ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি নতুন গবেষণা প্রকল্পে সেন্সর লাগানো বাঁধ তৈরির চেষ্টা চলেছে, যে বাঁধ বন্যা এলে নিজেই স্থানীয় বাসিন্দা ও বন্যাত্রাণ দপ্তরকে সাবধান করে দিতে পারবে, স্থানান্তরের পন্থাও বাতলে দিতে পারবে৷
বিজ্ঞাপন
শহর এলাকার সুরক্ষার জন্য যে বাঁধ তৈরি করা হয়, তা কখনো-সখনো ভেঙে গিয়ে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে৷ এভাবে বাঁধ ভাঙা রোখার কোনো পন্থা আছে কি?
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবার্ট মেইয়ের বললেন, ‘‘আমার পায়ের তলার মাটির নীচে যে ৪৮টি সেন্সর আছে, সেগুলো আমাদের একটানা জানাচ্ছে, বাঁধটা কীরকম রয়েছে আর বাঁধের ভিতরে কী চলেছে৷ এই প্রযুক্তির ফলে এই বাঁধটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ‘চালাক’ বাঁধ বলা চলে৷’’
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি গবেষণা প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে এই আন্ডারগ্রাউন্ড সেন্সরগুলি উদ্ভাবন করা হয়েছে৷ সেন্সরগুলি যে শুধু মাপজোক করে, শুধু তাই নয়; একাধিক দেশে সেই তথ্য পাঠাতে পারে৷ ইংল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত বস্টন শহর এই নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা করার একটা বিশেষ স্থান – কেননা এখানে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে নদীর জল নাটকীয়ভাবে বাড়ে ও কমে, যার ফলে বাসিন্দাদের বিপদ দেখা দিতে পারে৷
যুক্তরাজ্যের পরিবেশ সংস্থার উপকূল উপদেষ্টা মার্ক রবিনসনের মতে, ‘‘বস্টনে সাগরের পানি রোখার কিছু ভালো ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু বাঁধগুলো খুব উঁচু নয়৷ কাজেই যখন জোয়ার আসে, তখন পানি বাঁধ ছাপিয়ে যেতে পারে৷ কাজেই ওটা একটা বড় ঝুঁকি৷’’
বন্যার হাত থেকে জার্মানি যেভাবে বাঁচে
পরিখা ছাড়া জার্মানির উত্তর সাগর উপকূলে মানুষের বসতি সম্ভব ছিল না৷ বন্যার সময় এই পরিখা সেখানকার ভূমিকে শুষ্ক রাখে এবং ভয়াবহ ঝড় থেকে মানুষ ও প্রাণীকে রক্ষা করে৷
ছবি: Imago/Tillmann Pressephotos
পরিখা তৈরিতে সবার অংশগ্রহণ
পরিখা নির্মাণ এমন একটা কাজ, যেখানে সবার অংশগ্রহণ জরুরি৷ মধ্যযুগে পরিখা সংক্রান্ত দায়িত্বে যে অবহেলা করত, তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো৷ পরিখা খননে কীভাবে মানুষকে বাধ্য করা হতো অটেনডর্ফের এই ভাস্কর্যটি তার একটা প্রমাণ৷ শত শত বছর ধরে উপকূলীয় এলাকার মানুষই এ কাজ করে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/G. Franz
১৯৬২ সালে বন্যা
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির উপকূলীয় এলাকাগুলোতে, বিশেষ করে হামবুর্গে বন্যা দেখা দেয়৷ দুই দিনের বন্যায় ৬০ হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়৷ কেবল হামবুর্গেই মারা যায় ৩১৫ জন৷
ছবি: Imago/ZUMA/Keystone
শ্কফভের্ক
পূর্ব ফ্রিজিয়ায় পুরোনো ধরনের পানি সেচ পদ্ধতি৷ এর মাধ্যমে অভ্যন্তরে প্রবেশ করা পানি পাম্প করে বের করে দেয়া হয়৷ পরিখায় পানির উচ্চতা অনেক উপরে উঠে গেলেও এই ব্যবস্থা কাজ করে৷
ছবি: Imago/McPHOTO
পরিখা পরিদর্শন
পরিখা নির্মাণ সাধারণ অধিবাসীদের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় হয়ে থাকে, তারাই এ নির্মাণকাজের চেয়ারপার্সন ঠিক করেন৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘোড়ায় চড়ে নিয়মিত পরিখা পরিদর্শন করতেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা৷
ছবি: picture-alliance/kpa
শত বছর আগে পরিখা নির্মাণ
এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নর্থ ফ্রিজিয়ান ক্লানব্যুলে পরিখা নির্মাণে কাজ করছেন শ্রমিকরা, যদিও তাঁদের চেনা খুবই কষ্টকর৷
ছবি: picture-alliance/arkivi
যখন পানির তোড় আসে
২০১৩ সালের ১০ই জুনের ছবি এটি৷ স্যাক্সনি আনহাল্ট রাজ্যে এলবে নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয় ফিশবেক গ্রাম৷ যে ভাঙা বাঁধের কারণে গ্রামটি প্লাবিত হয়, সেটা পুনর্নিমাণ শুরু হয় এরপর৷
ছবি: Reuters
কখনো কখনো সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হয়
প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে সাগরে উত্তাল ঢেউ দেখা দিলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বালির বস্তা নিয়ে কাজে লেগে পড়েন৷ শত শত বালির বস্তা দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করেন তাঁরা৷
ছবি: Imago//Seeliger
7 ছবি1 | 7
সেন্সরেরওপরেই সব কিছু নির্ভর
গবেষণায় নিযুক্ত প্রযুক্তিবিদরা নানা ধরনের সেন্সর তৈরি করেছেন, যেগুলো নির্ভরযোগ্য ও সস্তা; কাজেই ভেজা মাটির বাঁধে এ ধরনের সেন্সর লাগানো যেতে পারে৷
রোবার্ট মেইয়ের দেখালেন, ‘‘এটা হল একটা সেন্সর – স্টেনলেস স্টিলের আধারে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি লাগানো আছে৷ একটা ছোট ফুটো দিয়ে জল ঢুকতে পারে৷ সেন্সরটি তখন বাঁধে জলের পরিমাণ, মাটির নীচের তাপমাত্রা ও সেন্সরগুলির নড়াচড়া ইত্যাদি নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে৷’’
ইন্টারনেট থাকলে এই সব তথ্য সঙ্গে সঙ্গে কোনো না কোনো ডিভাইসে ফলো করা যায়৷ বস্টন শহরের একটি কাফেতে বসানো টাচস্ক্রিনের মাধ্যমে জনতা দেখতে পারেন, প্রণালীটি কীভাবে কাজ করছে৷
বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তিবিদ আলেক্সান্ড্রা টপল বললেন, ‘‘এই সেন্সর ডেটা বিশ্লেষণ করে বাঁধের স্থিতিশীলতা যাচাই করা যায়৷ বাঁধে যে সব পরিবর্তন ঘটছে, তা থেকে বাঁধ ভেঙে পড়ার আগাম সতর্কতা পাওয়া যায়৷’’
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ফলে সেন্সরগুলি বাঁধ ভাঙার সম্ভাবনা যাচাই করে সংশ্লিষ্ট পরিষেবাগুলিকে সতর্কতার নির্দেশ পাঠাতে পারে – পরিষেবার কর্মীরা হয়তো বাঁধের দুর্বলতা সম্পর্কে তখনো কোনো আঁচ পাননি৷
মানুষ আর প্রকৃতির বিরোধ
05:35
সেন্সর থাকার সুবিধা
মার্ক রবিনসন জানালেন, ‘‘বর্তমানে আমরা বাঁধ পরিদর্শনের উপর নির্ভর করি৷ বছরে দু'তিনবার কর্মীরা গিয়ে সরেজমিনে বাঁধ দেখে আসেন৷ কিন্তু এই নতুন প্রযুক্তির ফলে আমরা বাস্তবিক বুঝতে পারি, বাঁধটা কীভাবে কাজ করছে, চাপের মধ্যে কীভাবে নড়াচড়া করছে, বাঁধে কোনো ফাটল দেখা দিয়েছে কিনা৷ বাঁধে কোনো কিছু ঘটলে তা আমরা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারি৷’’
সফটওয়্যার আঁকজোক করে বলে দেয়, বাঁধ ভাঙলে এলাকাটা কতো তাড়াতাড়ি ডুবে যাবে – এমনকি বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবার সেরা পন্থাটাও বাতলে দেয়৷ আলেক্সান্ড্রা টপল ব্যাখ্যা করলেন, ‘‘এই প্রণালীতে আমরা সম্ভাব্য বন্যা এলাকা মানচিত্রটা দেখতে পাই; যা থেকে আমরা বন্যাপীড়িত মানুষদের বাঁচানোর একটা প্রোগ্রাম চালাতে পারি, যা থেকে মানুষজন স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটা দেখা যায় – আপৎকালীন প্রতিক্রিয়া কর্মীরা তা ব্যবহার করে বাঁধ ভাঙার ক্ষেত্রে বন্যপীড়িতদের স্থানান্তরিত করার সেরা প্রক্রিয়াটা বেছে নিতে পারেন৷’’
নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হলে ইউরোপ ও সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রণালী ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপন্ন শহর-নগরগুলিকে সুরক্ষিত করা চলবে৷
মাছের জন্য লিফট, সিঁড়ি, ট্রেন!
কখনও ভেবে দেখেছেন নদীর যে অংশে বাঁধ দেয়া আছে সেই অংশটি মাছ পার হয় কীভাবে? ছবিঘরে থাকছে সেই উত্তর৷
লিফট
ছবিতে বাঁধের ডানপাশে যে স্থাপনাটি দেখতে পাচ্ছেন সেখানে মাছের জন্য লিফটের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এর মাধ্যমে মাছ উপর থেকে নীচে কিংবা নীচ থেকে উপরে যেতে পারে৷ জার্মানি এক কোম্পানি এই লিফট তৈরি করে ‘জার্মান ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে৷
ছবি: Baumann Hydrotec
যেভাবে কাজ করে
বাঁধের নীচে স্থাপিত একটি চেম্বারের মধ্যে থাকা কন্টেনারের মধ্যে মাছ প্রবেশ করার পর ঢাকনা বন্ধ হয়ে যায়৷ এরপর চেম্বারের মধ্যে পানি প্রবেশ করতে থাকলে কন্টেনারটি উপরের দিকে উঠতে থাকে৷ এভাবে সম্পূর্ণ উপরে উঠে যাওয়ার পর ঢাকনাটি খুলে গেলে মাছ বের হয়ে যায়৷
ছবি: Baumann Hydrotec
লিফট কেন দরকার
কারণ অনেক মাছই আছে যেগুলো ডিম পাড়তে কিংবা খাবারের সন্ধানে অনেক পথ পাড়ি দেয়৷ যেমন স্যামন মাছ ডিম পাড়ার উপযুক্ত জায়গার সন্ধানে শত শত কিলোমিটার দূরে যায়৷ এই চলার পথে মনুষ্যসৃষ্ট কোনো বাধা পেরোতে মাছের লিফট প্রয়োজন হয়৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
কিন্তু ব্যবস্থা না থাকলে?
ছবিতে যে বাঁধটি দেখতে পাচ্ছেন সেখানকার নীচের অংশে কোনো মাছ পৌঁছানোর পর যদি লিফট না পেয়ে সামনে যেতে না পারে তাহলে কী হতে পারে? উপর থেকে পানি যে বেগে পড়ছে তার প্রভাবে কি মাছ মরে যেতে পারে না?
ছবি: Getty Images/Jeff T. Green
মাছের জন্য ট্রেন!
১৯৪৪ সালে যখন দক্ষিণ কোরিয়ার হওয়াচন বাঁধ তৈরি হয় তখন তার কারণে মাছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ চলার পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল৷ এর সমাধান করা হয় মাছের জন্য মনোরেল তৈরি করে৷ এর মাধ্যমে মাছকে বাঁধের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে পৌঁছে দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yonhap News
ইউরোপের সবচেয়ে বড়
জার্মানির হামবুর্গে এলবে নদীতে মাছেদের জন্য প্রায় সাড়ে ৫০০ মিটার দীর্ঘ এই স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছে৷ সেখানে মোট ৪৫টি পুল রয়েছে, যেগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত৷ চলার পথে মাছেদের এই পুলগুলো ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়৷ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫ হাজার মাছ এই পথ পাড়ি দেয়৷
ছবি: dapd
ঘুরানো সিঁড়ি
লিফট বা মনোরেল ছাড়াও অনেক জায়গায় মাছেদের জন্য এমন ঘুরানো সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এর সুবিধা হলো, এতে মাছেদের আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Lübke
জার্মানির কিল শহরে
উত্তর জার্মানির কিল শহরের একটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে মাছেদের জন্য এই ঘুরানো সিঁড়ি স্থাপনা করা হয়েছে৷ এটি ২০০ মিটার দীর্ঘ৷ আর এতে ৩৬টি পুল আছে৷