হত্যা-নাশকতা-প্রতিবাদ: কোন পথে বাংলাদেশ
৪ আগস্ট ২০২৪বিশ্লেষকেরা বলছেন, ছাত্র-জনতার মনোভাব বুঝে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত৷ যত শক্তি প্রয়োগ করা হবে তত পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে মনে করেন তারা৷
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একদফা আন্দোলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা, হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে হত্যা অগ্নিসংযোগসহ নানা সহিংস ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে৷। রোববার একদিনে নিহত ৭০ জন ছাড়িয়ে গেছে৷
পরিস্থিতি সামলাতে রোববার সন্ধ্যা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ নির্বাহী আদেশে সোমবার থেকে সারাদেশে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যেই আরো নতুন কর্মসূচি দিয়েছে৷ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এক বিবৃতিতে এক দফা দাবিতে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন৷ সোমবার সারাদেশে যেসব এলাকায় আন্দোলনকারীরা নিহত হয়েছেন সেখানে ‘শহীদ স্মৃতিফলক উন্মোচন’ এবং একই দিন ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তিনি৷
লংমার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি মঙ্গলবারে দেয়া হয়েছিলো৷ পরে তা একদিন এগিয়ে আনা হয়৷
সোমবার সকাল ১১টায় ঢাকার শাহবাগে শ্রমিক সমাবেশ এবং বিকেল ৫টায় শহিদ মিনারে নারী সমাবেশের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া সারাদেশে বিক্ষোভ ও গণঅবস্থান কর্মসূচি চলবে বলে জানানো হয়েছে৷
‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে সারাদেশের ছাত্র-নাগরিক-শ্রমিকদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন৷ ওই দিন দুপুর ২টায় ছাত্র-জনতাকে শাহবাগে জমায়েতের ডাক দেয়া হয়েছে৷
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুরে নিরাপত্তাবিষয়ক জাতীয় কমিটির বৈঠক শেষে বলেছেন, ‘‘এখন যারা নাশকতা করছেন তারা ছাত্র না, সন্ত্রাসী৷ এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন করার জন্য আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই৷’’
তিনি আরো বলেন, এর যেসব জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে তার তদন্ত হবে৷ বলেন, ‘‘সব তদন্ত ও বিচার হোক এটা আমি চাই৷’’
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘সহিংসতায় যেসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেই হত্যা যারাই করুক, সে পুলিশ হোক, ছাত্র হোক, সে যেই হোক, সব তদন্ত হবে৷ তাদের বিচার হবে৷’’
কোন পথে দেশ
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে৷ তারপরও দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না৷ পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারসহ নয় দফা দাবি এখন এক দফায় পরিণত হয়েছে৷ তারা সরকারের পদত্যাগ চায়৷
কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী৷ তাদের দম্ভ, ঠিক সময়ে আলোচনা না করা, শক্তি প্রয়োগ, এই সব কিছুর কারণেই এমন হয়েছে। সরকার এখনো শক্তি প্রয়োগ করছে৷ এটা আরো চললে আরো পরিস্থিতি খারাপ হবে৷ দেশে নৈরাজ্য আরো বাড়বে৷”
ট্রান্সপারেন্সি ইটারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন,‘‘শুরু থেকেই বল প্রয়োগের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর দুই দিক থেকে বল প্রয়োগ করা হয়েছে। এক দিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। আরেক দিকে দলীয় নেতা-কর্মী মাঠে নামিয়ে। এখনো সেটাই করা হচ্ছে। বলপ্রয়োগের পথ থেকে তারা সরে আসেনি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘এত বেশি হত্যা, এত বেশি শিশু হত্যা, এত বেশি নৃশংসতা, সহিংসতা , নাশকতা এত অল্প সময়ে বিশ্বের আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নাই৷ এখানে তথ্য বিকৃতি করা হয়েছে৷ মিথ্যাচার করা হয়েছে৷ তাই এখন এটা আর কোটা সংস্কার দাবিতে সীমাবদ্ধ নাই৷ এখন মৌলিক অধিকার, সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ যুক্ত হয়েছে৷ এরমধ্যে শুরু থেকেই একটি ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে৷ প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের দুর্গন্ধ খুঁজে বের করা হয়েছে৷ সেটার উপস্থিতি কতটুকু তা বিশ্লেষণ করে বের করতে হবে৷ কিন্তু সেটা যে একেবারে অনুপস্থিত তা বলা যাবে না৷ কারণ এখন তো প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক পক্ষগুলো তাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করছে৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘হত্যা হচ্ছে , নাশকতা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ পোড়ানো ধ্বংস করা হচ্ছে৷ এই সব কিছুই বন্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এভাবে চলতে পারে না৷ এগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের৷’’
সমাধান কীভাবে
ড. আব্দুর রাজ্জাক খান মনে করেন, আলোচনা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না৷ শিক্ষার্থীরা পদত্যাগ দাবি করলেও সরকারের উচিত শক্তি প্রয়োগ না করে তাদের সঙ্গে বসা৷ তারা কেন পদত্যাগ চায় তা সরকারকে শুনতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় লাশ চায়৷ তারা লাশের ওপর রাজনীতি করে৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না ছাত্রদের আন্দোলনের ওপর ভর করে জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসুক৷ কিন্তু সরকারকে তো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে৷’’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক মনে করেন, সমাধান এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই আছে৷ বলেন, ‘‘তিনি এখন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ নিলেই পরিস্থিতি শান্ত হবে৷ এর বাইরে আর আমি কোনো পথ দেখছি না৷ এই সমস্যা সমাধানের আরো অনেক পথ শুরুতে ছিলো, কিন্তু সরকার সেই সুযোগ হারিয়েছে৷’’
কীভাবে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এই ক্ষমতা হস্তান্তরে সংবিধান কোনো বাধা হবে না৷ ৯০-এর গণঅভ্যূত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিলো সেইভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগ আছে৷’’
তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ আকড়ে থাকার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে৷ বলেন, ‘‘অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ আমরা আর কোনো মানুষের মৃত্যু চাই না৷’’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সমন্বয়কারী ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘আমরা একটা ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে আছি৷ আর এই পরিস্থিতির জন্য কে বা কারা দায়ী তা সবাই জানেন৷ বল এখন প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে৷ সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে সমাধানের পথ তাকেই বের করতে হবে৷’’
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘এখন যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে আর ওয়ে আউট দেখি না৷ এখন একটা ডেড এন্ডে আমরা আছি৷ সমাধানের তেমন কোনো পথ আমি দেখি না৷ এখন সরকার যদি মানুষের পালস বুঝে, তাদের ক্ষুব্ধতাকে অনুধাবন করে যদি রাষ্ট্র কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর বাধ্যবাধকতা এবং সুযোগ এই দুইটি বিষয় নিয়ে কাজ করে তাহলে একটা সমাধান আসতে পারে৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘সরকার আর এককভাবে কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না৷ দেশের যা পরিস্থিতি তা থেকে বের হয়ে আসতে জাতীয় সংলাপ প্রয়োজন৷ সেখান থেকে যে সমাধান আসবে সেটা মেনে নেয়া৷ সেটা সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে হতে পারে৷ তবে আমি জানি না সেটার সুযোগ এখন আর কতটা আছে৷ আর এই যে হত্যাকাণ্ড, এই যে সহিংসতা ও নাশকতা এর বিচার খুব দ্রুত করতে হবে৷’’
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘ছাত্ররা সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে এটাকে ভিন্নভাবে দেখার কিছু নাই৷ এই দাবি তারা করছে৷ তাই বলে আলোচনা করা যাবে না সেটা তো ঠিক নয়৷ তাদের সঙ্গে সরকারকে বসতে হবে৷ আলোচনা করতে হবে৷ সমাধানের পথ বের করতে হবে৷’’