ভোটদানকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে তুলে ধরলেও ভোটগ্রহণের হার কমার আশঙ্কা রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার ইরানে সংসদ নির্বাচন৷ সে দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় সংসদ ও নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা সীমিত থাকলেও অপেক্ষাকৃত উদারপন্থি শক্তির জনপ্রিয়তা একমাত্র এই নির্বাচনের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়৷ সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনেই এবং সরাসরি তাঁর অধীনে রাখা শক্তিশালী রিপাবলিকান গার্ড বাহিনী এতকাল জনগণের রায় মেনে নিলেও কট্টর রক্ষণশীল শিবিরের সঙ্গে উদারপন্থি শিবিরের শীতল সংঘাত চলে এসেছে৷
এবার খামেনেই উদারপন্থিদের পুনরুত্থান ঠেকাতে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন৷ কট্টরপন্থিদের চ্যালেঞ্জ করতে পারেন, এমন হাজার হাজার প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে৷ ফলে ইরানের এবারের সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে৷ প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন৷ খামেনেই এবার ভোট দেওয়াকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে তুলে ধরেছেন৷ তবে সাধারণ মানুষ সর্বোচ্চ নেতার সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সম্পর্কে যে বিরক্ত, এই নির্বাচনে কিছুটা হলেও তার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ইরানে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থি শিবিরের অবস্থা এমনিতেই ভালো নয়৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে দেশে যে অর্থনৈতিক উন্নতির জোয়ার দেখা গিয়েছিল, তার ফলে প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি ও উদারপন্থি শিবিরের সুবিধা হয়েছিল৷ অন্যদিকে কট্টরপন্থিরা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল৷ কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে ইরানের অর্থনীতি প্রবল চাপের মুখে পড়েছে৷ অ্যামেরিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভারে নানা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে ইরান৷ পালটা পদক্ষেপ হিসেবে পরমাণু কর্মসূচি আবার চালু করায় আন্তর্জাতিক আঙিনায় আবার একঘরে হয়ে পড়ছে সে দেশ৷ দেশে ব্যাপক দুর্নীতিও মানুষের রোষের কারণ৷ কম ভোট পড়লে তাতে আখেরে ট্রাম্পের লাভ হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন কট্টরপন্থি নেতারা৷
এমন প্রেক্ষাপটে ইরানের কত মানুষ আদৌ ভোট দেবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে৷ ২০১৭ সালের নির্বাচনের পর থেকে দেশের অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় অনেকেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ৷ বেকারত্ব হু হু করে বেড়ে চলেছে৷ ইরানের এক তরুণ সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে বলেন, সে দেশের নির্বাচন আসলে অর্থহীন৷ এমনকি বিদায়ী সংসদের ৯০ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলছে৷ প্রেসিডেন্ট রোহানির এক উপদেষ্টা মানুষের উদ্দেশ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগের আবেদন জানিয়েছেন৷
নির্বাচনের আগেও ওয়াশিংটন তেহরানের উপর চাপ বাড়াতে পাঁচ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে৷ ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের নির্বাচনে কারচুপি বরদাস্ত করবে না বলে জানিয়েছে৷ ইরানের ‘গার্ডিয়েন কাউন্সিল' এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করে গণতন্ত্রের প্রতি অ্যামেরিকার অবজ্ঞা হিসেবে তুলে ধরেছে৷
ইরানের শত্রু-মিত্র
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সর্ম্পকের অবনতি ঘটে৷ প্রভাব পড়ে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেও৷ ছবিঘরে দেখুন ইরানের আজকের শত্রু-মিত্র কারা, কার সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Taherkenareh
যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Barria
ইসরায়েল: আন্তরিকতা থেকে অবিশ্বাস
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান (১৯৫০ সাল)৷ রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ছবি: AP
সৌদি আরব: ঘাড়ের কাছে শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াইয়ে ইরানের চিরশত্রু সৌদি আরব৷ ১৯৭৯ সালে তেহরানের ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ দুই দেশ কখনও সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও চলছে তাদের ছায়াযুদ্ধ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদির দুইটি তেলক্ষেত্রে হামলার পেছনে ইরান রয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়াদ৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Yorulmaz
রাশিয়া: দখলদার থেকে মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে আস্তানা গাড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েকবছর দখলদারি বজায় রাখে তারা৷ শাহের শাসনামলেও সম্পর্ক ভাল ছিল না৷ এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার৷
ছবি: AP GraphicsBank
ইউরোপ: আলোচনায় সমাধান
ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইউরোপের সঙ্গেও তেহরানের সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে ৷ তবে প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানির সময়ে এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়৷ পরমাণুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউ বরাবরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিয়ে আসছে৷ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তি বাতিল করলেও ইউরোপের দেশগুলো তা এখনও বজায় রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
চীন: অস্ত্র আর বাণিজ্যের সম্পর্ক
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে তেহরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল চীন৷ বেইজিংয়ের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র ক্রেতা দেশের একটি ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে হয়েছে চীনকে৷ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের পর চীন জানিয়েছে তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ে সম্পর্ক অটুট থাকবে৷
ছবি: AP / DW-Fotomontage
ইরাক: সর্ম্পকে নতুন মোড়
সাদ্দাম হোসেনের চালানো হামলা থেকে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত ছিল আট বছর৷ তবে বর্তমানে বাগদাদের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের৷ দেশটির একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান৷ এইসব গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷
কথিত আছে লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর উত্থান ইরানের মাধ্যমেই৷ তাদের মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আস্তানাগুলো৷ ২০১৮ সালে হেজবোল্লাহ ও তাদের জোট দেশটির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ যার মধ্য দিয়ে লেবাননের সরকারে ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে৷ এছাড়াও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী আর ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের মিত্রশক্তি৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
ভেনেজুয়েলা: শত্রু যখন একই
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি৷ ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন৷ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়৷ একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/ABACA/Iran Presidency
বাংলাদেশ: পাঁচ দশকের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক৷ বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকা এসেছিলেন৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ৷ অক্টোবরে বাকুতে ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসার রুহানি ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করেন৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.৭৭ কোটি ডলারেরর পণ্য রপ্তানি করেছে দেশটিতে৷