হংকংয়ের রাতের ছবি দেখে থাকলে রঙবেরঙের নিয়ন সাইনের আধিক্য আপনার নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে৷ তবে ইদানীং কম মূল্যের বিকল্প বের হওয়ায় নিয়ন শিল্পীদের ভবিষ্যৎ শঙ্কার মুখে পড়েছে৷
বিজ্ঞাপন
দ্য হংকং নিয়ন হেরিটেজ নামে একটি সংস্থা এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টা করছে৷ হংকংয়ে বড় হওয়া কার্ডিন চেন ঐ সংস্থায় কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আশির দশকে আমি এখানে বেড়ে উঠেছি৷ ফলে রাস্তাঘাটের এমন সব ছবির সঙ্গে আমি পরিচিত৷ আমি হংকংকে যেমন দেখেছি, এখনো তার কিছুটা বর্তমান আছে৷’’
রঙবেরঙের নিয়ন সাইনগুলো সাবেক এই ব্রিটিশ উপনিবেশের উন্নতি আর সমৃদ্ধির প্রতীক৷ তবে ইদানীং নিয়নের বিকল্প বের হয়েছে, যা কম দামে পাওয়া যাচ্ছে৷ ফলে নিয়ন সাইন কমতে শুরু করেছে৷
কার্ডিন চেন মনে করছেন, হংকংয়ের পরিচিতি দিন দিন মিইয়ে যাচ্ছে৷ ‘‘হংকং তার অনন্য ভাবটা হারাচ্ছে, শহরের স্বর্ণযুগ সম্ভবত শেষ - বোধ হয় আর ফিরে আসবে না,’’ বলেন তিনি৷
হংকংয়ে সবসময় পরিবর্তন ঘটছে৷ বেইজিংয়ের প্রভাব সেখানে স্পষ্ট৷ ফলে অনেকে হংকংয়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা হারাবার শঙ্কা করছেন৷ পপ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে একসময়কার ‘ট্রেন্ড-সেটার’ হংকং দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে৷ বর্তমানে চীনের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷
এখনো নিয়ন সাইন তৈরি করেন এমন শিল্পীদের মধ্যে একজন উ চি-কাই৷ ১৮ বছর বয়স থেকে তিনি এই কাজ করছেন৷ ক্লায়েন্টরা তাঁদের ভাবনা কাগজে এঁকে দেন, পরে চি-কাই সেটিকে জীবন্ত করে তোলেন৷ জটিল সাইন তৈরিতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে৷
উ চি-কাই বলেন, ‘‘বিশ বছর আগে আমি প্রতিদিন নিয়ন সাইন তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকতাম৷ আর এখন মাসে মাত্র চার-পাঁচ দিনের কাজ পাই৷’’
কার্ডিন চেন নিয়ন নির্মাতাদের কাজ বাঁচিয়ে রাখতে চান৷ উ চি-কাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আগ্রহীদের জন্য নিয়ন তৈরির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি এই শিল্প তৈরির দক্ষতাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে চাই৷ আমার বিশ্বাস, এই দক্ষতাকে অন্য কাজে লাগানো সম্ভব - যেমন আর্ট-এর ক্ষেত্রে৷’’
মাটিয়াস ব্যোলিঙ্গার/জেডএইচ
গত বছর এপ্রিলের ছবিঘরটি দেখুন...
টয়লেটের ভেতরেই রান্নাঘর!
একসঙ্গে পায়খানা আর রান্নাঘর? হংকংয়ে সেটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়, বরং নির্মম বাস্তব৷ সব দৃষ্টিকোণ থেকেই হংকংয়ে জায়গার অভাব, কাজেই সেখানে মানুষকে যেভাবে মাথা গুঁজে থাকতে হয়, তা অবর্ণনীয়৷
ছবি: Benny Lam & SoCo
রান্না করতে হলে...
বাঁ-দিকে প্রথমে টয়লেট; তার পাশে কিচেন সিংক, যার ওপর আবার মাংস বা শাকসবজি কাটার জায়গা; তার পাশে হটপ্লেট ও কড়াই, যেখানে রান্না হবে৷ ডানদিকে ওয়াশিং মেশিন, রাইস-কুকার ইত্যাদি৷ হংকংয়ের এই খুপরি ফ্ল্যাটে বাস, সেথা দম নেওয়াতেই নাভিশ্বাস...
ছবি: Benny Lam & SoCo
বাসস্থান, নাকি মালগুদাম?
ক্যানাডার আলোকচিত্রী বেনি ল্যাম একটি দারিদ্র্য দূরীকরণ এনজিও-র হয়ে হংকংয়ে মানুষজন কিভাবে বাস করেন তা দেখাতে এই ছবিগুলো তোলেন৷ খেয়াল রাখবেন: টেলিভিশন, বিয়ারের ক্যান বা টয়লেট পেপার, একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার কোনো আনুষঙ্গিকই বাকি নেই – এমনকি দেয়ালে ফুটবলের পোস্টার অবধি৷
ছবি: Benny Lam & SoCo
ছিল বাথরুম, হয়েছে রান্নাঘর
যেন সুকুমার রায়ের হাঁসজারুর কোনো আধুনিক সংস্করণ! হংকংয়ের জনসংখ্যা ৭৫ লাখ ছাড়িয়েছে, অথচ আর বাড়ি তৈরির কোনো জায়গা নেই বললেই চলে৷ কাজেই ফ্ল্যাট বা বাড়ির ভাড়া ও দাম আকাশে চড়েছে৷ সাধে কি আবাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে হংকং বিশ্বের সবচেয়ে মহার্ঘ শহরগুলির মধ্যে পড়ে!
ছবি: Benny Lam & SoCo
স্টার ওয়ার্স থেকে স্মার্টফোন
কথায় বলে, যদি হয় সুজন, তেঁতুলপাতায় ন’জন৷ আজকাল আর তেঁতুলপাতায় ন’জনকে ধরাতে হয় না, তবে জিনিসপত্র ধরাতে হয় বৈকি৷ কাজেই দেয়াল থেকে ব্যাগের পর ব্যাগ ঝোলে৷ হংকংয়ে নাকি ৮৮,০০০ এ ধরনের ফ্ল্যাট বা খোঁদল কিংবা গুদামঘরে লাখ দুয়েক মানুষ বাস করছেন৷ এরা গৃহহারা নন, চাকরিবাকরিও আছে৷ কিন্তু সে চাকরিতে এই খোঁদলের বেশি মাথা গোঁজার স্থান হয় না৷
ছবি: Benny Lam & SoCo
দুই দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে...
সাজিয়ে নিয়ে দেখি শি জিনপিং-কে৷ ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে হংকংয়ের কেন্দ্রীয় এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম দ্বিগুণ হয়ে বর্গমিটার পিছু প্রায় ১৪ হাজার ডলার কিংবা ১১ হাজার ইউরোতে দাঁড়ায়৷ কাজেই বহু খেটে খাওয়া মানুষ হংকংয়ে বাস করেন মুক্ত প্রকৃতিতে জীবজন্তুদের মতো: মাথা গোঁজার জায়গা হলেই হলো৷
ছবি: Benny Lam & SoCo
তোষকের সাইজের ফ্ল্যাট
তার ওপর শুয়ে ক্যান থেকে বিনস খেতে খেতে টেলিভিশন দেখতেই বা আপত্তি কি? ডানদিকে নিয়ন লাইটের টিউবটাও খেয়াল করবেন৷ জানলা-দরজা নেই তো কী হয়েছে? ছারপোকা আর আরশোলা, নিখর্চায় দুই’ই পাচ্ছেন...
ছবি: Benny Lam & SoCo
খাঁচা, নাকি শবাধার?
হংকংয়ের লোকজন এ ধরনের ফ্ল্যাটগুলিকে ঐ নামেই ডেকে থাকে৷ হংকংয়েও ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ তবে সুবিশাল শপিং মল, অভিজাত হোটেল আর বহুতল আবাসিক ভবনের সঙ্গে এই খাঁচা বা কফিনগুলোর তফাৎ বোধহয় তার চেয়েও বেশি৷ মুম্বাই সম্পর্কে এককালে বলা হতো, সেখানে জায়গা থাকে শুধু বাসিন্দাদের হৃদয়ে৷ হংকং-এর ক্ষেত্রেও কি তা বলা উচিত?
ছবি: Benny Lam & SoCo
ডিম আগে, না মুরগি আগে?
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ছিল বাথরুম, হয়েছে রান্নাঘর৷ তবে সাধ করে নয়৷ হংকংয়ে সরকারি আবাসন পেতে নাকি গড়ে বছর পাঁচেক সময় লাগে৷ আর একা মানুষ হলে, দশ বছরের বেশি অপেক্ষা করাটাও নাকি অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ এই পরিস্থিতিতে ফ্ল্যাটের বদলে শুধু বাথরুমটা ভাড়া দিতে চাইলেও ভাড়াটের কোনো অভাব হয় না৷
ছবি: Benny Lam & SoCo
বাঁচার তাগিদ
রাইস-কুকারের পাশেই ওয়াশিং মেশিন; তার তলায় বাক্সপ্যাঁটরা; তার তলায় বিছানা...৷ জাতিসংঘ হংকংয়ের এই খাঁচা বা কফিন ফ্ল্যাটগুলোকে বলেছে ‘মানব মর্যাদার প্রতি অবমাননা৷’ হংকং সরকার বলছেন, ২০১৭ সালের মধ্যে আরো দু’লাখ আশি হাজার সরকারি ফ্ল্যাট তৈরি হবে৷ তখন কি এই খাঁচা বা কফিনগুলো খালি পড়ে থাকবে? সাধে কি কবি বলেছেন, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা...৷