হামবুর্গে ছুরি হামলার সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আহমেদ নামের এক আশ্রয়প্রার্থীকে৷ শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দারা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করলেও কাজ হয়নি৷ এখন তাঁদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে অবিশ্বাস৷
বিজ্ঞাপন
যখনই আমি কোনো শরণার্থী শিবিরে যাই বা কেউ আমাকে রাস্তায় চিনতে পারে, সবাই আমাকে ঘিরে ধরে৷ আমি আরবি বলি৷ সেই জন্যই হয়ত আমার কাছে তাঁদের অনেক প্রশ্ন থাকে৷ কেন এখনও শরণার্থী বিষয়ক ফেডারেল অফিস থেকে ডাক পাইনি? কেন আমাকে শুধু এক বছর থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে, তিন বছর কেন নয়? কেন আমার পরিবারকে আমার সাথে এনে রাখতে পারব না? কেন আমি থাকার জায়গা পালটাতে পারব না? কেন আমি চাকরি বা অ্যাপার্টমেন্ট নিতে পারব না? কেন, কেন, কেন?
সম্প্রতি আমি হামবুর্গের এক হোস্টেলে গিয়েছিলাম৷ সেখানেও আমাকে একই ধরনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়৷ কিন্তু এবার আমার নিজেরই বিশাল এক প্রশ্ন ছিল৷ কে সেই ২৬ বছর বয়সি আশ্রয়প্রার্থী, যে সুপার মার্কেটে হামলা চালিয়ে একজন নিরপরাধ পথচারীকে হত্যা করল, গুরুতর আহত করল আরো চারজনকে?
হোস্টেলে ঢুকেই আমার ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে গেল৷ সারি সারি ১২ বর্গমিটারের রুম, মাঝখানে একটা রান্নাঘর৷
আহমেদ ‘খুবই ধার্মিক ছিল, খুব চরমপন্থি ছিল', জানালেন তার পাশের রুমের এক বাসিন্দা৷ কখনও কখনও তার রুমে ঢুকে তাকে গান শুনতে মানা করত আহমেদ৷ ‘এটা পাপ', বলত আহমেদ৷
ছুরি হামলার ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে সে জানালা দিয়ে চিৎকার করে হোস্টেলের অন্য বাসিন্দাদের নামাজ পড়তে আসতে বলত৷ কেউ কেউ বলছেন, তারা আহমেদের রুমে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর পতাকাও দেখতে পেয়েছেন৷ এক নারী বাসিন্দা বলছিলেন, ‘‘আমরা সবসময়ই জানতাম, সে আইএস-এর সদস্য৷''
এক তরুণ আমাকে বললেন, ‘‘আহমেদের ব্যাপারে আমরা অনেকবার হোস্টেল কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেছি৷ কিন্তু কেউ আমাদের কথা শোনেনি৷ তারা কখনই আমাদের পাত্তা দেয় না৷ তাদের কাছে আমরা শুধুই কিছু সংখ্যা৷''
হোস্টেল কর্তৃপক্ষ আমার কাছে স্বীকার করেছে, আহমেদের বিষয়ে তাদের আগেই জানানো হয়েছিল৷
মূল সমস্যা
হোস্টেলের বাসিন্দারা অবশ্য আহমেদকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুব বেশি আলোচনা করেন না৷ কেউ কেউ নিজেদের মত প্রকাশ করতে ভয় পান৷
হোস্টেলে বেশিরভাগেরই সারাদিন কিছুই করার থাকে না৷ কেউ গান শোনে, কেউ বাজার করে, কেউ কেউ রান্না করে, বাস্কেটবল খেলে৷ কেউ কেউ কাজ করে, তবে তা অবৈধভাবে৷ তবে বেশিরভাগই পরিবারের সাথে ইন্টারনেটে কথা বলে, সারাদিন শুয়ে বসে কাটায়৷
হামবুর্গ হামলাকারী নিয়ে প্রতিবেদন করতে গেলেও হোস্টেলে অবস্থানের প্রতিটি মুহূর্তে আমি সে ইচ্ছা হারাতে থাকি৷ আমার পর্যবেক্ষণ বলছিল, সমস্যাটা সেই হামলাকারী না, মূল সমস্যাটা আরো বড়, অন্য কোনো জায়গায়৷
জাফর আব্দুল করিম
01:07
জার্মান নীতির শিকার
অনেক শরণার্থীই ভেবেছিলেন দু'বছরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে – ভাষা, অ্যাপার্টমেন্ট, কাজ, পরিবার৷ কিন্তু সে চিন্তা অঙ্কুরেই ধ্বংস হয়েছে৷ এখনও চলছে নানা রকমের যাচাই-বাছাই৷ আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকে এখনও রেসিডেন্স পারমিটই পাননি৷ জার্মান ভাষা নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা৷ জার্মান ভাষা শিক্ষার কোর্সে তাঁদের মৌলিক কিছু জিনিস শেখানো হয়৷ কিন্তু ভালোভাবে ভাষা আয়ত্ত করতে তাদের জার্মানদের সাথে মিশতে হবে৷ সেটা তাঁরা পারছেন না৷
অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া জার্মানদের জন্যও সহজ বিষয় না৷ কোনো কোনো শহরে অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া লটারি জেতার মতোই ভাগ্যের ব্যাপার৷ যত দিন যায়, নিজের দেশে ফেলে আসা পরিবারকে নিয়ে ভয়ও ততই বাড়তে থাকে৷ ছয় মাস পর কী আছে ভাগ্যে, জানেন না তাঁরা৷
এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে, অনেকশরণার্থীই এখন নিজেদের পরিত্যক্ত ভাবেন৷ অনেকেই ভাবেন, তাঁদের কেউ সমর্থন করে না৷ একসময় ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের চিত্র আমরা দেখতে পেতাম৷ আমরা ক্ষুব্ধ হতাম৷ এখন আর সে ছবি আমরা দেখি না৷ কিন্তু এখনও শরণার্থী শিবিরে অপেক্ষা করে আছেন অনেকে৷
জাফর আব্দুল করিম/এডিকে
জার্মানিতে যেসব সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা হয়েছিল
গত আঠারো মাসে বেশ কয়েকবার জার্মানিতে সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা করা হয়েছে, যার অধিকাংশই অবশ্য পুলিশ আগেভাগে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়৷ আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস-এর অন্যতম টার্গেট এখন ইউরোপের এই দেশটি৷
ছবি: Reuters/M. Rehle
লাইপসিশ, অক্টোবর ২০১৬
লাইপসিসের পুলিশ দু’দিন ধরে তল্লাশি চালানোর পর ২২ বছর বয়সে সিরীয় শরণার্থী জাবের আল-বাকেরকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়৷ চেমনিৎসে তার অ্যাপার্টমেন্টে বিস্ফোরক এবং বোমা তৈরিত সরঞ্জাম পাওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ সন্দেহ করা হয় যে, বার্লিন বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছিল সে৷ গ্রেপ্তারের দুই দিন পর অবশ্য কারাগারে আত্মহত্যা করে এই সিরীয় শরণার্থী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Willnow
আন্সবাখ, জুলাই ২০১৬
গত জুলাই মাসে জার্মানিতে দু’টি হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস৷ দু’টি হামলাই শরণার্থীরা ঘটিয়েছিল৷ এর মধ্যে বাভারিয়ার আন্সবাখ শহরে একটি মিউজিক ফেস্টিভ্যালের প্রবেশ মুখে এক সিরীয় শরণার্থী বিস্ফোরণ ঘটালে ১৫ ব্যক্তি আহত হন৷ হামলায় হামলাকারী অবশ্য নিজেও প্রাণ হারায়৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/D. Karmann
ভ্যুয়র্ত্সবুর্গ, জুলাই ২০১৬
১৭ বছর বয়সি এক শরণার্থী ভ্যুয়র্ত্সবুর্গে একটি ট্রেনের মধ্যে কুড়াল ও ছুরি নিয়ে যাত্রীদের উপর হামলা চালায়৷ এতে হংকং থেকে আসা এক পর্যটক পরিবারের চার সদস্য এবং অন্য একজন আহত হন৷ পুলিশ হামলাকারীকে গুলি করে হত্যা করে৷ পুলিশ জানায়, হামলাকারী তথাকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সদস্য না হলেও এই জঙ্গি গোষ্ঠীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হামলা চালিয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Hildenbrand
ড্যুসেলডর্ফ, মে ২০১৬
ইসলামিক স্টেট-এর তিন সন্দেহভাজন সদস্যকে নর্থ রাইনওয়েস্টফেলিয়া, ব্রান্ডেনবুর্গ এবং বাডেন ভ্যুর্টেনবের্গ থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ কর্তৃপক্ষ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দু’জন ড্যুসেলডর্ফের শহরতলীতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করেছিল৷ অপরজন এবং ফ্রান্সে গ্রেপ্তারকৃত চতুর্থ জিহাদি বন্দুক ও বিস্ফোরক নিয়ে পথচারীদের হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে খবর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hitij
এসেন, এপ্রিল ২০১৬
এসেনে একটি শিখ মন্দিরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ বিস্ফোরণে তিন ব্যক্তি আহতও হন৷ সিসিটিভি ফুটেজ প্রচারের পর ১৬ বছর বয়সি এক সন্দেহভাজন নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে৷ আর অন্য তরুণ সন্দেহভাজনকে বাড়ি থেকে আটক করে স্পেশাল পুলিশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kusch
হানোফার, ফেব্রুয়ারি ২০১৬
১৬ বছর বয়সি জার্মান-মরোক্কান তরুণী সোফিয়া এস. হানোফার ট্রেন স্টেশনে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত করে৷ ধারণা করা হয়, ইসলামিক স্টেট-এর সদস্যরা তাকে এই হামলায় প্ররোচিত করেছিল৷
ছবি: Polizei
বার্লিন, ফেব্রুয়ারি ২০১৬
বার্লিনে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে ইসলামিক স্টেট-এর সন্দেহভাজন তিন আলজেরীয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ বার্লিনের প্রসিকিউটরের দপ্তরের তথ্য আনুযায়ী, রাজধানীতে হামলা করার জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
ওবারউরসেল, এপ্রিল ২০১৫
এশবর্ন-ফ্রাংকফুর্ট সিটি লুপ বাইক রেস বাতিল করে পুলিশ, কেননা তারা সন্দেহ করছিল যে সেই রেসে ইসলামিক স্টেট হামলা চালাতে পারে৷ হামলা পরিকল্পনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ৩৫ বছর বয়সি এক তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান এবং তাঁর ৩৪ বছর বয়সি স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে৷ বাইক রুটের কাছে তাদের বাড়ি থেকে বোমা তৈরির উপকরণও উদ্ধার করে পুলিশ৷