোক আইসা আমগো ওপর খাইতাছ৷ আমগো ভারতও ধ্বংস করবা তোমরা৷ যুদ্ধ তোমাদের, কিন্তু সৈন্য মরে আমগো৷ এই যুদ্ধ আমাদের দরকার নাই৷ বিদায় হও তোমরা৷'
আমরা ধৈর্য হারাই না৷ পাকিস্তানে মুসলমান যে মুসলমানকে তেইশ বছরে ধরে কীভাবে নির্যাতন করেছে, মুসলমান মুসলমানের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কীভাবে পদদলিত করেছে৷ এটা আমার বোঝানোর চেষ্টা করি৷ বলি, মুসলমান ব্যাপার না, আসল বিষয় শোষণ আর নির্যাতনের৷ শুধু কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই ছাড়া ভারতের মুসলমান গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওই সময় বেশ কনফিউজড ছিল৷ এ ক্ষেত্রে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলটি একটি বড় অ্যাম্বাসেডরের কাজ করেছিল৷’
১৬ ডিসেম্বর৷ দেশ তখন স্বাধীন৷ ১৮ ডিসেম্বর লখনৌতে বিশাল আয়োজনে উদযাপিত হয় বিজয় দিবস৷ ভারতীয় বিমান, সেনা ও নৌবাহিনী, ক্যাডেট, স্কাউট, গার্লস গাইড ও জনসাধারণের সঙ্গে বাংলাদেশের ডেলিগেট হিসেবে জাতীয় পতাকাসহ অংশ নেয় পদযাত্রার দলটি৷ ওই অনুষ্ঠানের সংবাদ ওই সময় ভারত ও বিদেশি রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রেও ফলাও করে প্রচার করা হয়৷ ১৯ ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ দলটির যুবকরা৷
বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রা'র দলটি স্বাধীনতার জন্য ভারতে হেঁটেছিল ১৪শ মাইল৷ মুক্তিযুদ্ধটা কেন ন্যায় যুদ্ধ- সেটি ভারতীয়সহ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিল তাদের কাজ৷ পদযাত্রীদের কাছে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ৷ যেসব ভারতীয় নেতা ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছিলেন, বর্তমান সরকার তাদের এনে সম্মাননা দিয়েছে৷ এটাও ভাল উদ্যোগ৷ কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও পদযাত্রায় অংশ নেয়া ৩৮ জনকে কন্ঠযোদ্ধা বা ফুটবল যোদ্ধাদের ন্যায় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি৷ যা প্রত্যাশিত নয়৷ পাশাপাশি এ সরকারের উচিত গৌরবের এ ইতিহাসটি প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া৷
একাত্তরের বীর নারীরা
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া, চিকিৎসক ও সেবিকা হিসেবে কাজ করা ছাড়াও অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের বীর নারীরা৷ এমন কয়েকজন অসীম সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনুন৷
ছবি: privat
ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান বীরপ্রতীক
স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন সেনা কর্মকর্তা ও চিকিৎসক তৎকালীন সিতারা রহমান৷ তার বড়ভাই মেজর এটিএম হায়দার বীর উত্তম ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে নির্মমভাবে খুন হন মেজর হায়দার ৷
ছবি: privat
সিতারার যুদ্ধে যাওয়ার গল্প
জুলাই মাসে ভাই মেজর এটিএম হায়দার আগরতলা যাওয়ার জন্য তার কাছে একটি চিঠি পাঠান৷ চিঠির সঙ্গে ছিল একটি পিস্তল৷ পথে কোথাও পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়লে আত্মহত্যা করার জন্য সে পিস্তল পাঠিয়েছিলেন সিতারা রহমানের ভাই৷ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য সামরিক চাকরি উপেক্ষা করে রণাঙ্গনে হাজির ছিলেন ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান৷ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নেতৃত্ব দেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়৷
ছবি: privat
যুদ্ধাহতের চিকিৎসাসেবা
ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জে ৪০০ শয্যার বাংলাদেশ হাসপাতাল স্থাপন হলে সেখানে চিকিৎসা সেবা শুরু করেন ডা. সিতারা রহমান৷ তার সাথে যোগ দেন আরো বেশ কিছু সাহসী নারী৷ তবে বিজয় পর্যন্ত বাংলাদেশ হাসপাতালের সবকিছু দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ডা. সিতারার উপর৷ সেখানে ডা. জাফরুল্লাহ এবং ডা. মুবিন ছিলেন৷ বর্তমানে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল সেই উদ্যোগেরই ধারাবাহিকতা৷
ছবি: Dr. Sitara Rahman
কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীরপ্রতীক
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়া দুই নারী মুক্তিযোদ্ধার আরেকজন তারামন বিবি৷ মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ১১ নম্বর সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে৷ ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার তারামন বিবিকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন৷ কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি৷ ময়মনসিংহের একজন গবেষক প্রথম তাকে খুঁজে বের করেন৷
ছবি: Fazle Elahi Shwopon
ছদ্মবেশী তারামন বিবি
সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও শত্রুপক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন তারামন৷ সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন, চুল এলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে হাসি-কান্নার অভিনয় করেছেন৷ কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো চলাফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী৷
ছবি: DW
যুদ্ধজয়ের আনন্দময় মুহূর্তে তারামন
‘‘একদিন দুপুরের দিকে একটা জঙ্গি বিমান এল৷ এই বিমানটা আগের বিমানগুলোর মতো নয়৷ এটা থেকে কোন বোমা ফেলা হলো না৷ শুধু একটা চক্কর দিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আমরা গুলি ছুঁড়তে চাই৷ কিন্তু বাধা দেন আজিজ মাস্টার৷ ক্যাম্প থেকে আমাদের জানানো হলো, তাদের কাছে খবর এসেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে৷ পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে৷ আনন্দে আমার দুচোখ দিয়ে পানি আসতে শুরু করল৷ ক্যাম্পে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে জয় বাংলা৷’’
ছবি: Fazle Elahi Shwopon
ফোরকান বেগমের সশস্ত্র প্যারেড
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন ফোরকান বেগম৷ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন তিনি৷ ঢাকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন স্বাধিকারের বার্তা নিয়ে৷ ঢাকায় গোয়েন্দাগিরি ও গেরিলা হামলার জন্য বিশেষ বাহিনী তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন৷ আত্মঘাতী হামলার জন্যও কিছু ছেলে-মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন৷
ছবি: Forkan Begum
ফোরকানের ছবি নিয়ে খুঁজতো পাক বাহিনী
লেম্বুছড়া শিবিরে বাছাই করা আট-দশ জন সাহসী নারীকে নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন ফোরকান বেগম৷ সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যদেরকে দেশের ভেতরে গেরিলা হামলার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন৷ এক সপ্তাহ পরেই তিনি জানান, ফোরকানের ছবি পকেটে নিয়ে তাকে খুঁজছে পাক সেনারা৷ তাই ঢাকায় না পাঠিয়ে ফোরকানের কাছ থেকে দেশের ভেতরে তার প্রশিক্ষিত সঙ্গীদের ঠিকানা নিয়ে তাদেরকে গেরিলা অভিযানে কাজে লাগানো হয়৷
ছবি: Forkan Begum
নার্সিং স্কোয়াডে তাহরীমা
ফোরকান বেগমের কাজে উৎসাহিত হয়ে আগরতলার হাপানিয়া শিবির থেকে অন্য ১৩জন মেয়েসহ তাহরীমা চৌধুরী যোগ দেন জিবি এবং বিএম হাসপাতালের নার্সিং স্কোয়াডে৷ সেখানে তারা সেবিকা হিসেবে কাজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ ওষুধের মাপ-জোখ, কীভাবে ড্রেসিং করতে হয়, কীভাবে সেলাই করতে হয়, হাড় ভেঙে গেলে কীভাবে প্লাস্টার করতে হয় এসব কিছু শেখানো হয়৷ তখন তার বয়স কেবল ১৪ বছর৷
ছবি: Md Alauddin
রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা
হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত দেহের ছবি এখনও ভেসে ওঠে তাহরীমার চোখে৷ নিজের অভিজ্ঞতা ডয়চে ভেলেকে জানান এভাবে, ‘‘এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি যাদের হাত নেই, চোখ নেই কিংবা পেটের ভুড়ি বের হয়ে গেছে৷ সেখানকার যে আহাজারি, চিৎকার আর কষ্টগুলো দেখেছিলাম এখনও সেগুলো যেন আমার চোখের সামনে ভাসে৷’’
ছবি: Md Alauddin
কৃষক পরিবারের যোদ্ধা শেফালী রানী
গ্রামের এক কৃষক পরিবারে বড় হলেও নিজের দৃঢ় মনোবলের কারণে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মহাবিদ্যালয়ে পা দেন ঝালকাঠির সাহসী নারী শেফালী রানী৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর কলকাতা গিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয় খুঁজে বের করেন তিনি৷ তারপর মতিয়া চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন গোবরা শিবিরে৷
ছবি: Sukanta
লড়াইয়ে সাথী দুই বোন আলো ও মধুমিতা
চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই বোন আলো রানী ও মধুমিতা বৈদ্য৷ তাদের ভাইও মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়ি চালাতেন৷ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার সময়ের অনুভূতি জানাতে গিয়ে আলো রানী বলেন, ‘‘বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে আমরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে গিয়ে, তাঁদের দেহ থেকে গুলি বের করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি দেখতাম যে খুব কষ্ট হতো আমাদের৷ সেই অবস্থায় মনে হতো যে, হাসপাতালে কাজ না করে অস্ত্র নিয়ে কাজ করাটাই ভালো ছিল৷’’
ছবি: DW
গেরিলা মিনারা
কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত মিনারা বেগম৷ যুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন মিনারা ও তাঁর সঙ্গীরা৷ আগরতলা যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিতে গিয়ে ভুল করে ঢুকে পড়েন এলাকার শান্তিবাহিনীর প্রধানের বাড়িতে৷ পরে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার দুই ছেলেকেই মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে রাজি করান মিনারা৷
ছবি: S.Siddiquee
কৌশলে রক্ষা
সেই অভিজ্ঞতা ডয়চে ভেলেকে বলেন মিনারা বেগম, ‘‘আমি এবং ফোরকান বেগম আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি৷ আমরা নরসিংদীর কাছে পাক সেনাদের সামনে পড়ে যাই৷ কিছুক্ষণ পরেই সেখানে গ্রাম পোড়ানোর জন্য যাচ্ছিল পাক সেনারা৷ এর মধ্যেই সেখানে অনেক কৌশল করে রক্ষা পেয়ে যাই৷ সেসময়ও আমাদের ব্যাগে ছোট আকারের গ্রেনেড ছিল৷ আমরা তো আগেই অস্ত্র চালনা শিখেছিলাম৷’’
ছবি: Minara Begum
নয় নম্বর সেক্টর নারী মুক্তিবাহিনীর প্রধান রমা দাস
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স পড়ছিলেন রমা দাস৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই তাঁর লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়৷ ফলে প্রায় প্রতিদিনই কলাভবন, কার্জন হল, শহীদ মিনার চত্বরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বরের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন তিনি৷ ফেব্রুয়ারি ও মাচের্র দিনগুলোতে তাঁরা দলবেঁধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতেন৷ এছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও দেয়াল লিখনে অংশ নিতেন৷
ছবি: Pinaki Das
অস্ত্র প্রশিক্ষণ
মাদ্রা প্রশিক্ষণ শিবিরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রমা দাস৷ মেজর জলিল তাকে নয় নম্বর সেক্টরের নারী মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেন৷ দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কথিকা পাঠও করতেন রমা দাস৷ দেশ স্বাধীন হলেও খুলনায় মেজর জলিলের নেতৃত্বে গঠিত শিবিরে থেকে বিভিন্ন কাজ করেছেন তিনি৷
ছবি: Dr. Sitara Rahman
নারী মুক্তিফৌজের সংগঠক নিবেদিতা দাস
সিলেটের বীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক নিবেদিতা দাস৷ পাঁচ নম্বর সেক্টরে নারী মুক্তি ফৌজের সম্পাদিকা ছিলেন তিনি৷ যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের চেলা শিবিরে যান নিবেদিতা দাস৷ কিছুদিন পর জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হক এবং আওয়ামী লীগ নেতা হেমেন্দ্র দাস পুরকায়স্থের সহায়তায় সিলেটের নারীদের নিয়ে নারী মুক্তিফৌজ গঠন করেন তাঁরা৷ এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন প্রীতিলতা দাস পুরকায়স্থ এবং সম্পাদিকা ছিলেন নিবেদিতা দাস৷
ছবি: Rupak Das
মেলাঘর হাসপাতালের দায়িত্বে কাজী হেলেন
১৯৫৪ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জে জন্ম কাজী হেলেনের৷ আগরতলার রাজবাড়িতে কর্নেল রউফ-এর সহায়তায় তিন মাসের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন কাজী হেলেন৷ এরপর তাঁকে জিবি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করা হয়৷ পরে মেলাঘর হাসপাতালের দায়িত্ব পান তিনি৷
ছবি: DW/AHM Abdul Hai
রাজশাহীর গর্ব মুক্তিযোদ্ধা সাবিত্রী বিশ্বাস
বাবার উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ শুরু করেন সাবিত্রী বিশ্বাস৷ আগরতলায় হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমার বাবা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর প্রশিক্ষণ শিবিরের খোঁজ পেয়ে আমাকে নিয়ে সেখানে গেলেন৷ বাবা বললেন, দেশের জন্য কিছু করো মা, না হলে তো হবে না৷ তুমি কি শুধু শুধু বসে থাকবে একা? তখন আমি সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে চিকিৎসা সেবা শুরু করি৷’’
ছবি: Rabiul Anowar Tomy,
‘মুক্তি আপা’ খালেদা খানম
শরীয়তপুরের সাহসী নারী খালেদা খানম৷ তিনি এতোটাই সক্রিয়ভাবে গ্রামে গ্রামে কাজ করতেন যে, শরীয়তপুর অঞ্চলে তাঁকে সবাই ‘মুক্তি আপা’ নামেই চিনতো৷ ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে অস্ত্র খালাসের খবর পেয়ে মিছিল নিয়ে খালেদা ও তার সঙ্গীরা তা ঠেকানোর জন্য রওয়ানা হন৷ কিন্তু কাঁদানে গ্যাস ও গুলির মুখে পড়ে তারা আর এগোতে পারেননি৷ পরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন অস্ত্র চালনা ও চিকিৎসার ট্রেনিং৷
ছবি: Nur-A-Ashraful Alam
চিকিৎসার পাশাপাশি যুদ্ধ
ডা. লুৎফুন নেসা বলেন, ‘‘মরিচা হাউসে কাঠের পিস্তল দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতাম৷ সেই নমুনা অস্ত্রের বদলে যে একদিন সত্যি আমাদের আসল বন্দুক হাতে নিয়ে লড়তে হবে তা ধারণা করাও কঠিন ছিল৷ তবে পরে যখন কলকাতায় গিয়ে আসল বন্দুক হাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তখন মনে হয়েছে ওরা আমাদের এভাবে মারছে, আমরাও প্রয়োজনে তাদেরকে এই অস্ত্র দিয়ে মারবো৷ চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা তো করবোই, কিন্তু নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধও আমরা করবো৷’’
ছবি: privat
মুন্সীগঞ্জের বীর ডা. লুৎফুন নেসা
১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন লুৎফুন নেসা৷ একইসাথে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন তিনি৷ সেই হিসেবে চলমান স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি৷ এছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে ইন্দিরা রোডের মরিচা হাউসে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন লুৎফুন নেসা৷
ছবি: privat
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ডা. বদরুন নাহার
রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ একাধিকবার তার নৌকা পাক সেনারা আটকও করে৷ তবু নানা কৌশলে তিনি রক্ষা পান পাক হানাদারদের হাত থেকে৷
ছবি: DW
মৌলভীবাজারের নারী নেত্রী রুমা চক্রবর্তী
একাত্তর সালে স্কুল ছাত্রী হলেও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন রুমা চক্রবর্তী৷ এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করেন এই সাহসী নারী৷ মে মাস পর্যন্ত তিনি ঢাকায় থেকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন৷ পরবর্তীতে ভারতের বনগাঁয় চল্লিশ শয্যার অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে অন্যদের সাথে যোগ দেন রুমা চক্রবর্তী এবং তার বোন৷