ব্লাসফেমির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে মুক্তি পাওয়া আসিয়া বিবি'র আইনজীবী শনিবার দেশ ছেড়েছেন৷ মামলায় জেতার পর থেকে তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল৷
বিজ্ঞাপন
প্রায় এক দশক ধরে জেলে থাকা আসিয়া বিবি'র মামলাটি লড়ছিলেন সাইফ-উল-মুলুক নামের ঐ আইনজীবী৷ গেল সপ্তাহে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডাদেশ রহিত করে৷
এই রায়ের প্রতিবাদে কট্টর ইসলামপন্থিরা লাহোর ও ইসলামাবাদে মূল সড়কগুলো অবরোধ করে৷ তারা যেই বিচারকরা এই রায় দিয়েছেন এবং যাঁরা আসিয়াকে মুক্ত করতে সহযোগিতা করেছেন, প্রকাশ্যে তাঁুদের মৃত্যু কামনা করেন৷
আইনজীবীর দেশত্যাগ
‘‘এই অবস্থায় আমার পাকিস্তানে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে,'' বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন সাইফ-উল-মুলুক৷ ৬২ বছর বয়সি এই আইনজীবী শনিবার ভোরে ইউরোপের উদ্দেশে রওনা হন৷
‘‘আমাকে বেঁচে থাকতে হবে৷ আসিয়া বিবি'র জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে,'' বলেন তিনি৷
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ৷ সেখানে এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে ইসলাম ও নবীকে অবমাননার অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও উগ্রবাদীদের হাতে মৃত্যুর ভয়ে থাকতে হয়৷
সরকারের সঙ্গে চুক্তি
বিক্ষোভের মূল উদ্যোক্তা তেহরিক-ই-লাবায়েক (টিএলপি)-র প্রতিবাদের মুখে সরকার তাদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়৷ চুক্তির পর শুক্রবার রাতে বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করে টিএলপি৷
এএফপি বলছে, পাঁচ দফা সেই চু্ক্তিতে বলা আছে যে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলে সরকার আপত্তি তুলবে না৷
মুলুক বলেন যে, রায়ের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ ও তার ফলে এই চুক্তি দুর্ভাগ্যজনক হলেও পাকিস্তানে তা অপ্রত্যাশিত নয়৷
‘‘সরকার যেভাবে তাদের বিক্ষোভে সাড়া দিলো, তা সবচেয়ে বেদনাদায়ক৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়কেও বাস্তবায়ন করতে পারে না তারা,'' বলেন তিনি৷ যোগ করেন, ‘‘ন্যায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে৷''
সরকার ও প্রতিবাদকারীদের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, আইনি প্রক্রিয়া চলার সময় আসিয়া দেশ ছাড়তে পারবেন না৷
‘‘তাঁর জীবন তো একই রয়ে গেল৷ আগে কারাগারে ছিলেন, এখন নিরাপত্তার খাতিরে ঘরে বন্দি থাকবেন,'' মুলুক বলেন৷
আরেকবার আত্মসমর্পন
শনিবার পাকিস্তানের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ডন এই চুক্তির সমালোচনা করে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে৷ সেখানে এই চুক্তিকে ‘আরেকবার আত্মসমর্পন' বলে অভিহিত করা হয়৷
এর আগে, ২০১৫ সালে টিএলপি আরেকবার কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসলামাবাদের রাস্তাঘাট বন্ধ করে রেখেছিল৷ তখন তারা ব্লাসফেমি আইনের আরো কঠোর প্রয়োগ দাবি করেছিল৷
তাদের সেই প্রতিবাদের কারণে তৎকালীন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও একজন আসিয়া বিবি
আসিয়া বিবি পাকিস্তানের এক খ্রিষ্টান নারী৷৷ ২০১০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের এক আদালত ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ কে এই আসিয়া, কেনই বা তাঁর এই মামলা কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর?
ছবি: picture alliance/dpa
পানি নিয়ে বিরোধ
২০০৯ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলায় এক মাঠে কাজ করার সময় মহানবি হযরত মোহাম্মদকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে৷ মাঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কিছু নারী কাজ করছিলেন৷ আসিয়া বিবি পানি নিতে গেলে ‘অমুসলিম’ বলে তাঁকে পানির পাত্র ধরতে দেননি তাঁরা৷ তারপর তাঁরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আসিয়া বেগমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পর্শকাতর বিষয়
মাঠের বাকবিতণ্ডার পর আসিয়ার বাসায় কিছু ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ হামলা চালায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম৷ পরে পুলিশ আসিয়াকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্লাসফেমির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে৷ ৯৭ শতাংশ মুসলিমের দেশ পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননাকে বেশ স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বিতর্কিত আইন
১৯৮০ সালে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইন চালু করেন৷ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়৷ খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি ইসলামের সংখ্যালঘু গোত্র আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধেও এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়৷
ছবি: Noman Michael
রাষ্ট্র বনাম আসিয়া
২০১০ সালে এক আদালত আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে৷ বাদীর আইনজীবী অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু আদালত আসিয়ার ফাঁসির রায় দেন৷ ২০১০ সাল থেকেই আসিয়ার পরিবার ভয়ের মধ্যে বাস করছে৷ তখন থেকে আসিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর স্বামী আশিক মাসিহ আইনি-যুদ্ধ করে চলেছেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
গুপ্তহত্যার শিকার সমালোচকরা
২০১০ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসির আসিয়ার পক্ষে দাঁড়ান৷ ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারেরও দাবি তুলে তিনি৷ তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয় চরমপন্থিরা৷ ২০১১ সালে ইসলামাবাদে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তাসির৷ একই বছর ব্লাসফেমি আইনের আরেক সমালোচক তৎকালীন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন৷
ছবি: AP
হত্যাকারীকে সংবর্ধনা
তাসিরের হত্যার পর চরমপন্থি নেতা কাদরি রীতিমতো নায়কে পরিণত হন৷ তাকে কারাগারে নেয়ার সময় লাল গোলাপ ছিটিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে কাদরিকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ কাদরির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজার হাজার ইসলামপন্থি জড়ো হয়েছিলেন৷ এমনকি কাদরির নামে তার স্মরণে একটি মাজারও প্রতিষ্ঠা করে তার সমর্থকরা৷
ছবি: AP
বিচার বিভাগে ভীতি
ব্লাসফেমি আইনের সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে ভয় ঢুকেছে আইনজীবীদের মধ্যেও৷ আসিয়ার পক্ষে হাই কোর্টে লড়তে কোনো আইনজীবীই সম্মতি জানাননি৷ ২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে৷ ২০১৬ সালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও এক বিচারক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে তাতে অংশ নিতে রাজি হননি৷
ছবি: Reuters/F. Mahmood
আইনের খাড়া
অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সেক্যুলার মুসলিমদের এই আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়৷ এখনো এই আইনের আওতায় কারো বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা না হলেও ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে অনেক৷
ছবি: APMA
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন
পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন৷ গত কয়েক বছরে প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে অনেক খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে৷
ছবি: RIZWAN TABASSUM/AFP/Getty Images
ইসলামপন্থিদের হুমকি
আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায় পালটে গেলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির’ হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিশেষ করে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান- টিএলপি৷ দেশটির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আশংকা, বিচারকরা রায় পালটানোর সিদ্ধান্ত জানালে পুরো দেশজুড়ে তাঁদের ওপর নৃশংসতা শুরু হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. K. Bangash
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠন আসিয়ার মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে৷ আসিয়ার মেয়ে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করে এসেছেন৷২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের রায়কে ‘ভয়াবহ অবিচার’ আখ্যা দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিস আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানিয়েছে৷