নারী মুক্তিযোদ্ধা
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২‘‘এরপর আমরা গেলাম ভিটগড়ে নিখিল দা'র বাড়িতে৷ উনি তখন ঐ অঞ্চলের যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়, তাদেরকে ওপারে পারাপার করতেন৷ তিনি আমাদেরকে একটা জায়গায় রেখে দিলেন৷ কিন্তু সেখানে অনেক বাড়ি-ঘর থাকলেও অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় আগেই সবাই চলে গেছে৷ কোন লোকজন নাই৷ সেই জনমানবশূন্য গ্রামে আমরা দু'টি মেয়ে আর নাসির মামা থাকলাম৷ আর নিখিল দা খাবার-দাবার আয়োজন করেন৷ এসময় রাতের বেলা আমরা তাঁর সাথে যুদ্ধের কাজ করতাম৷ চৌদ্দগ্রামের পাশ দিয়ে যে সিএন্ডবি রোড আগরতলা গেছে সেখানে পাক সেনারা টহল দিতো৷ যাতে করে কোন মুক্তিযোদ্ধা ওপারে পার হতে না পারে কিংবা কোন মুক্তিযোদ্ধা এপারেও না আসতে পারে৷ আমাদের কাজ ছিল পাক সেনাদের এই টহল বাহিনীটাকে নস্যাৎ করে দেওয়া৷ আমি, নিখিল, ফোরকান আমরা অনেক রাতে তাদের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতাম৷ পাক সেনাদের গাড়ির চাকা নষ্ট করে ফেলতাম৷ ফলে তারা আর টহল দিতে পারতো না৷ অনেক সময় এমন হয়েছে যে, গ্রেনেড ছুঁড়ে পানিতে ডুব দিয়ে অপেক্ষা করেছি৷ ওরা চলে গেলে তখন পানি থেকে উঠতাম৷ পায়ে জোঁক লেগে থাকতো৷ জোঁক টেনে টেনে ছুট'তাম৷ জোঁকের কামড় সহ্য করতে না পেরে আমি একদিন হিজল গাছে চড়লাম৷ পাক সেনারা গুলি ছুঁড়ছিল৷ কিন্তু ওরা তো সাধারণ উচ্চতায় গুলি করে৷ গাছের উপরেও গুলি করে না আবার পানিতেও গুলি করতো না বলে সুবিধাই হয়েছিল৷ পাক সেনারা যখন চলে গেল তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে৷ আমি গাছ থেকে নেমে আসলাম৷ তখন পথে দু'একজন লোককে দেখা গেল৷ আমি তখন লুঙ্গি পরতাম এবং মাথায় গামছা বেঁধে রাখতাম৷ কিন্তু গাছ থেকে লাফিয়ে নামার ফলে আমার লম্বা চুল বের হয়ে গেছে৷ তখন একজন বলছে, ‘আরে, এ যে মাইয়া মানুষ৷ গাছে চড়ে বসে ছিল৷' আমি চলে আসলাম৷ কিন্তু ওরা বলাবলি করছিল যে, ‘এরা মুক্তি বাহিনীর৷ মাইয়া মানুষ, পুরুষ মানুষ সব কাজ করতাছে এক সাথে'৷ এছাড়া সেখানে আশেপাশে যে ক'জন হিন্দু মহিলা ছিল তাদেরকে আমরা কলমা শিখাতাম, নামাজের শিক্ষা দিতাম এবং মুসলমান মেয়েদের মতো করে কাপড় পরা শিখাতাম৷ যাতে করে বিপদ হলে আত্মরক্ষা করতে পারে৷ রাতের বেলা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতাম৷ আর দিনের বেলায় এসব কাজ করতাম৷'' এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের সাহসী এবং কষ্টসাধ্য কর্মকাণ্ডের কথা বলছিলেন বীর নারী মিনারা বেগম৷
কিছুদিন পর আগরতলায় চলে যান মিনারা বেগম এবং তাঁর সঙ্গীরা৷ সেখানে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে মিলিত হন তাঁরা৷ সেখানে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী তৈরি করেন তাঁরা৷ এই বাহিনীর পরিচালনা পরিষদে দপ্তর সম্পাদিকা ছিলেন মিনারা বেগম৷ এই বাহিনীর নেতৃত্বে আরো যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে ফোরকান বেগম, ফরিদা মহিউদ্দীন, জাহানারা হক অন্যতম৷
এই বাহিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মিনারা বেগম জানান, ‘‘স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীর অনেকগুলো কাজ ছিল৷ তার মধ্যে সেবিকা হিসেবে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া৷ কারণ সেসময় অনেক সেবিকা প্রয়োজন ছিল৷ মুক্তিযোদ্ধারা আহত হয়ে আসতেন৷ তাঁদের চিকিৎসা সেবার জন্য এটা জরুরি ছিল৷ তাই আমরা শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে মেয়েদের সংগ্রহ করে তাদেরকে সেবিকা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দিতাম আমরা৷ এছাড়া কিছু বিপ্লবী বই সংগ্রহ করে আমরা একটি পাঠাগার গড়ে তুলি৷ এসব বই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পড়তে দিতাম৷ যাতে তাদের মনোবল ভেঙে না পড়ে৷ এছাড়া নারীদের আরেকটি দলকে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ কিছুদিন পর নয় জন মেয়েকে বাছাই করে আরো উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়৷ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় লেম্বুচড়া প্রশিক্ষণ শিবিরে৷ সেখানে আমিনুল হক ছিলেন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপক৷ আর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ভারতের সেনা বাহিনীর মেজর আর সি শর্মা ও মেজর কে বি সিং৷ ছোট-খাটো অস্ত্র চালনা তো আমরা আগেই শিখেছিলাম৷ সেখানে আমাদের শেখানো হয় কীভাবে বিমান বন্দর কিংবা বিমান ধ্বংস করতে হবে সেসব কৌশল৷ এসময় আমাদের খুব গোপন জায়গায় রাখা হতো৷ নেতৃবৃন্দ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানতো না যে আমরা কোথায় আছি৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন