আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ চলছে গোটা দেশজুড়েই। ভারতের একাধিক রাজ্য়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন চিকিৎসকেরা। জরুরি বিভাগ চালু থাকলেও বহু সরকারি হাসপাতালে আউটডোর বা বহির্বিভাগ বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে সোমবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করলেন অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সের চিকিৎসকেরা। দিল্লির সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তারা বহির্বিভাগ বন্ধ করবেন না, কিন্তু তা চালানো হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাইরে।
সোমবার একটি বিবৃতি জারি করেছেন এমসের জুনিয়র চিকিৎসকেরা। তারা জানিয়েছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়েই তারা রোগী দেখবেন। সোমবার থেকেই এই কর্মসূচি শুরু হবে। তবে তাদের সে কাজ করতে দেয়া হবে কি না, তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি দিল্লি পুলিশ।
আরজি কর হাসপাতালে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগের মধ্যরাতে কলকাতার রাস্তা দখল করলেন নারীরা। অনেক পুরুষও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'মেয়েরা রাস্তা দখল করো'
সামাজিক মাধ্যমে দেয়া হয়েছিল এই ডাক, 'মেয়েরা রাস্তা দখল করো'। সেই ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেলো। কোনো নেতা নেই, দল নেই, কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় মধ্যরাতে পথে নামলেন হাজার হাজার নারী। দাবি তুললেন, মেয়েদের নিরাপত্তার, আরজি করের চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের পিছনে থাকা অপরাধীদের শাস্তি। নিরাপত্তাহীনতার প্রতিবাদে, ন্যায় চেয়ে মধ্যরাতে মেয়েদের এরকম প্রতিবাদ সম্ভবত আগে কখনো দেখেনি কলকাতা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
যাদবপুরের রাস্তায় জনস্রোত
কলকাতার অসংখ্য সমাবেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়েছিল যাদবপুরে এইট বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে। সাড়ে এগারোটায় এই প্রতিবাদ শুরুর কথা বলা হয়েছিল। তার আগেই হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন সেখানে। শুধু দক্ষিণ নয়, কলকাতার অন্য প্রান্ত থেকেও মানুষ এখানে এসে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। সত্যিই মধ্যরাতে যাদবপুরের রাস্তা দখল করেছিলেন নারীরা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কলেজ স্ট্রিটের সমাবেশ
দীর্ঘদিন ধরে অনেক আন্দোলনের সাক্ষী কলেজ স্ট্রিট। সেখানেও নারীরা রাস্তা দখল করলেন। এখানেও হাজার হাজার মানুষ এসেছেন। প্রতিবাদ করেছেন। স্লোগান দিয়েছেন। গান গেয়েছেন। হাজারো মানুষের সমবেত দাবি ছিল, নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে কোনো নারীর প্রাণ যাতে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় হলো কলকাতার অত্যন্ত পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলির মধ্যে একটি। এই মোড়েই রয়েছে ঘোড়ায় চড়া নেতাজির একটি মূর্তি। তার সামনে, আশেপাশে ছিল ভিড়। প্রতিবাদীদের। তারা উত্তর ও পূর্ব কলকাতা থেকে মূলত এসেছিলেন এখানে। এই মোড়ের খুব কাছেই আরজি কর হাসপাতাল, যেখানে চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আরজি কর-এ দুর্বৃত্তদের হামলা
শ্যামবাজার থেকে আরজি কর-এর দিকে যাচ্ছিলেন প্রতিবাদীরা। সেসময়ই আরজি কর -এ বেশ কিছু দৃর্বৃত্ত ঢুকে পড়ে। তারা এমারজেন্সি বিভাগে গিয়ে যথেচ্ছ ভাঙচুর চালায়। এমারজেন্সি বিভাগের সিসিইউ, এইচসিসিইউ, ওষুধের স্টোররুম ভেঙে তছনছ করে দেয়। ভাঙা হয় প্রতিবাদীদের মঞ্চ। ঘটনার সময় কম পুলিশ ছিল। পরে আরো পুলিশ এসে দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
গান গেয়ে প্রতিবাদ
মেয়েদের এই ‘রাত দখল’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন মৌসুমী ভৌমিক। তিনি গাইলেন তার বিখ্যাত গান, 'আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো মধ্যরাতে যাদবপুরে মৌসুমী গাইছেন, আর সামনে উদ্বেল নারীরা। নিজেকে নিয়ে বাঁচার বাইরে এসে তারাও তো রাস্তায় নেমেছেন। প্রতিবাদ করেছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এরপর মিছিল
এইট বি বাসস্যান্ড থেকে মিছিল শুরু হলো। বেশ কিছুটা পথ হেঁটে তা আবার ফিরলো শুরুর জায়গায়। মেয়েদের হাতে ছিল পোস্টার। তাদের গলায় ছিল স্লোগান। তারা প্রতিবাদ করে গেছেন। এরপর অবশ্য প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সাধারণ মানুষের মাঝে তারকারা
একাধিক তারকা যাদবপুরের এই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। তবে তারা মিশেছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। তারা প্রতিবাদে অংশ নিতে এসেছিলেন একেবারে সাধারণ মানুষের মতোই। বাংলা টেলিভিশনের অভিনেত্রী বিদীপ্তা চক্রবর্তী, দিতিপ্রিয়া, গায়িকা ইমনরা যোগ দিয়েছিলেন এই প্রতিবাদে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মোমবাতির আলোয়
রাস্তার একপাশে রাখা একটি পোস্টার। তাতে বলা হয়েছে, 'আমরা ন্যায় চাই, সুরক্ষা চাই, নিরাপত্তা দাবি করছি'। তার সামনেই একের পর এক মোমবাতি রেখে যাচ্ছেন নারীরা। তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। শ্যামবাজার, কলেজ স্ট্রিট সর্বত্রই প্রতিবাদের, মৃত চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর হাতিয়ার ছিল এই মোমবাতি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অভূতপূর্ব প্রতিবাদ
মধ্যরাতে এমনভাবে কলকাতায় হাজার হাজার নারী রাস্তায় নেমেছেন, প্রতিবাদ করছেন, সেই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন পুরুষরা, এমন দৃশ্য আগে কখনো সম্ভবত দেখা যায়নি। আরজি কর-এর ঘটনা নিরাপত্তার দাবিতে নারীদের পথে নামিয়েছে। তারাও মনে করেছেন, এর একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তাই স্বাধীনতা দিবসের আগের মধ্যরাতে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন নারীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সাধারণ মানুষের অসাধারণ প্রতিবাদ
যারা এদিন রাস্তায় নেমেছিলেন তারা প্রায় সকলেই সাধারণ মানুষ। এই প্রতিবাদের সেভাবে কোনো নেতা ছিল না। শুধু সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে গিয়েছিল একটি পোস্টার। তাতে মেয়েদের রাতে রাস্তা দখলের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তাতেই হাজার হাজার নারী রাস্তায় নেমে এলেন। বুঝিয়ে দিলেন, চুপ করে তারা অন্যায় সইবেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাত তিনটের সময়
তখন রাত তিনটে বাজে। কিছুক্ষণ আগে প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেছে। তখনো কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় বসে আছেন নারীরা। গান, স্লোগান, বাজনা চলছে। প্রতিবাদে প্রতিবাদে এভাবেই রাত শেষ হয়ে গেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
12 ছবি1 | 12
গত সপ্তাহ থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মবিরতি পালন করছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। তবে জরুরি বিভাগে কাজ বন্ধ রাখা হয়নি। চিকিৎসকদের সংগঠনের তরফে সরকারের কাছে একটি আপিল করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য় মন্ত্রণালয়ের সামনে বহির্বিভাগ চালানোর জন্য় যা যা প্রয়োজন সেই পরিকাঠামো বানিয়ে দিতে হবে সরকারকেই।
চিকিৎসকদের চিঠি
সোমবারই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে চিঠি লিখেছেন ৭০ জন পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত চিকিৎসক। চিঠিতে তারা লিখেছেন, দ্রুত এই ঘটনার তদন্ত শেষ করতে হবে। এই ঘটনা গোটা দেশের চিকিৎসক সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে, তার জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন এই চিকিৎসকেরা। এই চিঠিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো, চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য একটি কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়নের প্রস্তাব। বস্তুত, এমন দাবি এর আগেও চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল।
এদিকে সোমবারেও কলকাতায় একাধিক কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। সোমবার রাখিবন্ধন উৎসব। সেই উৎসবকেও আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্য়বহার করার ডাক দেওয়া হয়েছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে হবে আন্দোলন। সাধারণ মানুষকেও সেই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
দিল্লির চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। আরজি করের ঘটনা তা আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে। গোটা দেশেই স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তা প্রয়োজন।