১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী৷ চেয়েছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে৷ কিন্তু পারেনি৷ সেই রাতেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালি৷
বিজ্ঞাপন
‘অপারেশন সার্চলাইট' নামে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে যে বাঙালি নিধন শুরু হয়, তা চলে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত৷ বাঙালির প্রতিরোধ সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস৷ এই দোসরদের নেতৃত্ব দেয় জামায়াতে ইসলামী৷ আর অনেক চড়াই উত্রাই পেরিয়ে এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে স্বাধীন বাংলাদেশে৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
বীরাঙ্গনা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাই আমি আশাহত নই৷ আমি জানি বাংলাদেশ পারবে৷ পারবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে৷ যে বিচার শুরু হয়েছে তা কেউ আটকাতে পারবেনা৷'' তিনি আরও বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর অনেক হতাশার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে৷ জাতীয় পতাকা খামচে ধরেছিল পুরনো শকুন৷ রাজাকারের গাড়িতে উঠেছিল জাতীয় পতাকা৷ কিন্তু সেই হতাশার দিন শেষ হয়ে এসেছে৷ কলঙ্ক মুক্তির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ৷ যা আশার আলো দেখায়৷''
ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী আরও বলেন, ‘‘তবে এখনো বাধা আছে৷ রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পথে বাধা আছে৷ কিন্তু এই বাধা টিকবে না৷ টিকবে না তাদের আস্ফালন৷ কারণ তরুণরা জেগেছে৷ দেশে এখন নতুন এক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে৷ যারাই বাধা দেবে তারাই বিতাড়িত হবে৷ যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তাদের সংগঠন জামায়াতের বিচারও শুরু হচ্ছে৷ বাংলাদেশ আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করবে৷''
শহিদ মধুসূদন দে-র ছেলে অরুণ দে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে অনেক সংকট আছে সত্য; কিন্তু জাতির সবচেয়ে বড় দাবি যুদ্ধাপরাধের বিচার এগিয়ে যাচ্ছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে এটি বড় আশার কথা৷ জাতির কলঙ্কমোচনের এই কাজ কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না৷ যদি কেউ চেষ্টাও করে তারা ব্যর্থ হবে৷''