সাধারণ ছুটির মধ্যেই শিথিল হচ্ছে বিধিনিষেধ৷ কারখানা-অফিস খুলছে, সড়কে বাড়ছে যান চলাচল৷ ঈদ সামনে রেখে দোকানপাটও খুলছে৷ সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা৷
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রুখতে প্রায় দেড় মাস ধরে বাংলাদেশে টানা সাধারণ ছুটি চলছে৷ গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার কয়েক ধাপে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়িয়েছে৷ দীর্ঘ এ লকডাউনে সরকারকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি গুণতে হচ্ছে৷ এ অবস্থায় ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরতে লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে৷
বিধিনিষেধ শিথিল করার পরই সারা দেশে সড়কে যানবাহন চলাচল বেড়ে যায়৷ যদিও এখনো সরকার গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়নি৷ ফেসবুক বা টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ঢাকার বিভিন্ন সড়কের ছবি দিয়েছেন৷ কেউ কেউ ছবির সঙ্গে বিদ্রুপাত্মক ক্যাপশনও জুড়ে দিয়েছেন৷
আব্দুল মান্নান দীপ্ত নামের একজন নিজের ফেসবুক একাউন্টে মঙ্গলবার সকালে তোলা রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের একটি সড়কের ছবি দিয়ে লেখেন, ‘প্রচুর লকডাউন চলছে..’৷ তাঁর ওই ছবিতে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেন৷ কেউ সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন৷
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজধানী ও বিভিন্ন জেলা শহরের নানা সড়কের এমন অসংখ্য ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে৷ ছবিগুলোতে সড়কে যানবাহনের রীতিমত ভিড় দেখা যাচ্ছে৷ লোকজনও স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়মের তোয়াক্কা না করেই চলছেন৷
ঢাকার সড়কগুলোতে এখনো বাস চলাচল শুরু না হলেও ব্যক্তিমালিকানার গাড়ি, সিএনজি, মোটরসাইকেল এবং রিকশা অবাধে চলছে৷ কোনো কোনো এলাকায় সড়কে যানজটে দীর্ঘসময় অপেক্ষার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে৷
এদিকে, ঈদ সামনে রেখে ১০ মে থেকে দেশে বিপণীবিতান খোলার অনুমতি দেয় সরকার৷ সব নির্দেশনা অনুযায়ী সুরক্ষামূলক বেশকিছু শর্ত মেনে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিপণী খোলা রাখা যাচ্ছে৷ যদিও বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে দোকান খোলা নিয়ে মালিকরা দ্বিধায় ভুগছেন৷ তাদের মধ্যে একদিকে যেমন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আতঙ্ক কাজ করছে, অন্যদিকে ক্রেতা সমাগম হবে কিনা সেটা নিয়েও দ্বিধায় ভুগছেন৷
রাজধানীর দুইটি বড় শপিং মল বসুন্ধরা শপিং সেন্টার ও যমুনা ফিউচার পার্ক কর্তৃপক্ষ নিজেদের বিপণীবিতান না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ নিউ মার্কেট, চাঁদনী চক, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের একটি অংশও দোকান চালু না করার পক্ষে৷
তবে রোববার দোকান খোলার অনুমতি পাওয়ার প্রথম দিন দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার গুলিস্তানের বঙ্গবাজার মার্কেট খোলা হয়েছিল৷ কিন্তু স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মেনে বিকিকিনি না হওয়ায় মঙ্গলবার পুলিশ মার্কেটটি বন্ধ করে দেয় বলে জানায় বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷ মঙ্গলবার সকালে স্থানীয় ফ্যাশন ব্রান্ড অরণ্য ও ভিআইভিইর ধানমণ্ডির দুটি দোকানও একই কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
রোববার খোলার পরপর ধানমণ্ডির ‘এআরএ সেন্টার’ ও ‘এডিসি ইমপায়ার’ নামে দুটি মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে সোমবার তা আবার খুলে দেওয়া হয়েছে৷ নিয়ম না মানায় ফরিদপুর জেলা শহরের সব মার্কেটও আপাতত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷
গত ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্তের পর মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১৬ হাজার ৬৬০ জন হয়েছে৷ মোট মৃত্যু ২৫০৷ বিধিনিষেধ শিথিল হতে শুরু করায় গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনও শনাক্তের নতুন রেকর্ড হচ্ছে৷ মৃত্যুও বাড়ছে একই গতিতে৷
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
এরইমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমেছে ব্যাপকভাবে৷ দেখা দিয়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ার শঙ্কা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
রপ্তানি ধস
লকডাউনের কারণে ইউরোপ ও অ্যামেরিকায় ব্যবসা বাণিজ্য, মানুষের কেনাকাটা কার্যত বন্ধ৷ এসব দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে, কয়েকশো কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করেছে৷ এর প্রভাবে এপ্রিলে রপ্তানি আয় নেমে এসেছে মাত্র ৫২ কোটি ডলারে, যা আগের বছরে একই মাসের চেয়ে ৮২.৮৫% কম৷ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসেব বলছে চলতি বছর সারা বিশ্বেই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ৩২% পর্যন্ত কমতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yu Fangping
প্রবাসী আয়ে টান
এপ্রিলে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ ভাগ কমেছে৷ প্রবাসী আয়ের সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে৷ জ্বালানি তেলের দাম কমায় তাদের অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়েছে৷ সেইসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা৷ এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স গত বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ কমে যাবে, বলছে বিশ্বব্যাংক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/R. Abd
চাকুরির অনিশ্চয়তা
দেশের ভিতরে যে লকডাউন পরিস্থিতি চলছে তার কারণেও বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও সেবাখাতগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ৷ এসব প্রতিষ্ঠানে যারা চাকুরি করছেন, যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকছে৷ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক চীনে করোনার প্রকোপ শুরুর পর বলেছিল, বাংলাদেশের প্রায় নয় লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে৷ তবে এখন তৈরি পোশাক খাতেই অনেক শ্রমিকের চাকুরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
খাদ্য নিরাপত্তা
গত বছরের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল, এই সময়ে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩.৫৩ লাখ মেট্রিক টন৷ নতুন বছরে তা ১০ লাখ মেট্রিক টন বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ৷ সরকারের খাদ্য গুদামে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে৷ বোরো মৌসুমে আরো ২০ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে সরকার৷ সেক্ষেত্রে খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার আশংকা তেমন নেই৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের হাতে খাদ্য কেনার টাকা থাকবে কিনা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
দারিদ্র্য বাড়ছে
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সোয়া তিন কোটির বেশি৷ এর বাইরে গত দেড় যুগে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ উপার্জন না থাকলে দ্রুতই তারা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন৷ ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক জরিপেও দেখা গেছে করোনার প্রভাবে দেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ ভাগ কমে গেছে, হতদরিদ্র বা যাদের দৈনিক আয় ১৬০ টাকার কম এমন মানুষের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সরকারের প্রণোদনা
অর্থনীতি বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের সরকারও আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যার আকার ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এর বড় একটি অংশ দেয়া হবে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প আর কৃষি খাতে ঋণ হিসেবে৷ পাশাপাশি লক-ডাউনের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের ব্যাংক হিসাব তৈরি করে এককালীন নগদ অর্থ প্রদানের কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোরও৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
টাকার সন্ধান
বাজেটের ঘাটতি মেটাতে এরিমধ্যে ব্যাংক থেকে সারাবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করে ফেলেছে সরকার৷ নতুন ঋণ নেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে৷ বিভিন্ন খাতের ব্যয় কমিয়েও অর্থ সংস্থানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ সবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেতে পারে৷ তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, এমন আশঙ্কায় টাকা ছাপানোর পক্ষে নন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ৷
ছবি: DW
মন্দার শঙ্কা
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে মহামন্দার আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও৷ এরইমধ্যে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি৷ মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশ কতটা সামলাতে পারবে তা বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নির্ভর করছে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপরে৷