1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হলি আর্টিজান: রাজনীতি চাইলেই আরও রবিউলের মৃত্যু ঠেকাতে পারে

নূর সিদ্দিকী
১ জুলাই ২০২৩

আজ পহেলা জুলাই। দিনটির বিভীষিকা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। কিন্তু আমার মনে পহেলা জুলাই গভীর ক্ষত তৈরি করে গিয়েছে ২০১৬ সালে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় পাঁচ জঙ্গিসহ ২৯ জন নিহত হয়৷ হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সাত জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ছবি: bdnews24.com

এইদিনে আমি হারিয়েছি আমার প্রিয়তম বন্ধু রবিউল করিমকে। রবিউল ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সহকারি কমিশনার বা এসি। গুলশানের হলি আর্টজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে রবিউল আত্মত্যাগ করেন। শুধু আজকের দিনেই নয় গেলো ৭ বছরের প্রতিটি দিনই রবিউল আমার মনের সঙ্গে কথা বলেছে। মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমরা একইসঙ্গে বড় হয়েছে। একই বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়েছি। রবিউল যতটা না আমার বন্ধু তারচে বেশি যেন ভাই। রবিউলের মা আমারও মা। রবিউলের একমাত্র ভাই আমারও।

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ'বা জেএমবি ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট সারাদেশে বোমা হামলা চালিয়েছিলো। সেসময় ৬৪টি জেলার মধ্যে বোমা বিস্ফোরণ হয়নি শুধুমাত্র মুন্সীগঞ্জ জেলায়। ওই ঘটনার মধ্য দিয়েই দেশে মৌলবাদী প্রবণতা ছাপিয়ে জঙ্গিবাদের বড় চেহারা দেখা দিয়েছিলো। মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি হয়েছিলো।

ঠিক তার আগের বছর অর্থাৎ ২০০৪ সালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছিলো। ২১শে আগস্টের সেই হামলা নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।

পরপর দুই বছরের এই দুটি বড় ঘটনায় জনমনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিলো তা কাটতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ রাজনৈতিকভাবেই ওই দুটি ঘটনা থেকে ফায়দা তোলা হয়েছে। আর কোন ঘটনার যখন রাজনৈতিক চরিত্র এবং সেই চরিত্রের ফলাফল পরিস্কার হয়ে যায় সাধারণ মানুষের কাছে তখন তা আর দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব তৈরি করতে পারে না। নিত্যদিনের ঘটনার মতই হারিয়ে যায়।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু মৌলবাদী বা গোড়া নয়। বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় সম্প্রীতির সংস্কৃতির নিবিঢ় পাঠ না থাকলেও এরসঙ্গে তাদের বসবাস আছে। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষটিও শহুরে মানুষের মতই ধর্মীয় সম্প্রীতি মানায় আধুনিক। এটি অনেক দেশের মানুষের কাছেই বিস্ময়কর মনে হতে পারে।

কিন্তু সেই দেশেই ১৭ই আগস্ট, ২১শে আগস্ট বা ১লা জুলাইয়ের ঘটনা ঘটে! এ নিয়েই মূলত আমার মনোবাসি রবিউলের সঙ্গে আলাপ হয়।

বাংলাদেশের সংবিধান যা ১৯৭২ সালে প্রণীত হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে। সেই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি ছিল – ১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র এবং ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা৷ অর্থাৎ সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রটি হবে ধর্ম নিরপেক্ষ বা এই রাষ্ট্রে সকল ধর্মের মানুষই সমান গুরুত্ব পাবে।

তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়৷ এরপর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান৷ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনার আগেই ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম'(দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) – এই কথাটি সংযোজন করা হয়৷

আর ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চরিত্রটিই পরিবর্তন করে দেন তখনকার স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ৷ তার শাসনামলে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ সংবিধানের ঐ অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে৷'

নূর সিদ্দিকী, সাংবাদিকছবি: Privat

এরশাদের সংবিধান সংশোধনী পাস হবার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরোধীতা করেছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াতে ইসলামও। দল তিনটির তখনকার বক্তব্যের মূল সুর প্রায় একই ছিলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তখনকার আটদলীয় জোটের প্রধান শেখ হাসিনা বলেছিলেন- অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মের রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে, ধর্মের নামে সংবিধান সংশোধনী জনগন মানবে না উল্লেখ করে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রধর্মের এই সংশোধনী বাতিল করা হবে বলেও ঘোষণা করেছিলেন শেখ হাসিনা।

আর বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন- ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলাম বলেছিল- ইসলামী আন্দোলন প্রতিহত করতেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে সংবিধানের পনেরতম সংশোধনীর মাধ্যমে বলা ১৯৭২এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এরশাদের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্র পরিচয়ের যে ঘোষণাটি সংবিধানে জুড়ে দেয়া হয়েছিল তা বাতিল করা হয়নি।

সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল চেয়ে এরশাদের আমলেই হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছিল। দীর্ঘ ২৮ বছর পর সেই মামলাও খারিজ হয়েছে হাইকোর্টে। এই মামলা নিয়েও বহু হঙ্কার শোনা গেছে দেশের ইসলামপন্থি দলগুলোর কাছ থেকে। প্রধান বিচারপতির কাছেও ওই মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেছে। আর ধর্মীয় বিধান বাতিলের মামলা খারিজ হওয়ার পর ইসলামিক দলগুলো বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম বলেছে তাদের দাবির মুখেই রিট খারিজ হয়েছে।

হলি আর্টিজানের ঘটনাকে অনেকেই আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা করেন। বলতে পারেন- এর সঙ্গে সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদির সম্পর্ক নেই। আমি তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। হলি আর্টিজানের ঘটনায় জড়িতরা কিংবা এরপর দেশের বিভিন্নপ্রান্তে জঙ্গি আস্তানার যে সন্ধান পাওয়া গিয়েছে এবং অভিযানের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগযোগ থাকতেও পারে, কিন্তু দেশিয় গোষ্ঠীগুলোর মদদ নেই তা বললে চোখ বন্ধ করে প্রলয় আড়ালের চেষ্টা হবে মাত্র।

প্রায় তিনযুগ ধরে প্রিয় সোনার বাংলার সংবিধান রাষ্ট্রধর্ম বয়ে বেড়াচ্ছে। তিনযুগে এই রাষ্ট্রধর্ম শব্দটি ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে আড়ালে আবডালে। পাখা গজিয়েছে সেই শব্দটির। ছানাপোনারাও বড় হয়েছে। তারা চোখ রাঙিয়েছে বহুবার। শেষমেষ স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর তাদের সাহসে ভর করে একেবারে নিরীহ ধর্মপ্রাণ ধর্মীয় সম্প্রীতির চর্চাকারী মানুষটিও নড়েচড়ে বসেছে। তারা রাষ্ট্রধর্মের শক্তিতে বড় হওয়া ভূত না তাড়িয়ে ভয় দেখানো সমর্থন করেছে প্রকাশ্যে না হলেও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মূলধারা গণমাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার আলাপ করেই দেখুন আপনি কতশত জনের বাক্যবাণের মুখে পড়েন। আপনার খুব কাছের বা পরিচিতজনও ধর্মের ঝাণ্ডা নিয়ে আপনার দিকে তেড়ে আসবে। তারাও আসবে যাদের সঙ্গে আপনার কখনো কোন মসজিদে অন্তত শুক্রবারের জুমার নামাজেও দেখা হয়নি। বিপদে না পড়লে যারা আল্লাহকে ডাকেন না, যারা ইসলামের আদর্শের ন্যূনতমও ধারণ করেন না, তারাও আপনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করবে। কেন?

রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা দলগুলো মূলত সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে মৌলবাদের প্রবণতাকেই প্রশ্রয় দিয়েছে। রাষ্ট্রের সামান্য প্রশ্রয়ের কী ভয়াবহ প্রভাব জনমনে পড়তে পারে তা আর সবিস্তারে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

এই হচ্ছে রবিউলের সঙ্গে আমার সাত বছরের আলাপের সারসংক্ষেপ।

এই দিনে প্রিয়বন্ধু রবিউলের আত্মার শান্তি কামনা করছি। রবিউলের মায়ের অবিরাম অশ্রুপাত, ওর স্ত্রী সন্তানদের মলিনমুখ কিংবা ওর ভাইয়ের অসহায়দশা কোনদিন কাটবে না। কারণ ওরা ওদের সন্তান, স্বামী, বাবা এবং ভাইকে হারিয়েছেন। ওদের ক্ষত সংবিধান বা রাজনীতি কোন কিছুর প্রলেপেই আড়াল হবে না। হবারও নয়। কিন্তু সংবিধান ও রাজনীতি চাইলেই আরও রবিউলের মৃত্যু ঠেকাতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।

রবিউলের মত আরও যারা বিভিন্ন জঙ্গি বা মৌলবাদী হামলায় বাংলাদেশে নিহত হয়েছেন তাদের আত্মারও মাগফেরাত কামনা করছি।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ