ছোটবেলার স্মৃতি আজও আমাদের নাড়া দেয়, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র গড়ে তোলে৷ কিন্তু সেই স্মৃতি আচমকা হারিয়ে গেলে পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়৷ বিজ্ঞানীরা সেই বন্ধ দরজার চাবি খোঁজার চেষ্টা করছেন৷
বিজ্ঞাপন
আমাদের স্মৃতিশক্তি না থাকলে কেমন হতো? আত্মজীবনিমূলক স্মৃতিকেই আমরা ‘মনে করা' বলি৷ সেখানে ঘটনাগুলি শুধু চিন্তা হিসেবে জমা থাকে না, তার সঙ্গে জড়িত আবেগও জুড়ে থাকে৷ এই প্রক্রিয়া সাধারণত ৩ বছর বয়স থেকে শুরু হয়৷ এবং সেটা সবসময় অন্যের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের সময় ঘটে৷ তখন নিজস্ব এক সত্তার সৃষ্টি হয়৷ আমরা তখন বুঝতে পারি, কোথা থেকে এসেছি, আমরা কে, অন্যদের থেকে আমরা কীভাবে বাকিদের থেকে আলাদা৷
জীবনের ইতিহাস হারিয়ে ফেললে সেই সত্তা সৃষ্টির পেছনের মুহূর্তগুলিও উধাও হয়ে যায়৷ এমনটা ঘটলে সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়৷
সাবিনের বয়স তখন বিশের গোড়ায়৷ একদিন সকালে উঠে তিনি আর কিছুই মনে করতে পারলেন না৷ নিজের অতীতের ছবির দিকে তাকালেই আশা জাগে, হয়ত কিছু মনে পড়ে যাবে৷ তিনি বলেন, ‘‘শৈশব পুরোটা হারিয়ে ফেলেছি৷ এখন এ সব ছবি দেখলে কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়ে তার কিছু অর্থ বার করতে পারি, কিন্তু সক্রিয়ভাবে কিছুই মনে করতে পারি না৷''
স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ১২ উপায়
আপনি কি কাজের চাপে প্রায়ই এটা-সেটা ভুলে যাচ্ছেন বা আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে? এর পরিণাম কিন্তু হতে পারে ভয়ংকর৷ তাই বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জেনে নিন সতর্কতা এবং স্মৃতিশক্তিকে মজবুত করার কিছু উপায়৷
ছবি: jorgophotography - Fotolia.com
পর্যাপ্ত ঘুম
রাতে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম হলে তা বার্ধক্য প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে মস্তিষ্কে বাঁধার সৃষ্টি করে, জানান রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মাইকেন নেডেরগার্ড৷ তিনি জানান, এর জন্য জরুরি হচ্ছে গভীর ঘুম৷ এটা না হলে মস্তিষ্ক প্রায় সাত বছর বেশি বুড়িয়ে যেতে পারে৷
ছবি: Colourbox
মস্তিষ্কের জন্য ঠান্ডা ঘরই ভালো
গরমের চেয়ে ঠান্ডায় স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগ তিনগুণ বেশি থাকে৷ এ কথা জানান নিউ সাউথ ওয়েল্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়ান মনোবিজ্ঞানী প্রফেসার ইয়োসেফ ফোরগাস৷ এছাড়া ঠান্ডা ঘর মাথাকেও ঠান্ডা রাখে, তাই ঘরের তাপমাত্রা কখনো ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি রাখা ঠিক নয়, জানান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
গল্প শেষ থেকে শুরু করুন
একটি গল্প পড়ে পুরো গল্পটা মনে রাখুন৷ এবার শুরু থেকে না বলে শেষ বা পেছন থেকে গল্পটা মনে করতে থাকুন৷ এই পন্থা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সচল তো রাখবেই, করবে আরো শক্তিশালী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Endig
সঠিক জুতো পরে বেরিয়ে পড়ুন
নিয়মিত হাঁটাচলা বা জগিং শরীরকে ভালো রাখে – এ কথা কম-বেশি আমরা সকলেই জানি৷ সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী মার্ক ম্যাকডানিয়েল জানান, শুধু শরীর নয় হাঁটাচলা এবং জগিং ব্রেনকেও ফিট রাখে৷ তবে সবচেয়ে ভালো হয় সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন অন্তত ২০ মিনিট করে হাঁটলে বা জগিং করলে৷
ছবি: Fotolia/ruigsantos
বিপরীত হাত ব্যবহারের অভ্যাস
যাঁরা ডান হাতে সব কিছু করেন, তাঁরা বাঁ হাতে আর যাঁরা বাঁ হাতে সব কিছু করেন, তাঁরা ডান হাতে সপ্তাহে অন্তত একবার সব কাজ করার চেষ্টা করুন৷ অর্থাৎ উল্টো হাতে খাওয়া-দাওয়া, দাঁতব্রাশ করা বা অন্যান্য টুকটাক ঘরের কাজ করার অভ্যাস করতে পারেন৷ এতেও ব্রেন সচল থাকে৷
ছবি: Fotolia/Photo_Ma
বন্ধুত্ব লালন করুন
মানুষের সাথে কথাবার্তা বলা বা টেলিফোনে যোগাযোগ মস্তিষ্ককে তরুণ রাখে৷ এই তথ্যটি জানিয়েছেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজিস্ট ড. স্টুয়ার্ট রিচি৷ তিনি বলেন, দিনে মাত্র ১০ মিনিটের যোগাযোগই নাকি মানুষের স্মৃতিশক্তিকে বেশ জোড়ালোভাবে জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করে৷
ছবি: Fotolia/szeyuen
প্রতিদিনের নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসুন
ব্রেনকে সব সময় নতুন কিছু শিখতে হয়৷ তা না হলে মস্তিষ্ক নির্জীব হয়ে যায়৷ তাই প্রতিদিনের রুটিন ভেঙে অন্যকিছু করুন৷ মাঝে মাঝে অন্য রাস্তা দিয়ে কর্মস্থলে বা কলেজে যান৷ নতুন কোনো ভাষা বা যন্ত্র বাজানো শিখুন৷ এতে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি শতকরা ৭৫ ভাগ কমে যায়৷ নিউ ইয়র্কের আলবার্ট আইনস্টাইন মেডিকেল কলেজের করা এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে এ তথ্য৷
ছবি: Fotolia/Peter Atkins
পায়ের আঙুলের ম্যাসাজ
প্রতিদিন পাঁচ মিনিট করে পায়ের আঙুল ম্যাসাজ করুন৷ প্রথমে আঙুলের ওপর থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে টিপে টিপে নীচের দিকে যান৷ এই ম্যাসাজ মস্তিষ্কের কোষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে৷
ছবি: Elenathewise - Fotolia.com
শপিং লিস্ট
বাজারে বা দোকানে যাওয়ার আগে কী কী কিনবেন তার একটি লিস্ট তৈরি করে নিন এবং ইচ্ছে করেই সেটা বাড়িতে রেখে শপিংয়ে চলে যান৷ ফিরে এসে দেখুন ক’টা ভুলে গেছেন আর ক’টা মনে রাখতে পেরেছেন৷ এই নিয়ম যত বেশি করা হবে, ব্রেন তত দীর্ঘ সময় মস্তিষ্কে ‘সেভ’ করে রাখতে পারবে তথ্যগুলো৷
ছবি: imago/blickwinkel
দুই কাপ কফিই যথেষ্ট
দিনে দুই কাপ কফি পান করলে আলৎসহাইমার ঝুঁকি কমে শতকরা ২০ ভাগ৷ একটি সমীক্ষার ফলাফল থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন ডিমেনশিয়ার পর্তুগিজ গবেষক ড. কাটারিনা সান্তোস৷ কারণ কফি পান তিরিশের বেশি বয়সিদের মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে অনেকটাই রোধ করে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে৷
ছবি: Fotolia/Kim Schneider
রুটিন চেকআপ
হৃদপিণ্ডের নানারকম অসুখের ঝুঁকির কারণেও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যেতে পারে৷ তাই বছরে একবার রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টোরলের মাত্রা পরীক্ষা করানো উচিত৷
ছবি: Fotolia/Andrei Tsalko
মস্তিষ্কের খাবার
আখরোটের ‘পলিফেনল’ ব্রেনের স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে দেয়৷ তাছাড়াও সামুদ্রিক মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, পালং শাক, ডার্ক চকলেট, গ্রিন টি, অলিভ অয়েল, শাক-সবজি ইত্যাদি মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষায় খুবই জরুরি৷
ছবি: picture alliance/Beyond
12 ছবি1 | 12
সাবিনে কিন্তু অন্য অনেক কাজ করতে পারেন৷ সাইকেল চালানো, মনে মনে অঙ্ক কষা ইত্যাদি৷ জন্ম তারিখও মনে আছে৷ শুধু আত্মজীবনিমূলক স্মৃতি পুরোপুরি মুছে গেছে৷ সাবিনে বলেন, ‘‘একেবারে ফাঁকা৷ অনুভূতিও শূন্যতায় ভরা৷ অতএব কোনো আবেগই আসে না৷''
কী ঘটেছিল সাবিনের সঙ্গে? সত্যি কি তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়েছে? গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা অ্যামনেসিয়া বা স্মৃতিবিলোপের রহস্য ভেদ করে মানুষের স্মৃতির বিষয়টি ভালো করে বুঝতে চান৷
স্মিডার ক্লিনিকস এক আন্তর্জাতিক স্নায়ুবিজ্ঞান কেন্দ্র৷ এখানে অ্যামেনেসিয়ার স্নায়ুগত ও মানসিক প্রভাবের চিকিৎসা হয়৷ নিউরোলজিস্টরা অ্যামনেসিয়ার নিউরো-বায়োলজিকাল প্রক্রিয়ার দুর্বল অংশ খুঁজছেন৷ এমআরআই স্ক্যানারের মধ্যে সাবিনে-কে কিছু আবেগ-জাগানো ছবি দেখানো হচ্ছে৷ স্বাভাবিক মানুষ এমন ছবি দেখলে স্বাভাবিক আচরণ করে৷ কিন্তু সাবিনে-এর ক্ষেত্রে ভিন্ন ফলাফল দেখা গেল৷ মস্তিষ্কের যে অংশ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷ প্রত্যেকটি ছবি চরম ভীতি জাগিয়ে তুলছে৷ অর্থাৎ তথ্য ঠিকমত প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে না৷ এর একটা কারণ শৈশবের কোনো ‘ট্রমা' বা চরম দুঃখজনক ঘটনা হতে পারে৷ নিউরোলজিস্ট প্রো. রজার স্মিট বলেন, ‘‘এমন অবরুদ্ধ স্মৃতি চিকিৎসার মাধ্যমে কীভাবে উদ্ধার করা যেতে পারে, সেটা গবেষণার বিষয়৷ একটি প্রক্রিয়ায় চরম দুঃখজনক ঘটনার স্মৃতি আবার জাগিয়ে তুলে বন্ধ দরজা খোলার চেষ্টা করা হয়৷ অন্য প্রক্রিয়ায় স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষকে নতুন করে তার জীবনের কাহিনি শেখানোর চেষ্টা হয়৷''
সাবিনে কয়েক বছর ধরে স্মৃতিভাণ্ডার ফিরে পাবার চেষ্টা করছেন৷ বার বার তিনি শৈশবের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন৷ অভিজ্ঞতাগুলি চিরকালের জন্য হারিয়ে যায় নি বলে তাঁর আশা৷ কোথাও যেন তালাবন্ধ রয়েছে৷ মস্তিষ্ক যেন তার উপর লিখে রেখেছে, ‘সাবধান! খুললেই বিপদ'৷
মস্তিষ্কের জন্য উপকারী ৭টি খাবার
প্রতিদিন হাজার চিন্তার সঠিক কাজটা করতে হয় মস্তিষ্ককে৷ তাই তার জন্য চাই প্রকৃত খাবার৷ কীভাবে আপনি আপনার মস্তিষ্ককে সুস্থ ও সক্রিয় রাখবেন – এখানে থাকছে তেমনি কিছু খাবারের তালিকা৷
ছবি: Fotolia/gaai
ডার্ক চকোলেট
প্রতিদিন এক টুকরো ডার্ক চকোলেট খেলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে৷ অল্প পরিমাণে ডার্ক চকোলেট খাওয়ার অভ্যাস স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে, বলছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture alliance/dpa
আখরোট
আখরোটে অন্যান্য বাদামের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে৷ এটি মস্তিষ্ককে যে কোনো রোগ থেকে রক্ষা করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
টমেটো
টমেটো – সহজলভ্য এই সবজিটি মস্তিষ্কের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, কারণ এতে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা মস্তিষ্কের কোষগুলোর ক্ষতি হওয়া থেকে বাঁচায়৷ এছাড়া স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে টমেটো৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/McPHOTOs
স্যামন ও সামুদ্রিক মাছ
মানুষের মস্তিষ্কের ৬০ শতাংশ চর্বি দিয়ে তৈরি৷ তাই এটিকে সক্রিয় রাখতে প্রয়োজন ফ্যাটি অ্যাসিড৷ সামুদ্রিক মাছ যেমন – স্যামন, টুনা ও অন্য সামুদ্রিক মাছ মস্তিষ্কের খাবার হিসেবে বেশ উপকারী৷ কারণ এই খাবারগুলোতে আছে ফ্যাটি অ্যাসিড, যা আলজইমার রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে৷
ছবি: picture-alliance/chromorange
গ্রিন টি
গবেষকরা বলছেন, গ্রিন টি মস্তিষ্কের সংযোগ ক্ষমতা বাড়ায়, সেই সাথে পারকিনসন্স ও স্মৃতিভ্রংশের হাত থেকে রক্ষা করে৷ চিনি ছাড়া দিনে তিন কাপ সবুজ চা আপনার মস্তিষ্কের জন্য ভীষণ উপকারী৷
ছবি: Fotolia/gaai
ব্লু বেরি
বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা বাড়াতে ব্লু বেরির জুড়ি নেই৷ এতে আছে ফ্ল্যাভোনয়েডস৷ এছাড়া এটি স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে৷ মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকেও রক্ষা করে এটি৷ পারকিনসনস আর আলজাইমার থেকেও রক্ষা করে ব্লু বেরি৷
পালংশাক
পালংশাকে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে, যা মস্তিষ্কের সংযোগ শক্তি বৃদ্ধি করে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ায়৷ এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্টও রয়েছে, আছে ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন ই ও ভিটামিন কে, যা ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে৷