স্বামীর হাতে খুন ৭৯৪ নারী
৩ নভেম্বর ২০১৯চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে সারাদেশে ১৫২ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন৷ আগের বছর ১২ মাসে এই সংখ্যা ছিলো ১৯৩ জন৷ ২১৩ জন খুন হয়েছেন ২০১৭ সালে৷ আর ২০১৬ সালে ১৯১ জন নারী স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন৷ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)৷ তারা বলছে বাস্তবে সংখ্যাটি আরো বেশি হতে পারে৷
এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মামলা করা হয় না৷ ২০১৬ সাল থেকে হিসাব করলে এখন পর্যন্ত ৭৯৪ জন নারী স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন৷ কিন্তু এই সময়ে মামলা হয়েছে মাত্র ৩৪৭টি৷ অর্থাৎ ৪৪৭টি ঘটনার মামলাই হয়নি৷
আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হত্যা মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই৷ এর নিষ্পত্তি একমাত্র আদালতের এখতিয়ার৷ তাই এইসব ক্ষেত্রে আদালত বা থানায় যেখানেই মামলা হোক তা প্রত্যাহার হয় সেটা বলা যাচ্ছে না৷ আর হত্যা মামলা আপোশযোগ্যও নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘যেটা ঘটে তাহলো, অনেক সময়ই অপরাধীরা থাকে শক্তিশালী৷ তারা প্রভাব বিস্তার করে, শক্তি প্রয়োগ করে মামলা করতে দেয় না৷ থানায় গেলেও অনেক সময় পুলিশ মামলা নেয় না৷ পুলিশ অবৈধভাবে প্রভাবিত হয়ে এ কাজটি করে৷ এছাড়া প্রভাবশালীরা চাপের মুখে ও অর্থের বিনিময়ে আপোশ করে ফেলে৷ কিন্তু এখানে পুলিশের ভূমিকা আছে৷ তারা তা পালন করছে না৷ কারণ হত্যার মত ঘটনাতো আর চাপা থাকে না৷ তাই পুলিশ নিজেই মামলা করতে পারে৷ পুলিশ অবৈধ সুবিধা নিয়ে তা করা থেকে বিরত থাকে৷ মনে রাখতে হবে হত্যা মামলার বাদী রাষ্ট্র৷''
নারীরা সহিংসতা ও হত্যার শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে স্বামীর পাশাপাশি তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভূমিকা থাকে৷ চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে হত্যাসহ পরিবারে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৯৭ জন৷ স্বামীর হাতে ১৫২ জন নিহত হওয়ার ঘটনা বাদ দিলে ১৪৫ জন বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে ১৫ জন খুন হয়েছেন স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে৷
বাকিরা পরিবারের সদস্য এবং স্বামীর হাতে নানা ধরনের সহিংসতা শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৪২ জন৷ আগের বছরগুলোর হিসাব দেখলেও একই ধরণের চিত্র পাওয়া যায়৷
স্ত্রী হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে যৌতুকের জন্যে৷ চলতি বছর ৭০ জন নারী এই কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন ৪৪ জন৷ তিনজন আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছেন৷ এর বাইরেও বনিবনা না হওয়া, পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণেও হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কঠোর আইন থাকলেও আমাদের সমাজে ধর্মান্ধতা এখনো আছে৷ শুধু তাই নয়, সরকার তার রাজনৈতিক কারণে নারীর অধিকার নিয়ে নানা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করেছে নানা সময়ে৷ এখনো করছে৷ ফলে যৌতুকের মত বিষয়গুলো সমাজ থেকে দূর হয়নি৷ যার কারণে স্ত্রী হত্যার ঘটনা কমছে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘নারী এখন স্বাবলম্বী হচ্ছে, শিক্ষিত হচ্ছে৷ তার ভিতরে এখন স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে উঠছে৷ এটা অনেক পুরুষই মেনে নিতে পারছেন না৷ তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি৷ তারা অন্ধ চিন্তার মধ্যেই আছেন৷ তাই তারা স্বাধীন নারীকে আঘাত করেন৷''
তাঁর মতে, ‘‘স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যা বা নারীর প্রতি ঘরে সহিংসতা আমাদের পশ্চাদপদ সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোরই ফল৷ পরিবারের লোকজনও অপরাধে সহযোগী হয়৷ আমরা এর থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে মানবিক এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে পারব না৷''