শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার দেশের সব স্বার্থ বিসর্জন দিচ্ছে৷ এখন নতজানু পররাষ্ট্রনীতি না, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়েও মানুষ শঙ্কায় আছে বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে : ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে শুধু ভারত লাভবান হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন৷ আপনি কি মনে করেন?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: এটা তো আসলে মনে করার বিষয় না, এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়৷ এটা সবার কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে৷ দুই দেশের সম্পর্ক যেখানে হওয়া উচিৎ ছিল পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান এবং সবার স্বার্থ রক্ষা কোরে, সে সম্পর্কতো হচ্ছে না৷ এটা তো দিনের আলোর মতো পরিস্কার৷ আমাদের যে মূল দাবি তার কোনোটাই পাওয়া যাচ্ছে না৷ অথচ আমাদের তরফ থেকে সবকিছু দেয়া হচ্ছে৷ এটা এখন সর্বজনবিদিত৷ সর্বশেষ সফরে বাংলাদেশের কোন স্বার্থই রক্ষা হয়নি৷ ভারতের স্বার্থ তারা তো চাইবে? কিন্তু আমাদের স্বার্থ কে দেখবে?
‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি একেবারেই নতজানু অবস্থায় চলে গেছে’
তিস্তা নিয়ে কি বাংলাদেশের আর কোন আশা আছে?
সরকারের সঙ্গে ভারতের যে আলাপ আলোচনা হচ্ছে সেখানে তো আশার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷ তিস্তায় পানি না পাওয়ার কারণে ওই অঞ্চলে চাষাবাদ বা জীববৈচিত্র্য যেভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সেটার সমাধান না করে উল্টো আমাদের নদী থেকে পানি দেয়া হচ্ছে৷ এ থেকে মনে হয়না যে, আমাদের হাতে আর কিছু আছে৷
নাগরিকপঞ্জি, মোদি আশ্বাস দিলেও তার সরকারের মন্ত্রীরা নানা ধরনের হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন? এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু আছে কি-না?
নিশ্চয়ই উদ্বেগ আছে৷ সরকারি দলের একজন মন্ত্রী যখন এসব কথা বলেন তখন তো আপনাকে ভাবতে হবে৷ তাছাড়া দুই দেশের যে যৌথ বিবৃতি সেখানে তো এসব নিয়ে কিছুর উল্লেখ নেই৷ এটাতো যৌথ বিবৃতিতে উঠে আসার কথা ছিল৷ এটাইতো এখন বড় প্রশ্ন৷ বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন কিছু বিবৃতিতে আসেনি৷ অথচ তাদের স্বার্থের বিষয়টি পরিস্কারভাবে তুলে এনেছে৷ এটা এখন পরিস্কার যে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি একেবারেই নতজানু অবস্থায় চলে গেছে৷
নানা ধরনের আশ্বাসের পরও সীমান্ত হত্যা শূণ্যে আসছে না৷ এখনও সীমান্তে মানুষ মারা যাচ্ছেন৷ এটা কেন বন্ধ হচ্ছে না?
দেখেন এখানেও যৌথ বিবৃতিতে এটা নিয়ে কিছুই বলা হয়নি৷ এ নিয়ে কোন ধরনের টাইমফ্রেমও তৈরি হয়নি৷
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘটতি তো বেড়েই চলছে৷ এই বাণিজ্য অসমতা কি দূর করা সম্ভব?
এটার জন্য তো রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে৷ তা না হলেতো এটার সমাধান হবে না৷ এ কারণেই এর কোন সমাধান হচ্ছে না৷
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
12 ছবি1 | 12
বাংলাদেশ কী তাহলে নতি স্বীকার করছে বলে আপনি মনে করেন?
এটা তো বাংলাদেশের সবারই ধারণা৷ দেশের মানুষ মনে করেন, সরকার শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশের সব স্বার্থ যেভাবে বিসর্জন দিচ্ছে তাতেতো নতি স্বীকারের বিষয় না, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিষয়টা এখানে চলে আসে৷ দেশের মানুষের কাছেতো এটা বড় ধরণের শঙ্কা৷
বাংলাদেশের কূটনীতি কি তাহলে ব্যর্থ?
কূটনীতিতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার৷ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যদি দেশের পক্ষে না থাকে, তাহলে কূটনীতিকরা কি করবেন? আগে তো আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ তারপর কূটনীতিকরা কাজ করবেন৷
দেশে কি জাতীয় ঐকমত্যের অভাব রয়েছে?
জাতীয় ঐক্যমত্যতো জাতির পক্ষেই আছে৷ যেখানে একটা অনির্বাচিত সরকার থাকে সেখানেতো তারা জনগনের মতের পক্ষে থাকে না৷ তারাতো জাতির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার গঠন করেছে৷
চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য নীতি বজায় রেখে চলতে গিয়ে কি বাংলাদেশকে এই ধরনের ছাড় দিতে হচ্ছে?
যে দেশের কথাই বলেন, দিন শেষে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার তা না থাকলে কোনো সিদ্ধান্তই আপনি পক্ষে পাবেন না৷ আপনার সদিচ্ছা থাকলে আপনি যে চুক্তিই করেন সেখানে এর প্রতিফলন থাকবে৷ কোনো দেশই নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না৷ বাংলাদেশেরও উচিৎ না৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷