বিএনপির শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতা গ্রেফতার হওয়ায় বিদেশি কূটনীতিকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন৷ তারা যে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন তা সংঘাতের দিকে মোড় নেয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ তবে তারা হাল ছাড়েননি৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছে৷ ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রাবার্ট গিবসন শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মাঝে গঠনমূলক সংলাপের পরিবর্তে আমাদের অব্যাহতভাবে সংঘাতমূলক কার্যক্রম দেখতে হচ্ছে৷ এটি আমাকে হতাশ করেছে৷ কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে দুই দলের সংলাপের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে৷'' প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পাঁচ শীর্ষস্থানীয় নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর বৃটিশ হাইকমিশনার তাঁর এই উদ্বেগের কথা জানালেন৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এদিকে, ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা ভারত সফরের পর এখন তাঁর নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন৷ তবে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বর্তমান সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি মাঈনুল আলম৷ তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র সব দলকে সংঘাতের পথ পরিহার করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন৷''
এই কূটনৈতিক সংবাদদাতা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিক্রয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তারা বাংলাদেশে কোন সংঘাত দেখতে চায় না৷ মাঈনুল আলম বলেন, ভারতের রাষ্ট্রদূত এখন ঢাকায় রয়েছেন৷ তাই বর্তমান পরস্থিতিতে ভারতও তার অবস্থান দ্রুতই জানাবে বলে মনে করেন তিনি৷
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানান, দু'য়েকদিনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং চীন তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবে৷ বাংলাদেশের বর্তমান চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এসব দেশের কূটনীতিকরাও আগে থেকেই তাদের সক্রিয় মতামত জানিয়ে আসছিলেন৷ ধারণা করা হয়, অভ্যন্তরীণ চাপ ছাড়াও বিদেশি কূটনীতিকদের তত্পরতার কারণেই শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে ফোনালাপ সম্ভব হয়েছিল৷
জানা গেছে, শীর্ষ পাঁচ নেতাকে গ্রেফতারের পর বিএনপির অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে থাকলেও তারা বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন৷ আর সরকারের সঙ্গে কূটনীতিকরা যোগাযোগ করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন৷ তবে এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের৷ আগামী নির্বাচন এবং বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত একটি অবস্থানে আসবে কিনা তা দেখার রয়েছে৷ স্বয়ং ওবামা প্রশাসন চাইছে ভারতকে তার অবস্থান পরিস্কার করে বাগে আনতে৷ কারণ এই দু'টি দেশেরই বাংলাদেশে নানা স্বার্থ রয়েছে৷ তারা মনে করে, বাংলাদেশে জঙ্গি এবং মৌলবাদের উত্থান তাদের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর৷
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ প্রথম থেকেই চেষ্টা করছে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার৷ জাতিসংঘ মহাসচিব দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন৷ এছাড়া মহাসচিবের বিশেষ দূত ঢাকায় এসেও দুই নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন৷ কিন্তু দুই নেত্রীর ফোনালাপের পর পরিস্থিতি ভাল হওয়ার আশা থাকলেও হয়েছে উল্টো৷ তাই কূটনৈতিক মহলে হতাশা নামাই স্বাভাবিক৷
ইত্তেফাকের সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক মাঈনুল আলম জানান, ‘‘বাংলাদেশে সবদলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নানভাবেই সক্রিয় আছেন বিদেশি কূটনীতিকরা৷ তাদের এই তত্পরতা থামেনি৷''
বিরোধী পাঁচ নেতাকে আটকের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে কূটনীতিকরা হতাশা প্রকাশ করলেও সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তারা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন বলেই মনে করেন আলম৷ তাঁর মতে, তাদের সেই প্রচেষ্টা অল্প সময়ের মধ্যেই আরো স্পষ্ট হবে৷
এদিকে, ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অজানা ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷