মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি
২৮ মে ২০১৮
আমাদের সড়ক-মহাসড়কে অব্যবস্থাপনায় সড়কের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে৷ সড়ক ব্যবহারকারী, চালক, মালিক, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, যে যার মতো করে সড়কে চলছে৷ প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি বিধান থাকলেও কেউ তা মানছে না৷
বিজ্ঞাপন
আসলে রাস্তায় প্রকৃত অর্থে কোনো ‘এনফোর্সমেন্ট' ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশে৷ এতে দিন দিন চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের নিহত হওয়ার ঘটনায় সারাদেশ কেঁদে উঠলেও, প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কে ঝড়ছে কমপক্ষে ৬৪টি তাজা প্রাণ৷ প্রতিদিন আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০-এরও বেশি মানুষ৷ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় ৫০ লাখ যানবাহনের ৬০ শতাংশ, অথাৎ ৩০ লাখ যানবাহনের চলাচলের যোগ্যতা/ফিটনেস, পারমিট বা নিবন্ধন নেই, বা ভুয়া নাম্বারে চলছে এইসব যানবাহন৷ এখানে পুলিশকে ম্যানেজ করে বৈধ গাড়ির চেয়ে অবৈধ গাড়ির চালানো অনেক সহজ৷ বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তথাকথিত সনাতন পদ্ধতিতে জরিমানা আদায়ে মগ্ন৷
ট্রাফিক পুলিশের টিআই, পিআই, সাজের্ন্ট, কনস্টেবলরা পরিবহণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে চাঁদাবাজি, টোকেনবাজি, জরিমানা আদায় ও আত্মসাতের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন৷ প্রকৃত মালিক ও শ্রমিক সংগঠন গুলোকে কোণঠাসা করে সরকারের লেজুরভিক্তিক গুটি কয়েক সংগঠন এই সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের পরিবর্তে চাঁদাবাজি, পারমিট বাণিজ্য, কর্তৃত্ব জাহির ও ক্ষমতা প্রদর্শনে মগ্ন রয়েছে৷ রাজনৈতিক ঠিকাদাররা সরকারের কোর্ট গায়ে দিয়ে সরকারের আপন লোক সেজে সড়কে শত শত কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নিয়ে যেনতেনভাবে কাজ করে বিল নিয়ে লাপাত্তা হচ্ছে৷ অথবা রাস্তা কেটে মাসের পর মাস ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে৷ এহেন পরিস্থিতিতে সড়কে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি আজ চরম আকার ধারণ করেছে৷
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২০-২২ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন৷ এর মধ্যে নানা কারণে শুধু অল্প কিছু ঘটনা সারা দেশের মানুষের আলোচনায় আসে৷
ছবি: DW/Samir Kumar Dey
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের এক গ্রামে ছবির শুটিং স্পট দেখে ঢাকা ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন খ্যাতিমান চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের প্রধান নিবার্হী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন৷ এ দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ ও শিল্পী ঢালী আল-মামুনসহ চারজন আহতও হয়েছিলেন৷
ছবি: DW/S. K. Dey
ক্ষতিপূরণ
দুর্ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা বাস মালিক, চালক ও বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দু'টি মামলা দায়ের করেন৷ সেই মামলার একটির চূড়ান্ত রায়ে গত ডিসেম্বরে তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট৷ আগামী তিন মাসের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়া হলেও এখনও তা কার্যকর হয়নি৷
দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন৷ ১৯৮৯ সালে মতিঝিলের আনন্দ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন তিনি৷ এরপর তাঁর স্ত্রী রওশন আরা ১৯৯১ সালে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ ২০১৪ সালের ২০ জুলাই সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ৷ তবে তা এখনও পাননি মন্টুর পরিবার৷
ছবি: Rawshan Aktar
জাহানারা কাঞ্চন
তিনি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী ছিলেন৷ ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর স্বামীর শ্যুটিং দেখতে যাওয়ার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি৷ সে বছরই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং সড়ক চলাচল সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য ও দাবি নিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন ইলিয়াস কাঞ্চন৷ সমাজসেবায় ২০১৮ সালের একুশে পদক পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেতা৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/GettyImages
রাজীব হোসেন
৩ এপ্রিল ঢাকার কারওয়ান বাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে মধ্যে পড়ে প্রথমে হাত হারিয়েছিলেন তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন৷ মাথায়ও আঘাত পান তিনি৷ এরপর দুই সপ্তাহ চিকিৎসাধীন ছিলেন৷ তবে তাঁকে বাঁচানো যায়নি৷ পরে রাজীবের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট৷ দুর্ঘটনার পর দুই বাসের মাঝে এক হাত ঝুলে থাকার ছবি প্রকাশিত হলে সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
মানজারুল ইসলাম রানা
২০০৭ সালের ১৬ মার্চ খুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন জাতীয় দলের এই ক্রিকেটার৷ ২৩ বছর বয়সি রানা জাতীয় দলের হয়ে ছয়টি টেস্ট ও ২৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন৷
ছবি: Tawhid Zaman
জগলুল আহমেদ চৌধুরী
২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, বাসস-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জগলুল আহমেদ চৌধুরী কারওয়ানবাজার এলাকায় বাস থেকে নামতে গিয়ে সেই বাসের পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন৷
ছবি: DW/M. Mamun
নাজিম উদ্দিন
ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ছিলেন৷ ১৭ মে শনির আখড়া থেকে মোটর সাইকেলে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলেন৷ এই সময় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুই বাসের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে একটি বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন তিনি৷ ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়৷ নাজিম উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারকে কেন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে সম্প্রতি রুল জারি করেছে হাইকোর্ট৷
ছবি: Privat
8 ছবি1 | 8
রাজধানীসহ সারা দেশের গণপরিবহণে নৈরাজ্য চলছে, বাসে-বাসে রেষারেষি করে বেপরোয়া চলাচল, পাল্লাপাল্লির কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা৷ যত্রতত্র বাস থামানো, রাস্তার মাঝপথে গতি কমিয়ে চলন্ত বাসে যাত্রী উঠানামা করানো, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, রাস্তার মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো নামানো, যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ংকর প্রতিযোগিতা, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা ঢাকার গণপরিবহণের নিত্যদিনের চিত্র৷
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে৷ ফলে এ সব বাসে দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা, বা কারো জীবন চলে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্য মতে, সারা দেশে জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ৩০ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত ১,৮৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২,১২৩ জনের প্রাণহানি ও ৫,৫৫৮ জন আহত হয়েছে৷ এখানে পঙ্গু হয়েছে ২৯৭ জন৷
আমরা এ সব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলতে চাই৷ কেননা আমাদের সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে যাতায়াত করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নম্বরধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লক্ষ যানবাহন রাস্তায় চলছে, যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য৷ অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লক্ষ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লক্ষ চালকের হাতে৷ এছাড়াও রাজনৈতিক ঠিকাদারের দৌরাত্ম্যের কারণে সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কে বেহাল দশা তৈরি হয়েছে৷ যাত্রী হিসেবে আমাদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে৷ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইন প্রয়োগের চেয়ে দু'হাতে পকেট ভরতে ব্যস্ত৷
রাস্তায় নৈরাজ্য, যেন আইন ভাঙার হিড়িক
১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা৷ শুধু রাজধানীই নয়, দেশের আইন-শাসন-বিচার বিভাগ এখান থেকেই পরিচালিত হয়৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্যসহ নানা কাজের কেন্দ্রও এটাই৷ অথচ কোনো সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই ঢাকায়৷
ছবি: bdnews24.com
উলটো পথে চলাচল
ঢাকা শহরে নানা ট্রাফিক অব্যবস্থপনার মধ্যে উলটো পথে চলা অন্যতম৷ বাইকার, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ভিআইপি – অনেকেই নিজের তাড়াতাড়ি যাওয়া নিশ্চিত করতে উলটো পথে গাড়ি ছোটান৷ তাতে আরো বেশি বিড়ম্বনায় পড়েন রাস্তায় নামা সাধারণ মানুষ৷
ছবি: bdnews24.com
বেপরোয়া ড্রাইভিং
এমনিতে হয়ত যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেক গাড়িকে৷ তবে রাস্তা ফাঁকা পেলে যেন দেরি সয় না অনেক চালকের৷ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে দেন তাঁরা৷ এর ফলে অনেক সময়ই প্রাণ যায় মানুষের৷ প্রিয়জন হারানোর আহাজারিতে ভারী হয় আকাশ বাতাস৷ কেবল ঢাকার রাস্তাতেই প্রতি বছর কয়েক শত মানুষের প্রাণ যায়৷
ছবি: bdnews24.com
যত্রতত্র পার্কিং
ঢাকা মহানগরের সড়কগুলো আর যাই হোক, বিপুল পরিমাণ মানুষ আর যান বাহনের চাপ সামলানোর মতো নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত৷ সরু সেই সব রাস্তার অবস্থা আরো করুণ হয়ে যায়, যখন যত্রতত্র পার্কিংয়ে এই রাস্তা আরো সরু হয়ে যায়৷
ছবি: bdnews24.com
অননুমোদিত ড্রাইভিং
গত মে মাসে এক স্কুলছাত্র এই গাড়িটি নিয়ে বের হয়ে পড়ে রাস্তায়৷ অননুমোদিত এই ড্রাইভিংয়ে আহত হয় আরেক শিশু৷ অবৈধ ড্রাইভিংয়ে কেবল শিশু নয়, বড়রা জড়িয়ে পড়েন৷ লাইসেন্স ছাড়াই অনেকে নেমে পড়েন রাস্তায়৷ লাইসেন্স থাকলেও মাদক গ্রহণের পর, শারিরীক বা মানসিকভাবে অনুপযুক্ত অবস্থায়ও গাড়ি চালানো আইনে নিষেধ৷ সড়কে বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানো, রেসে অংশ নেয়াও নিষিদ্ধ৷ বীমার বাধ্যবাধকতাও অনেকে মানেন না৷
ছবি: bdnews24.com
উলটো পথে চললে চাকা ফুটো
উলটো পথে গাড়ির চলাচল বন্ধ করতে একটি যন্ত্র বসিয়েছিল ট্রাফিক পুলিশ৷ কথা ছিল গাড়ি উলটো পথে চললে তাতে চাকা ফুটো হয়ে যাবে৷ কিছুদিন পর এই যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়৷ ঢাকা শহরের গাড়িকে স্বয়ংক্রিয় সংকেত বাতির উপর নির্ভরশীল করে দিতে সর্বশেষ ২০১৫ সালে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়৷ কিন্তু পুলিশের অসহযোগিতায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে৷ এই শহরে ট্রাফিক আইন ভাঙা মামলাও হয় গতানুগতিকভাবে, হাতে লিখে৷
ছবি: bdnews24.com
যত্রতত্র পথচারীদের চলাচল
ঢাকার রাস্তায় আরেক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে খোদ পথচারীরাই৷ নির্ধারিত জায়গার পরিবর্তে যেখানে সেখানে রাস্তা পার হয়ে যান তাঁরা৷ রাজধানীতে পথচারীদের আইন না মানার প্রবণতাও এখানকার দুর্ঘটনার একটা কারণ৷
ছবি: bdnews24.com
আইন প্রয়োগে ফাঁকি
ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে নানা আইন থাকলেও, সেটা প্রয়োগে ফাঁকি রয়েছে৷ প্রায়ই খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্যকেই আইন ভাঙতে দেখা যায়৷ লেগুনা নামের এই ‘আনফিট’ গাড়ি ব্যবহার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷
ছবি: bdnews24.com
ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য
রাজধানী ঢাকায় যে সব গাড়ি চলে তার অধিকাংশই ব্যক্তিগত৷ এ সব গাড়িকে যত্রযত্র যানজট সৃষ্টির জন্যও দায়ী করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গণপরিবহনে নৈরাজ্য
ঢাকার সমস্যা গণপরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য৷ মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব তো রয়েছেই৷ যে গাড়িগুলো রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল৷ যেখানে সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলা যেন নগরীর নিত্যদিনের চিত্র৷
ছবি: bdnews24.com
9 ছবি1 | 9
ঢাকা মহানগরীতে পরিবহণ পরিচালনা ও রুট পারমিট ইস্যুর দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা মেট্রো আঞ্চলিক পরিবহণ কমিটি বা মেট্রো আরটিসি৷ এই কমিটিতে পেশাদার কোনো লোকজন নেই, নেই কোনো যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধি৷ প্রভাবশালী মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের কয়েক জন নেতা কার্যত এই কমিটি পরিচালনা করে৷ তাদের কাছে সরকারের লোকজন অসহায়৷ তারা ঢাকা মহানগরীর পরিবহণ পরিচালনায় ভালো-মন্ধ দেখার কথা৷ পরিবহণে এহেন নৈরাজ্য ও হয়রানি থামাতে এই কমিটির কার্যত কোনো ভূমিকা নেই৷ নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছে৷ দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ইজারায় প্রত্যেক মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দিয়েছে৷ ফলে চালকরা যাত্রী ধরার জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন৷ এই পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নীচে কে পড়লো বা কার হাত বা পা গেল, তা দেখার সময় নেই চালকদের৷
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আমাদের সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা পরিচালনায় যোগ্য ও পেশাদারিত্বসম্পন্ন লোকজনের দারুণ অভাব রয়েছে৷ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পেশাদারিত্বের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক জঞ্জালে আবদ্ধ৷ এতে করে এই সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বা শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না৷
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যাত্রী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মরত সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে:
১. নগরীতে বাসে-বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধে কোম্পানিভিত্তিক একই রংয়ের বাস সার্ভিস চালু করা উচিত৷
২. উন্নত বিশ্বের আদলে আমলাতন্ত্রের বাইরে এসে পেশাদারিত্বসম্পন্ন গণপরিবহণ সার্ভিস অথরিটির নামে একটি টিম গঠন করা৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত এই টিম নগরজুড়ে গণপরিবহণ ব্যবস্থার সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে প্রতিদিনের সমস্যা প্রতিদিন সমাধান করে এই ব্যবস্থাকে একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসবে ও সড়কের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করবে৷ এছাড়া তারা গণপরিবহণের মান, যাত্রী সেবার মান, বাস টার্মিনালের পরিবেশ, যাত্রী ও গণপরিবহণ সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধান করবে৷ ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ ও অন্যান্য সেবাদান প্রতিষ্ঠানসমূহ এই টিমের নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে৷
৩. ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে
৪. চালকের হাতে দৈনিক জমা ভিত্তিক বাস ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে
৫. বিআরটিএ-র ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কাজটি জনবান্ধব করতে হবে৷ এই আদালত পরিচালনার মাধ্যমে পরিবহণ সেক্টরে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে
৬. ট্রাফিক পুলিশের মামলার জরিমানা সরাসরি ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করতে হবে
৭. সড়কে চাঁদাবাজি, টোকেন বাণিজ্য, দখলবাজি, হকার ও অন্যান্যদের ফুটপাত ও সড়ক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
৮. রুট পারমিট ইস্যু প্রক্রিয়ায় ঢাকা মেট্রো আরটিসিতে মালিক, শ্রমিক নেতাদের পরিবর্তে পেশাদারিত্ব ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকজন নিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে
৯. ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে, এবং
১০. পরিবহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যাত্রী সাধারণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরা ও মত প্রকাশের স্বার্থে যাত্রী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে৷
এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷