হরতালের আগুনে পোড়া মানুষগুলো মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে একের পর এক বিদায় নিচ্ছেন৷ এপর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
কে, কখন মারা যান তা নিয়ে ভয়৷ চিকিৎসকরা আশ্বাস দিচ্ছেন৷ সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন৷ তবুও আশঙ্কা রয়ে গেছে৷ তাই বার্ন ইউনিটে রোগীদের আত্মীয়-স্বজনরা এখন সারাক্ষণ প্রার্থনা করছেন তাঁদের প্রিয়তমের প্রাণের জন্য৷
১০ নভেম্বর হরতালের রাতে মন্টু চন্দ্র পাল (৩৫) একটি লেগুনায় (হিউম্যান হলার) করে পুরান ঢাকা থেকে তাঁর বাসা নারায়ণগঞ্জে ফিরছিলেন৷ লক্ষ্মীবাজারের কাছে হরতাল সমর্থকরা লেগুনায় আগুন দিলে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে মন্টুও অগ্নিদগ্ধ হন৷ তাঁকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে৷ মন্টু শুক্রবার মারা যান৷ বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক ডা. পার্থ শংকর পাল ডয়চে ভেলেকে জানান, মন্টুর শরীরের প্রায় ৯০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল৷ তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে৷
মন্টুর স্ত্রী মঞ্জু পাল গত ৫ দিন হাসপাতালেই ছিলেন৷ আহত স্বামীকে ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি৷ কিন্তু স্বামী তাঁকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে গেল৷ তাঁর শোক আর বিলাপে শুক্রবার হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে৷ তাঁর একটিই প্রশ্ন, কেন মন্টুকে রাজনীতির বলি হতে হলো? সে জানায়, মন্টু পুরনো ঢাকায় একটি সোনার দোকানে কাজ করত৷ তাঁর আয়েই তাঁদের সংসার চলত৷ এখন সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই৷
হরতালের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহে হরতালের সূচনা করে জামায়াত-শিবির৷ এএফপির হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ই মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ হরতালের কিছু ছবি নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
বরিশালে অগ্নিসংযোগ
জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন ৪ই মার্চ বরিশালে মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করছে দলটির সমর্থকরা৷ এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হরতালের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপর হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা৷ উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা৷
ছবি: Reuters
সহিংসতায় নিহত কমপক্ষে ৮০
ঢাকায় ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কর্মী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করছে পুলিশ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ নিহতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছাড়াও পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী, নিরীহ পথচারী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকও রয়েছেন৷
ছবি: Reuters
ট্রেনে আগুন
ঢাকায় হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত একটি ট্রেনে আগুন লাগে৷ ছবিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জনতা৷ ঢাকা থেকে নোয়াখালিগামী ট্রেনটির তিনটি বগি আগুনে পুড়ে গেছে৷ রেলমন্ত্রী মাজিবুল হক ট্রেনে অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার
হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদ থেকে জামায়াত কর্মী সন্দেহে কয়েকজনকে আটকে করে পুলিশ৷ জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ৪ মার্চ অবধি প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters
অব্যাহত অগ্নিসংযোগ
হরতালের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অগ্নিসংযোগ৷ রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, গাড়িতে আগুন, ট্রেনে আগুন, মার্কেটে আগুন – চলতি হরতালে সবই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন হরতালের সহিংসতার ভিডিও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াতের সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters
‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের...
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন এই অটোরিকশা চালক৷ ২ মার্চ ঢাকায় জামায়াতের কর্মীদের ছোড়া ইটের টুকরায় গুরুতর আহত হন তিনি৷ অটোরিকশাও ভেঙ্গে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় এভাবেই ‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের৷
ছবি: Reuters
শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি’র তাণ্ডব
দুই মার্চ ঢাকায় এভাবেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কর্মীরা৷ সেদিন ঢাকায় মিছিল করেছিল বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা৷ পুলিশ অবশ্য বিরোধীদের কঠোর হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷
ছবি: Reuters
রাবার বুলেট, বুলেট
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বন্দুকে রাবার বুলেট ‘লোড’ করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তবে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন সংঘর্ষ চলাকালে সত্যিকারের বুলেটও ব্যবহার করে পুলিশ৷ এছাড়া হরতাল চলাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ আত্মরক্ষায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷
ছবি: Reuters
চোখের সামনে জ্বলছে আগুন
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি সমর্থকরা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে৷ ছবিতে পুলিশ একটি জ্বলন্ত গাড়ি দেখছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলমান সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷
ছবি: Reuters
একদিনে নিহত কমপক্ষে ৩৪
২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসির রায় ঘোষণার দিনে সহিংসতায় বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি৷ এদের মধ্যের ২৩ জন পুলিশ এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একদিনে এত সহিংসতা দেখেনি বাংলাদেশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
একইভাবে গত কয়েক দিনে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন গার্মেন্টস কর্মী নাসিমা বেগম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মোস্তাফিজুর রহমান, কিশোর মনির হোসেন এবং বোমার কারিগর বলে পরিচিত আবুল কাশেম৷
পোশাক কর্মী নাসিমা বেগম কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে হরতালের আগুনের শিকার হন৷ বাসে করে বাসায় ফেরার সময় মোহাম্মদপুর এলাকায় বাসে আগুন দেয়া হলে তিনি অগ্নিদগ্ধ হন৷ নাসিমা মারা যান বুধবার৷ তাঁর বড় বোন রহিমা বেগমও পোশাক কারখানায় কাজ করেন৷ তাঁদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে৷ রহিমা জানান তাঁর বোন নিজের পায়ে দাঁড়াতে ৬ মাস আগে ঢাকায় এসে পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিল৷ নাসিমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় সে প্রতিবাদী হয়ে ঢাকায় আসে৷ কিন্তু তাঁকে শেষ পর্যন্ত হরতালের আগুন বাঁচতেই দিল না৷ নাসিমার মৃত্যুর দিন তাঁর বোন রহিমা হাসপাতালে চিৎকার করে বলেন, ‘‘হরতালে ক্ষতি হয় গরিবের, মরলেও গরিব মরে, নেতাগো কিছু হয় না৷''
এপর্যন্ত ৩ সপ্তাহের হরতালে ঢাকায় ককটেল এবং যানবাহনে আগুন দেয়ায় ৭৮ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন৷ ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে এখন ২৮ জন চিকিৎসাধীন আছেন৷ ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, যাঁরা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন তাঁদের সবাই নিম্নবিত্তের৷ আর তাঁদের অনেকেই এখনো আশঙ্কামুক্ত নন৷ তিনি বলেন শরীরের ৪০ ভাগের বেশি পুড়লেই কাউকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন৷ এখন যাঁরা চিকিৎসাধীন আছেন তাঁদের বেশিরভাগেরই ৪০ ভাগের বেশি পুড়েছে৷ তাঁরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছেন সুস্থ করতে৷ এজন্য বার্ন ইউনিটের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে৷ তাঁর আশঙ্কা, যাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁদের বড় একটি অংশ পঙ্গু হয়ে যাবে৷
এদিকে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আহতদের প্রতিটি ক্ষণ এখন কাটছে আতঙ্ক আর ভয়ে৷ কোনো খবর শুনলেই তাঁরা দৌড়ে যান৷
আগুনে পোড়া ইব্রাহিমের স্ত্রী জানান, তিনি এখন দিন-রাত শুধু প্রার্থনা করছেন তাঁর স্বামী যেন সুস্থ হন৷ তাঁকে যেন আর কোনো খারাপ খবর শুনতে না হয়৷ গত সপ্তাহের হরতাল আপাতত শেষ হলেও হরতালের ভয়াবহতার শিকার এই মানুষগুলোকে টানতে হচ্ছে হরতালের জের৷