১৯৯৭ সাল থেকে ১ জুলাই দিনটিকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করেন হংকংয়ের মানুষ। গত কয়েকবছর তা প্রতিবাদের দিনে পরিণত হয়েছিল।
হংকংয়ে গণতন্ত্র দিবসছবি: May James/DW
বিজ্ঞাপন
গত প্রায় ১০ বছর ১ জুলাই দিনটিকে প্রতিবাদের দিন হিসেবে পালন করেছেন হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থিরা। চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন হাজার হাজার গণতন্ত্রপন্থি মানুষ। কিন্তু ২০২০ সালের পর থেকে চীনের আগ্রাসী নীতির সামনে এই আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হতে শুরু করে। এবছর প্রতিবাদ প্রায় নেই বললেই চলে। কড়া নজরদারিতে কিছু জায়গায় পালিত হচ্ছে গণতন্ত্র দিবস। অভিযোগ, কোনো কোনো জায়গায় আগেই এই অনুষ্ঠান রেকর্ড করে রাখা হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকংয়ে যুক্তরাজ্যের শাসন শেষ হয়। হংকং চীনের অংশ হয়। সে সময় যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়, চীনে অন্তর্ভুক্তি হলেও হংকংয়ের হাতে স্বায়ত্ত্বশাসনের যথেষ্ট ক্ষমতা থাকবে। এক দেশ, দুই তন্ত্র-- এই নিয়মে হংকং চালিত হবে বলে সে সময় স্থির হয়েছিল। এবং সে কারণেই ১ জুলাই দিনটিকে গণতন্ত্রের দিন হিসেবে পালন করতে শুরু করেন হংকংবাসী। কিন্তু পরবর্তীকালে নীতি বদল করে চীন। 'এক চীন' নীতি কায়েম করার চেষ্টা হয় হংকংয়ের উপর।
২০২০ সালের গরমকালে হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারি করে চীন। এই আইন প্রয়োগ করে হংকংয়ে সমস্ত প্রতিবাদ সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গণতন্ত্রের পক্ষে রাস্তায় নেমে যারা আন্দোলন করছিলেন, তাদের জেলে ঢোকানো হয়। ২০২৪ সালে আর্টিকাল ২৩ রদ করে চীন আরো কড়া পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে পুলিশের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায়। জনচক্ষুর আড়ালে বিচারের ব্যবস্থা তৈরি হয়। দেশদ্রোহের আইন আরো শক্ত হয়।
চীন ও হংকংয়ের নির্যাতিত শিল্পীরা
চীনের মূল ভূখণ্ডের শিল্পীদের মতোই হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি শিল্পীরাও নিজেদের সৃজনশীলতায় লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছেন৷ নীচের ছবিঘরে থাকছে শিল্পের কারণে বেইজিংয়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া কিছু শিল্পীর কথা৷
ছবি: Richard Shotwell/Invision/AP/picture alliance
লুই জিয়াওবো
কারাভোগ করা অবস্থায় ‘চীনে মৌলিক মানবাধিকারের জন্য দীর্ঘ অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ’ ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান লুই জিয়াওবো৷ চীনা এই লেখক, সমালোচক, দার্শনিক ও মানবাধিকারকর্মী একধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ চীনা কমিউনিস্ট শাসকদের সবচেয়ে বড় সমালোচক ও সবচেয়ে বিখ্যাত রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে৷ ২০১৭ সালে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন তিনি৷
ছবি: picture alliance / dpa
কেসি ওয়ং
সম্প্রতি হংকং ছেড়ে তাইওয়ানে পাড়ি জমিয়েছেন কেসি উওং৷ শৈল্পিক অনুভূতি প্রকাশে বাধাকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি৷ রাজনৈতিক পারফরম্যান্স আর্টের জন্য খ্যাত এই শিল্পী তিয়েন আনমেন হত্যাকাণ্ড এবং চীনা সেন্সরশিপের মতো বিষয় নিয়ে পারফর্ম করেছেন৷ ছবিটি ২০০৮ সালে ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ নামের একটি পারফরম্যান্সের৷ এই পারফর্ম্যান্স চলাকালে তিনি লাল রঙের খাঁচায় বন্দি অবস্থায় চীনের জাতীয় সঙ্গীত বাজান৷
ছবি: ANTHONY WALLACE/AFP
অ্যান্থনি উওং
অ্যান্থনি উওং (বামে) হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের একজন সমর্থক৷ ২০১৮ সালে এক উপনির্বাচনে ‘আ ফরবিডেন ফ্রুট পার ডে’ (প্রতিদিন একটি করে নিষিদ্ধ ফল) শিরোনামের গান গেয়ে ব্যাপক আক্রোশের শিকার হন৷ হংকংয়ের দুরিনীতি বিরোধী সংস্থা ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অ্যাগেনস্ট করাপশন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করেছে৷
ছবি: Alvin Chan/SOPA/Zuma/picture alliance
ডেনিসে হো
২০১৪ সালে হংকংয়ে আমব্রেলা মুভমেন্টে যোগ দেয়ার জন্য ক্যান্টোপপ গায়িকা, অভিনেত্রী এবং গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারী ডেনিসে হোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে৷ ২০১৯ সালে একটি টেড টকে তিনি বলেন, স্বৈরাচার সৃষ্টিশীলতাকে টেক্কা দিতে পারে না৷
ছবি: Asanka Ratnayake/Getty Images
আই ওয়েইওয়েই
সমসাময়িক শিল্পী এবং রাজনৈতিক সমালোচক আই ওয়েইওয়েইকে ২০১১ সালে কর ফাঁকির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়৷ ৮১ দিন কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে কারাভ্যন্তরের ভয়াবহতার বর্ণনা দেন তিনি৷ ওয়েইওয়েই বলেন, ‘‘আমার শিল্পের যদি কোনো অর্থ থেকে থাকে, সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য৷ যদি দেখি কর্তৃত্ববাদের কবলে কেউ হয়রানি হচ্ছে, আমি তার স্বাধীনতা রক্ষার সৈনিক হতে চাই৷
ছবি: Federico Gambarini/dpa/picture alliance
ঝো চিং
‘নিষিদ্ধ’ বিষয়ে লেখালেখি করে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক ঝো চিংকে বেশ বিপদেই পড়তে হয়েছে৷ ২০১১ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘চীনে সত্য জানতে চাওয়ার মানুষদের জীবনে অশেষ দুর্দশা নেমে এসেছে৷ সত্য জানা একজন সাধারণ মানুষও যদি তা প্রকাশ্য়ে বলে, তাকে তার চাকরি বা পরিবারকে হারাতে হতে পারে৷ সত্য বলা লেখকের নিত্যসঙ্গী কারাদণ্ডের হুমকি৷ একজন সত্য বলা কর্মকর্তা তার জীবন হারাতে পারেন৷’’
ছবি: Ai Weiwei/Zhou Qing
বাদিউচাও
এটি অবশ্য চীনের বিখ্যাত রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট, শিল্পী ও অধিকারকর্মীর আসল নাম নয়৷ ২০০৯ সালে তিনি সাংহাই ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় বাস করতে শুরু করেন৷ কিন্তু তারপরও নিজের পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে বাদিউচাও নামকেই বেছে নিয়েছেন৷ স্যাটায়ার ও পপ সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রোপাগান্ডার সমালোচনা করেন তিনি৷ তার সমালোচনার অন্যতম লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং৷
ছবি: Libor Sojka/Ctk/dpa/picture alliance
ক্লোয়ে ঝাও
২০২১ সালে সেরা পরিচালক হিসেবে গোল্ডেন গ্লোব জেতার পর চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বেইজিংয়ে জন্ম নেয়া ক্লোয়ে ঝাওকে ‘চীনের গর্ব’ বলে উল্লেখ করেছিল৷ কিন্তু এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার নামের উল্লেখ করা হলে সেগুলোও মুছে ফেলা হতে থাকে৷ ধারণা করা হয় ২০১৩ সালে ফিল্মমেকার ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চীনে সবখানেই মিথ্যের ছড়াছড়ি’৷
ছবি: Richard Shotwell/Invision/AP/picture alliance
8 ছবি1 | 8
এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনের রাস্তা থেকে কার্যত সরে এসেছে হংকং। এবছর গণতন্ত্র দিবস প্রায় কোথাও পালিত হচ্ছে না। কিছু জায়গায় প্রতীকী উৎসব পালনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে রাষ্ট্র।
হংকংয়ের চিফ এক্সিকিউটিভ জন লি জানিয়েছেন, ''এখন হংকংয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে।'' তার মতে, এখন প্রতিবাদের সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। লি মনে করেন, এর ফলে হংকংয়ে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হংকংয়ের এক বাসিন্দা ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''একটা সময় ছিল যখন আমরা বিশ্বাস করতাম সরকারের কাছে পরিবর্তনের আর্জি জানানো যায়। আমরা মিছিল করতাম, প্রতিবাদ করতাম। এখন সেই দিনগুলোকে সোনালি দিন মনে হয়। ২০২০ সালের পর থেকে মিছিলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এখন যা অনুষ্ঠান হয়, তা প্রতীকী।''
বস্তুত, যে সংগঠনগুলি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হতো, তারাও একে একে সংগঠন বন্ধ করে দিয়েছে। শেষ যে সংগঠনটি অবশিষ্ট ছিল, তার নাম দ্য লিগ অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস। ৩০ জুন এই সংগঠনটিও বন্ধ হয়ে গেছে। সংগঠনের প্রধান চ্যান পো-ইং জানিয়েছেন, ''সদস্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এই করুণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।''
বস্তুত, পরিবর্তন এবং গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে হংকং বন্দি হয়েছেন দশ হাজার ২০০ মানুষ। এর মধ্যে ৩০০ জনের বিচার চলছে জাতীয় নিরাপত্তার মামলায়। প্রতিবাদ করলেই গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিবাদী সংগঠনগুলি।
একদল ছাত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছে, কয়েকদিন আগে তাদের একটি স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বলা হয়। পরে তারা জানতে পারে, ওই অনুষ্ঠানটি ১ জুলাইয়ের জন্য আগে থেকে রেকর্ড করা হচ্ছে।
এস রিপ্লে/এসজি