কোনোদিন হলিউডে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখেননি৷ নিজ দেশে অভিনয় করেই ছিলেন খুশি৷ কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে পিৎসা পৌঁছে দেয়ার কাজ করতে হয়েছিল সিরিয়ার জনপ্রিয় অভিনেতা জিহাদ আবদোকে৷ তিনি এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে জয় আবদো নামে পরিচিত৷
ছবি: Getty Images/AFP/V. Macon
বিজ্ঞাপন
জিহাদ আবদো আরব বিশ্বের চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয় অভিনেতা তিনি৷ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে আর পরে তাঁর জীবনে ঘটে যায় ব্যাপক পরিবর্তন৷ এই গৃহযুদ্ধ তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থেকে একেবারে মাটিতে নামিয়ে এনেছিল৷ আর এখন অন্য আর দশটা শরণার্থীর মতোই জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাঁকে৷ একটা সময় তো লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তায় রাস্তায় কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে আবদোকে৷
মাত্র কয়েক বছর আগে ৫৪ বছর বয়সি এই অভিনেতা যখন মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো দেশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন ভক্তদের ভিড় জমে যেত৷ রাস্তায় হাঁটা তাঁর জন্য ছিল মুশকিল৷ ৪৩টি চলচ্চিত্র এবং এক হাজারের বেশি টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি৷ কেবল তাঁর অভিনয়ের জন্য নয়, মনের কথা খোলাখুলি বলার জন্যও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি৷ সংবাদ সংস্থা এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আবদো বলেন, ‘‘আমার একটা সুন্দর জীবন ছিল, মানুষ আমাকে ভালোবাসতো৷ কেবল অভিনয়ের জন্য নয়, টকশোর জন্যও৷ এ সব শোয়ে আমি মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতাম৷''
সিরিয়া থেকে যেভাবে জার্মানিতে এসেছে একটি পরিবার
জীবন বাঁচাতে সিরিয়া থেকে জার্মানিতে এসেছেন অনেক শরণার্থী৷ জার্মানির ইমিগ্রেশন সেন্টার সেসব মানুষের সংগ্রাম নিয়ে আয়োজন করেছে একটি প্রদর্শনীর৷ সেখানেই জানা গেলো কোটো পরিবারের বেঁচে থাকার গল্প৷
ছবি: Sammlung Deutsches Auswandererhaus
আলেপ্পোয় সুখি সংসার
২০১৬ সালে তোলা কোটা পরিবারের ছবি৷ খলিল, তাঁর স্ত্রী হামিদা, সন্তান মান্নান, ডোলোভান, আয়াজ এবং নের্ভানা৷ তখন সিরিয়ায় কোনো গৃহযুদ্ধ ছিল না, ছিল না ধ্বংসলীলা৷
ছবি: Sammlung Deutsches Auswandererhaus
দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত
সিরিয়ায় ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর সময় খলিল কোটো সেদেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি শাখার প্রধান ছিলেন৷ গৃহযুদ্ধ শুরুর পর চাকুরি হারান এই ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার৷ একসময় খাদ্য এবং পানির অভাব প্রকট হতে থাকে৷ ২০১৪ সালের এপ্রিলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, তারা তুরস্ক চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে খলিলের মা বাস করতেন৷
ছবি: Sammlung Deutsches Auswandererhaus
ধাপে ধাপে আগানো
খলিল তুরস্কে কোনো কাজ খুঁজে পাননি৷ তাই ২০১৪ সালের জুলাইয়ে তাঁর পরিবার জার্মানিতে আসার সিদ্ধান্ত নেন৷ খলিলের ভাই ইউরোপে বাস করেন৷ তিনিই পরিবারটিকে জার্মানিতে আসতে উৎসাহ যোগান৷ শরণার্থী হিসেবে জার্মানিতে আসার পথে বুলগেরিয়ায় একটি শরণার্থী শিবিরে ছয় মাস কাটান কোটো পরিবার৷ এই চামচটি সেই শিবিরের এক স্মৃতিচিহ্ন৷
ছবি: Sammlung Deutsches Auswandererhaus
জার্মানিতে স্বাগতম
অবশেষে জার্মানিতে কোটো পরিবার৷ জার্মানির উত্তরের শহর ব্রেমেনে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে৷ সেখানকার এক নারী খলিলকে এই জিন্সের প্যান্টটি দিয়েছেন, জার্মানিতে পাওয়া তাঁর প্রথম পোশাক এটি৷
ছবি: Sammlung Deutsches Auswandererhaus
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
খলিলের সন্তানরা এখন জার্মান স্কুলে যাচ্ছেন৷ আর খলিল এবং তাঁর স্ত্রী হামিদা শিখছেন জার্মান৷ ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার জার্মানিতে একটি চাকরি পাবেন বলে আশা করছেন৷ সিরিয়ায় ফেলে আসা অতীত মাঝে মাঝে মনে করে আনন্দ খোঁজেন তারা৷ আয়াজের সিরিয়ার স্কুলের আইডি কার্ড এটি৷
ছবি: Sammlung Deutsches Auswandererhaus
5 ছবি1 | 5
সিরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘বাব আল হারা'-য় অভিনয়ের জন্য আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পান জিহাদ আবদো৷ এই ধারাবাহিকের দর্শক সংখ্যা ছিল ৫ কোটি৷ মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের আগুন লাগলে তার আঁচ ছড়িয়ে পড়ে সিরিয়ায়৷ আবদোর স্ত্রী চিত্রশিল্পী এবং মানবাধিকার আইনজীবী ফাদিয়া আফাশি সিরিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন৷ আসাদ বিরোধীদের সঙ্গে গোপন বৈঠকের সময় আটক করা হয় তাঁকে৷ পরে তিনি পালিয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে৷ যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক পলিসিতে পড়ালেখা শেষে আর সিরিয়ায় ফেরেননি ফাদিয়া৷ অন্যদিকে, একই সময় বিভিন্ন টকশোতে আসাদবিরোধী কথা বলায় আসাদের রোষানলে পড়েন আবদো৷ বৈরুতে এক সফরে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন নির্যাতনের অভিযোগ করেন তিনি৷ সিরিয়ায় ফেরার পর অজ্ঞাত কিছু মানুষ তাকে হুমকি দিতে থাকে৷ তাঁর গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেলা হয়৷ ঐ সাক্ষাৎকারের জন্য টিভিতে আসাদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয় তাঁকে৷
এটা এমন এক সময় যখন তাঁর কিছু বন্ধু-বান্ধব আসাদবিরোধী বক্তব্য রাখায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বা কাউকে গুম করা হয়েছে৷ ২০১১ সালের অক্টোবরে নিজের সব সম্পদ-সম্পত্তি ছেড়ে মেনোপোলিসে তাঁর স্ত্রীর কাছে চলে আসেন৷ স্বামী-স্ত্রী লস অ্যাঞ্জেলেসে আশ্রয়ের আবেদন জানান৷ কাজ খুঁজতে শুরু করেন তিনি৷ কিন্তু প্রথমেই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর নাম, জিহাদ নাম পরিবর্তন করে জয় নাম রাখেন তিনি৷ জিহাদ বলেন, ‘‘অনেকেই জানে না যে জিহাদ একটি খ্রিষ্টান নাম৷''
কিন্তু নাম পরিবর্তনের পরও একশ'রও বেশি অডিশন দিয়ে ব্যর্থ হন তিনি৷ বাধ্য হয়ে পিৎসা পৌঁছে দেয়ার কাজ নেন তিনি, সপ্তাহে ৩০০ মার্কিন ডলার আয় করতেন এই কাজ করে৷ তাই দিয়ে সংসার চালাতেন৷ অবশ্য তাঁর এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি৷ অবশেষে সুযোগ পেয়েছেন হলিউডে অভিনয়ের৷ তাও আবার নিকোল কিডম্যান এবং জেমস ফ্রাঙ্কোর মুভি ‘কুইন অফ দ্য ডেজার্ট'-এ৷ এ বছরই মুক্তি পাবে চলচ্চিত্রটি৷
ভালোবাসার জয় দেখালো সিরীয় যুগল
তাদের শহরে চলছে অনবরত বোমা বর্ষণ৷ তা সত্ত্বেও হোমসের এক জুটি হারতে মানতে রাজি হয়নি৷ বার্তা সংস্থা এএফপি-র আলোকচিত্রির তোলা তাদের কিছু দুর্লভ ছবি পাবেন এখানে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
‘সিরিয়াকে পুর্ননির্মাণ করছে ভালোবাসা’
জাফর মেরাই তোলা ছবিগুলোর চারপাশে চমৎকার কোনো স্থাপনা নেই, নেই সবুজ প্রকৃতির ছোয়া৷ বরং সেগুলো ঘিরে আছে যুদ্ধের বিভীষিকা৷ এসব ছবি মাসখানেক আগে তোলা৷ কিছু ছবি তিনি নিজেই ফেসবুকে দিয়েছেন, কিছু প্রকাশ করেছে ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি৷ শিরোনাম, ‘সিরিয়াকে পুর্ননির্মাণ করছে ভালোবাসা’৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে জীবন এবং ভালোবাসা
১৮-বছর বয়সি নাদা মেহরি এবং ২৭ বছর বয়সি হাসান ইউসুফ তাঁদের বিয়ের ছবি তোলার জন্য বেছে নিয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত হোমসের কিছু স্থান৷ আর মেরাই ছবির মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছেন ‘জীবন মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী’৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
চারিদিকে যুদ্ধে বিভীষিকা
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি, তাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক৷ দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমস মূলত আক্রান্ত হয়েছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত সেনাদের দ্বারা৷ কেননা, ২০১২ সালে আসাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল যেসব শহরে, তার একটি হোমস৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
সাদা পোশাক, ধূসর পাথরকুঁচি
একসময়ের সমৃদ্ধ শহরটির মাঝখানে বিয়ের সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন নাদা, তাঁর হবু স্বামী যুদ্ধের পোশাকে৷ যুদ্ধবিগ্রহের মাঝের সিরিয়ার তরুণ জুটিদের অবস্থা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ছবিতে৷ পেছনে দেখা যাচ্ছে গোলার আঘাতে জর্জরিত বিভিন্ন ভবন৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
অনবরত হামলা
হোমসে এখনো নিয়মিত হামলা চালানো হচ্ছে৷ গত ২৬ জানুয়ারি এক আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ২২ জন, আহত শতাধিক৷ সেই হামলার দায় অবশ্য স্বীকার করেছে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
হোমস একা নয়
গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলো আসাদের বাহিনীর পক্ষ নিয়ে সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে বিমান হামলা চালাচ্ছে৷ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশটির রাজধানী দামেস্ক থেকে ১৭০ মাইল দূরে একটি হাসপাতালে রাশিয়ার বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে নয় ব্যক্তি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আসাদ জানিয়েছেন যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন৷ তবে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আডেল আল-জুবের এক জার্মান পত্রিকাকে জানিয়েছেন, ‘‘ভবিষ্যতে বাশার আল-আসাদ বলে কেউ থাকবে না৷....সিরিয়ার দায়িত্ব আর তাঁর কাঁধে থাকবে না৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের মূল বিষয়
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ছিল সদ্য সমাপ্ত মিউনিখ সম্মেলনে অন্যতম আলোচনার বিষয়৷ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সেই সম্মেলনে বলেন, আমাদের মতে, রাশিয়া অধিকাংশ হামলা চালাচ্ছে সিরিয়ার আইনসম্মত বিরোধী গোষ্ঠীর উপরে৷ রাশিয়া অবশ্য দাবি করছে, জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে দমনে বিমান হামলা চালাচ্ছে তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
যুদ্ধের সময় ভালোবাসা
কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী মেরাই-এর ছবিতে আবেগপূর্ণ মন্তব্য করেছেন৷ একজন লিখেছেন, ‘নিজেকে ছবির বরের মতো মনে হচ্ছে৷’ আরেকজন লিখেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আপনার এবং সিরিয়ার সব মানুষের সহায় হোন৷ এ সব ছবি গোটা বিশ্বের সঙ্গে শেয়ার করায় ধন্যবাদ৷’
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
জীবন বয়ে যাওয়ার প্রমাণ
মেরাই-এর ছবিগুলো ফেসবুকে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে৷ অনেকে সেসব ছবি দিয়ে গ্যালারি, এমনকি ভিডিও তৈরি করেছেন৷ একজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, ‘‘মেরাই-এর ছবিগুলো প্রমাণ করছে যুদ্ধের মাঝেও মানুষের জীবন থেমে নেই, একরকম কেটে যাচ্ছে৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
10 ছবি1 | 10
আবদো জানান, তাঁর সব অভিনয়ই নিকোল কিডম্যানের সঙ্গে৷ নিকোল তাঁকে অনেক সহায়তা করেছেন বলেও জানান আবদো৷ পরিচালক ওয়ের্নার হেরজোগ জানতেনই না জিহাদ এতটা জনপ্রিয়৷ কিন্তু মরক্কোতে শ্যুটিং করার সময় তিনি জিহাদের জনপ্রিয়তা টের পান৷ কেবল চলচ্চিত্র নয়, অ্যামাজনের টিভি সিরিজ ‘দ্য প্যাট্রিয়ট' এবং ‘বন ভয়েজ'-এ সুযোগ পান তিনি৷ গত বছর তাকে টম হ্যাঙ্কস-এর সঙ্গে ‘ আ হলোগ্রাম ফর দ্য কিং'-এও অভিনয় করেন তিনি৷
তবে প্রায়ই হতাশা আব্দোকে ঘিরে ফেলে৷ সিরিয়ার যে অবস্থা তাতে কবে তিনি দেশে ফিরতে পারবেন জানেন না৷ তবে এটা জানেন, তাঁর কোনোকালেই হলিউডে অভিনয়ের ইচ্ছে ছিল না৷ ‘‘কিন্তু ভাগ্য যখন আমায় এখানে নিয়ে এসেছে, তখন নিশ্চয়ই এর কোনো কারণ আছে'', বলেন আবদো৷