বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের ৩ দিনের হরতালে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে৷ রোববার সারা দেশে অন্তত ৫ জন নিহত হন৷ এছাড়া, ঢাকার বাইরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ এ অবস্থায় সংলাপ নয়, বরং ভয়াবহ সহিংসতার আশঙ্কা৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকাসহ পুরো দেশ এখন এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে৷ কখন কোথায় বোমা ফাটে, কোথায় হামলা হয় কেউ জানে না৷ তিন দিনের হরতালের প্রথম দিন রোববার, সারা দেশে পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ যশোর, পাবনা, ফরিদপুর, পিরোজপুর এবং বগুড়ায় ওই পাঁজজন নিহত হন বলে জানা গেছে৷ এছাড়া, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, হামলা এবং ট্রেন ও যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেও খবর৷
এইসব সহিংসতার মাঝে প্রধান দুই দলের নেতারা যেসব কথা বলছেন, তাতে দুই নেত্রীর শনিবারের ফোনালাপের পর আশার চেয়ে নিরাশার বার্তাই বেশি দিচ্ছে৷ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংলাপে সরকারের স্বচছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ তিনি বলেছেন, সরকার সংলাপের কথা বললেও তাদের অন্তর্গত স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দিহান বিএনপি৷ তাঁর অভিযোগ, সরকার একদিকে সংলাপের কথা বলছে ঠিকই৷ কিন্তু অন্যদিকে বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে৷
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যে সর্বদলীয় সরকারেরর প্রস্তাব দিয়েছেন ওটাকে ভিত্তি ধরেই আলোচনা এগিয়ে নিতে চায় সরকার৷ বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের ভিত্তি হবে সংবিধান৷
তবুও মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা দৌড়-ঝাপ অব্যাহত রেখেছেন৷ তিনি সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আবারো সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, সামনে আরো সংঘাতময় পরস্থিতি অপেক্ষা করছে৷ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কেউই ছাড় দিতে রাজি নয়৷ আওয়ামী লীগ মনে করে, সর্বদলীয় সরকারই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সুবিধাজনক৷ আর বিএনপি মনে করছে, তাদের ক্ষমতায় যেতে দরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ তাই তারা নিজেদের প্রস্তাবের বাইরে যেতে কোনোভাবেই রাজি নয়৷ সামনের নির্বাচনে এরা কেউই পরাজিত হতে চায় না৷ তাই তাদের মধ্যে ছাড় দেয়ার কোনো মানসিকতাই নেই৷
বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, সংলাপের পরিবেশই এখনো সৃষ্টি হয়নি, সফল হওয়া তো দূরের কথা৷ হয়ত কোনো চাপের কারণে মুখে সংলাপের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে বাস্তবে দুই দলই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে –এমনই মন্তব্য তাঁর৷