প্রায় এক লাখ কল, আট হাজার মৌখিক টেলিফোন অভিযোগ৷ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগের জন্য হটলাইন চালুর পর এই হলো অবস্থা৷ এর থেকে ২৫০টি অভিযোগ যাছাইবাছাই করে তদন্ত করবে দুদক৷ ওদিকে অভিযোগ এসে চলেছে এখনও৷
বিজ্ঞাপন
দুদকে চিঠির মাধ্যমে বা সরাসরি অভিযোগ করার সুযোগ আগেও ছিল৷ দুদকের সামনে আছে অভিযোগ বাক্স৷ কিন্তু তাতে তেমন অভিযোগ জমা হতো না৷ তাছাড়া অভিযোগগুলো নিয়ম করে মনিটরিং-এরও ব্যবস্থাও ছিল না৷ কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে ২৭ জুলাই থেকে৷ ঐ দিন দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দেয়ার জন্য টেলিফোন হটলাইন চালু করে৷ সংবাদমাধ্যম তা ব্যাপকভাবে প্রচারও করা হয়৷ ভুক্তভোগী নগরিকরা যাতে অভূতপূর্ব সাড়া দেন৷
দুদক জানায়, সাত কর্মদিবসে প্রায় ৯২ হাজার কল এসেছে হটলাইনে৷ এর মধ্যে আট হাজারেরও বেশি কল রিসিভ করে কথা বলেছেন দুদকের দায়িত্বপ্রাপাপ্ত কর্মকর্তারা৷ তারমধ্যে বাছাই করে ২২৫টি থেকে ২৫০টি অভিযোগ তদন্তের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে৷ তবে এখনও প্রতিদিন গড়ে কল আসছে ১৩ হাজারেরও বেশি৷
এটা দুর্নীতি দমনে কতটা সহয়ক হবে সেটা পরের প্রশ্ন: প্রণব কুমার ভট্টাচার্য
যেভাবে কাজ করে হটলাইন:
দুদকের হটলাইন টেলিফোন নাম্বারটি হলো:১০৬৷ এটি একটি হান্টিং নাম্বার৷ একইসঙ্গে ৩০টি ফোন কল করা যায় এই নম্বরে৷ এর সঙ্গে কম্পিউটার সংযুক্ত করা৷ তাই কোনো কল রিসিভ করা না গেলে যিনি ফোন করেছেন তাঁর নাম্বারসহ কল রেকর্ড হয়ে যায়৷ আর যাঁদের ফোর রিসিভ করা হয়, তাঁদের কথোপকথনও রেকর্ডে থাকে৷ দুদকের উপ-পরিচালক এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমাদের একটি কল সেন্টার আছে এবং এই কল সেন্টারে কমপক্ষে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা কাজ করছেন৷ ছুটির দিন বাদে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোট ২০ জন কর্মকর্তা কাজ করেন এই কল সেন্টারে৷’’
তিনি আরো জানান, ‘‘যেসব কল রিসিভ করা হয় তাদের মধ্যে যেসব অভিযোগ দুর্নীতি সংক্রান্ত নয়, সেগুলো কোথায় করতে হবে তার পরামর্শ আমরা দেই৷ আর দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগগুলো আমরা বিস্তারিত নিই৷ আমরা দুর্নীতির যেসব অভিযোগ পেয়েছি, তার মধ্যে যাচাইবাছাই করে অন্তত ২২৫টি অভিযোগ তদন্তের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে৷’’
এই অভিযোগগুলো নিয়ে কী করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের একটি যাচাইবাছাই কমিটি আছে৷ তারা এখন এগুলো দেখবেন, কীভাবে তদন্ত করা যায় তার নির্দেশনা দেবেন৷ তারপর তদন্ত শুরু হবে একটা চলমান প্রক্রিয়ায়৷’’
দুর্নীতিগ্রস্ত সব বিশ্বনেতারা
দুর্নীতি, ঘুস ও ক্ষমতার অপব্যবহার৷ চলুন জেনে নেয়া যাক, গত কয়েক বছরে কোন কোন বিশ্বনেতার বিরুদ্ধে এ সব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Peres
লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা, ব্রাজিল
লুলার বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের৷ ঘুস গ্রহণের মামলায় আগেই সাড়ে নয় বছরের জেল হয়েছিল৷ তবে ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা লুলা আপিল করেছিলেন৷ শুক্রবার তাঁকে কুরিচিবা শহরের পুলিশ সদরদপ্তরে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন ব্রাজিলের ফেডারেল বিচারক৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Peres
পার্ক জিউন-হাই, দক্ষিণ কোরিয়া
২০১৬ সালে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির অভিযোগে বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন পার্ক জিউন-হাই৷ চাঁদাবাজি, ঘুস ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মামলা শুরু হয়েছিল তারপর৷ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার আদালত৷
ছবি: Getty Images/A.Young-Joon
ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ দে কির্সনের, আর্জেন্টিনা
প্রথমে ফার্স্ট লেডি এবং পরে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট (২০০৭ থেকে ২০১৫) হওয়া ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ কির্শনার ২০১৬ সালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন৷ পছন্দের ঠিকাদার কোম্পানিকে সরকারি নির্মাণ কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে, যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন৷ তিনি রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইছেন৷ কেউ কেউ বলছেন, তিনি এলে এসব অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/L. La Valle
ইহুদ ওলমের, ইসরায়েল
২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা ওলমের ২০১৪ সালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন৷ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর জেল হয়৷ অবশ্য পরের বছরেরর জুলাই মাসে ছাড়াও পেয়ে যান৷ জেলে যাওয়া ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম৷ পরে তাঁকে অনুসরণ করেন বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু৷
ছবি: Reuters/O. Zwigenberg
আদ্রিয়ান নাসটাসে, রোমানিয়া
তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে ২০১২ সালে এবং এরপর দু’বছরের জন্য জেলও খাটেন৷ রোমানিয়ান রেভোলিউশনের পরের ২৩ বছরে তিনিই প্রথম কোনো সরকার প্রধান, যাঁকে জেলের ভাত খেতে হয়েছে৷ আদ্রিয়ান নাসটাসে রোমানিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত৷
ছবি: Getty Images/AFP/
চার্লস জি. টেলর, লাইবেরিয়া
নব্বইয়ের দশকে সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধের সময় নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে ২০১২ সালে ৫০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত৷ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের পর প্রথম আন্তর্জাতিক কোনো ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়া কোনো রাষ্ট্রপ্রধান টেলর৷ ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. van Weel
6 ছবি1 | 6
তিনি বলেন, ‘‘আমরা তিনটি স্পেশাল টিম গঠন করেছি৷ এমন কোনো অভিযোগ যদি পাওয়া যায় যে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো প্রয়োজন, তাহলে তাঁরা অভিযান চালাবেন৷ যেমন ঘুস লেনদেনের সঠিক খবর পাওয়া গেলে আমাদের বিশেষ টিম অভিযান চালবে৷ হটলাইন চালুর পর এ রকম একটি খবর পেয়ে আমরা তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়েছিও৷ এই টিমের সদস্যদের জন্য তিনটি গাড়ি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিকসহ সবকিছু সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তত রাখা হয়েছে৷’’
কী ধরনের অভিযোগ আসে?
অভিযোগকরীরা ভূমি দখল, মাদক ব্যবসা, পুলিশ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা, পাসপোর্ট, ভিজিএফ, কাবিখা, কাবিটাসহ সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম ও নিয়োগের ব্যাপারে অভিযোগ জানাচ্ছেন৷ এমনকি গৃহকর্মী নির্যাতনের খবরও দেয়া হয়৷ তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করা হয় জমিজমা নিয়ে৷ জমি দখল, জমি উদ্ধার, জাল দলিলপত্র প্রভৃতি৷ কেউ কেউ তাৎক্ষণিক সমাধানও চান৷ কিন্তু দুর্নীতির বাইরে কোনো অভিযোগ নেয়ার সুযোগ থাকে না৷
প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, ‘‘কিন্তু আমরা মানুষকে নিরুৎসাহিত করি না৷ আমরা ধৈর্যের সঙ্গে অভিযোগ শুনি এবং কোনো পরামর্শ থাকলে তা তাঁদের জানিয়ে দিই৷ কোন অভিযোগ কোথায় করতে হবে তার পরামর্শও দিই৷ অভিযোগ শুনে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ জমিজমা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের নীতি হলো, কোনো অভিযোগকারীর সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না৷ কেউ খারাপ আচরণ করলেও, আমরা কেউ খারাপ ব্যবহার করবো না৷ বিনয়ের সাথে কথা বলবো৷ শুনবো বেশি, বলবো কম৷’’
দুদকের সিস্টেম এনালিস্ট রাজিব আহসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এই হটলাইন সিস্টেমটি পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়৷ যতজন কল করবেন সবার কল ডকুমেন্ট করা হবে৷ অর্থাৎ ফোন নাম্বারসহ কম্পিউটারে থেকে যাবে৷ আমরা এ পর্যন্ত ৮,২০০ জনের কল রিসিভ করে কথা বলেছি৷ বাকিদের কল রিসিভ করা হয়নি৷ মোট ২০ জন কর্মকর্তা কাজ করলেও প্রতি শিফটে কাজ করেন পাঁচজন৷ ফলে জনবল একটা বিষয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা বুঝতে পারছি মানুষ সরাসরি অভিযোগ জানাতে চায়৷ আর দুদকের প্রচলিত পদ্ধতিতে অভিযোগ করা অনেক জটিল৷ লিখতে হয়, সশরীরে আসতে হয়, জমা দিতে হয়৷ অথচ হটলাইন সিস্টেমে কোনো ঝামেলা নেই৷ কল করে মুখে অভিযোগ জানালেই হলো৷ এরপর তা দেখার কাজ আমাদের৷ তবে মানুষ এমন অনেক অভিযোগ করে, যা আমাদের কাছে করার কথা নয়৷ আসল কারণ হলো তারা অভিযোগ করার জায়গা পাচ্ছে না৷ এবার সুযোগ পেয়ে এখানেই সব অভিযোগ করছে৷’’
প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এটা দুর্নীতি দমনে কতটা সহয়ক হবে, সেটা পরের প্রশ্ন৷ তবে দুর্নীতি দমনে নাগরিকের সঙ্গে দুদকের সরাসরি যোগাযোগ অপরিহার্য৷ এই হটলাইন সেই সুবিধা করে দিচ্ছে৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার পাঁচ কৌশল
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইন্ডিকেটরস গ্রুপ’-এর পরিচালক আওগুস্তো লোপেজ-কার্লোস এক ব্লগ পোস্টে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার কয়েকটি কৌশল আলোচনা করেছেন৷ ছবিঘরে থাকছে সে’সব কথা৷
ছবি: Getty Images
সরকারি চাকুরেদের জন্য ভালো বেতন
যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁদের বেতন যদি খুব কম হয়, তাহলে আয় বাড়াতে তাঁরা ‘অনানুষ্ঠানিক’ পথ অবলম্বন করতে পারেন৷ বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকুরেদের কম বেতন ও দুর্নীতির মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷
ছবি: DW
অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা
যে সমস্ত দেশের নাগরিকদের সরকারি কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার সুযোগ আছে সেসব দেশে দুর্নীতি কম হয়৷ অর্থাৎ যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, শিক্ষিতের হার বেশি এবং সক্রিয় সুশীল সমাজ রয়েছে সেখানে দুর্নীতির হার কম৷ কেননা এর ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, সরকারের নীতি নিয়ে আলোচনা করা যায়৷
ছবি: Colourbox/Hin255
লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানো
বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদন বলছে, যে সব দেশে ব্যবসা শুরু করতে, সম্পত্তি নিবন্ধন করতে, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় জড়িত হতে নানা ধরনের সার্টিফিকেট, আইন, লাইসেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সে’সব দেশে দুর্নীতি বেশি হয়৷ তাই বিশ্বব্যাংকের এক গবেষক দুর্নীতির জন্ম দিতে পারে এমন আইনকানুন বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
ছবি: DW
ভর্তুকি নয়
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির নানা সমস্যা আছে৷ প্রায়ই এর সুবিধাভোগী হন ধনীরা৷ এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে কেনা জ্বালানি চোরাচালানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হন অনেকে৷ তাই ভর্তুকির মতো ব্যয়বহুল পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষদের অর্থ সহায়তা দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: DW/W.Jantschits
স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি যোগাযোগ যত কমানো যাবে, দুর্নীতি কমানো ততই সম্ভব হবে৷ এক্ষেত্রে বিভিন্নক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ সরকারি কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনে টেন্ডার আহ্বানের মতো বিষয়াদি চালু করলে দুর্নীতির সুযোগ কমবে৷