হলি আর্টিজান: রাজনীতি চাইলেই আরও রবিউলের মৃত্যু ঠেকাতে পারে
নূর সিদ্দিকী
১ জুলাই ২০২৩
আজ পহেলা জুলাই। দিনটির বিভীষিকা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। কিন্তু আমার মনে পহেলা জুলাই গভীর ক্ষত তৈরি করে গিয়েছে ২০১৬ সালে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় পাঁচ জঙ্গিসহ ২৯ জন নিহত হয়৷ হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সাত জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ছবি: bdnews24.com
বিজ্ঞাপন
এইদিনে আমি হারিয়েছি আমার প্রিয়তম বন্ধু রবিউল করিমকে। রবিউল ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সহকারি কমিশনার বা এসি। গুলশানের হলি আর্টজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে রবিউল আত্মত্যাগ করেন। শুধু আজকের দিনেই নয় গেলো ৭ বছরের প্রতিটি দিনই রবিউল আমার মনের সঙ্গে কথা বলেছে। মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমরা একইসঙ্গে বড় হয়েছে। একই বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়েছি। রবিউল যতটা না আমার বন্ধু তারচে বেশি যেন ভাই। রবিউলের মা আমারও মা। রবিউলের একমাত্র ভাই আমারও।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ'বা জেএমবি ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট সারাদেশে বোমা হামলা চালিয়েছিলো। সেসময় ৬৪টি জেলার মধ্যে বোমা বিস্ফোরণ হয়নি শুধুমাত্র মুন্সীগঞ্জ জেলায়। ওই ঘটনার মধ্য দিয়েই দেশে মৌলবাদী প্রবণতা ছাপিয়ে জঙ্গিবাদের বড় চেহারা দেখা দিয়েছিলো। মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি হয়েছিলো।
ঠিক তার আগের বছর অর্থাৎ ২০০৪ সালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছিলো। ২১শে আগস্টের সেই হামলা নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।
পরপর দুই বছরের এই দুটি বড় ঘটনায় জনমনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিলো তা কাটতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ রাজনৈতিকভাবেই ওই দুটি ঘটনা থেকে ফায়দা তোলা হয়েছে। আর কোন ঘটনার যখন রাজনৈতিক চরিত্র এবং সেই চরিত্রের ফলাফল পরিস্কার হয়ে যায় সাধারণ মানুষের কাছে তখন তা আর দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব তৈরি করতে পারে না। নিত্যদিনের ঘটনার মতই হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু মৌলবাদী বা গোড়া নয়। বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় সম্প্রীতির সংস্কৃতির নিবিঢ় পাঠ না থাকলেও এরসঙ্গে তাদের বসবাস আছে। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষটিও শহুরে মানুষের মতই ধর্মীয় সম্প্রীতি মানায় আধুনিক। এটি অনেক দেশের মানুষের কাছেই বিস্ময়কর মনে হতে পারে।
হোলি আর্টিজান হামলার টাইমলাইন
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় পাঁচ জঙ্গিসহ ২৯ জন নিহত হয়৷ হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
হামলা শুরু
২০১৬ সালের ১ জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে ঢাকার গুলশান দুই-এর ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর বাড়ির হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
হামলাকারী
সরাসরি হামলায় অংশ নেন পাঁচজন৷ তারা হলেন: রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ৷ শনিবার সকালে সেনা কমান্ডো অভিযানে তারা সবাই নিহত হন৷ ছবিতে হামলাকারী নিবরাস ইসলামকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Courtesy SITE Intel Group
নিহত
মোট ২৯ জন প্রাণ হারান৷ এর মধ্যে পাঁচ জঙ্গিসহ এক রেস্তোরাঁ কর্মী ও একজন শেফ কমান্ডো অভিযানে নিহত হন৷ বাকি ২২ জনের মধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারান দুই পুলিশ৷ তাঁরা হলেন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানীর ওসি মো. সালাহউদ্দিন খান৷ বাকি ২০ জনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি, নয়জন ইটালীয়, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয়৷ নিহত বাংলাদেশিরা হলেন ইশরাত আকন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্তা কবীর৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
কমান্ডো অভিযান
২ জুলাই শনিবার সকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান চালান৷ এতে পাঁচ জঙ্গিসহ সাতজন নিহত হন৷ অভিযান শেষে নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
মামলা দায়ের
২০১৬ সালের ২ জুলাই সন্ত্রাস দমন আইনে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস৷
ছবি: Reuters/M. Hossain Opu
চার্জশিট
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়৷ তদন্তে হামলায় ২১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে ১৩ জন কমান্ডো অভিযান ও পরবর্তীতে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন৷ সে কারণে ওই ১৩ জনকে বাদ দিয়ে আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/abaca
যাদের আসামি করা হয়নি
জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে (ছবি) গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে আসামি করা হয়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Asad
জঙ্গিবিরোধী অভিযান
বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত আটজন হলেন: তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান, তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান কবির ওরফে তারেক৷
ছবি: DW/ISPR
বিচারকাজ শুরু
চাজশিট দেয়ার প্রায় চার মাস পর ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করে৷ আদালত ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে ২৭ নভেম্বর রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
রায়
বিচার শুরুর এক বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আট আসামির মধ্যে সাত জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ তারা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ৷ মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেয়া হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
স্বীকারোক্তি
ছয় আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন৷ মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ জবানবন্দি দেননি৷
ছবি: bdnews24.com
11 ছবি1 | 11
কিন্তু সেই দেশেই ১৭ই আগস্ট, ২১শে আগস্ট বা ১লা জুলাইয়ের ঘটনা ঘটে! এ নিয়েই মূলত আমার মনোবাসি রবিউলের সঙ্গে আলাপ হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান যা ১৯৭২ সালে প্রণীত হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে। সেই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি ছিল – ১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র এবং ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা৷ অর্থাৎ সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রটি হবে ধর্ম নিরপেক্ষ বা এই রাষ্ট্রে সকল ধর্মের মানুষই সমান গুরুত্ব পাবে।
তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়৷ এরপর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান৷ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনার আগেই ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম'(দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) – এই কথাটি সংযোজন করা হয়৷
আর ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চরিত্রটিই পরিবর্তন করে দেন তখনকার স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ৷ তার শাসনামলে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ সংবিধানের ঐ অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে৷'
নূর সিদ্দিকী, সাংবাদিকছবি: Privat
এরশাদের সংবিধান সংশোধনী পাস হবার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরোধীতা করেছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াতে ইসলামও। দল তিনটির তখনকার বক্তব্যের মূল সুর প্রায় একই ছিলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তখনকার আটদলীয় জোটের প্রধান শেখ হাসিনা বলেছিলেন- অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মের রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে, ধর্মের নামে সংবিধান সংশোধনী জনগন মানবে না উল্লেখ করে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রধর্মের এই সংশোধনী বাতিল করা হবে বলেও ঘোষণা করেছিলেন শেখ হাসিনা।
আর বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন- ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলাম বলেছিল- ইসলামী আন্দোলন প্রতিহত করতেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে সংবিধানের পনেরতম সংশোধনীর মাধ্যমে বলা ১৯৭২এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এরশাদের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্র পরিচয়ের যে ঘোষণাটি সংবিধানে জুড়ে দেয়া হয়েছিল তা বাতিল করা হয়নি।
সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল চেয়ে এরশাদের আমলেই হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছিল। দীর্ঘ ২৮ বছর পর সেই মামলাও খারিজ হয়েছে হাইকোর্টে। এই মামলা নিয়েও বহু হঙ্কার শোনা গেছে দেশের ইসলামপন্থি দলগুলোর কাছ থেকে। প্রধান বিচারপতির কাছেও ওই মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেছে। আর ধর্মীয় বিধান বাতিলের মামলা খারিজ হওয়ার পর ইসলামিক দলগুলো বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম বলেছে তাদের দাবির মুখেই রিট খারিজ হয়েছে।
আলোচিত কয়েকটি জঙ্গি হামলা
১৯৯৯ সালে উদীচী দিয়ে শুরু৷ এরপর বেশ কয়েকটি আলোচিত হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: bdnews24.com
উদীচীর সমাবেশে হামলা
১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়েছিলেন৷ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে৷ হরকাতুল জিহাদ (হুজি) উদীচীর সমাবেশে হামলা করেছিল বলে পুলিশের ঐ ইউনিট জানিয়েছে৷ উপরের ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলা বর্ষবরণে হামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় শতাধিক আহতের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন৷ এই হামলার মধ্য দিয়ে হুজি তাদের শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছিল৷ হামলার দায়ে ২০১৪ সালে হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২৫ মে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল৷ এতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হয়েছিলেন৷ আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশত মানুষ আহত হন৷ হামলার দায়ে ২০০৮ সালে হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ (ছবি) তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১৭ সালের এপ্রিলে মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: A.M. Ahad/AP/picture alliance
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারান৷ ২০১৮ সালে মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়৷ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের জঙ্গিরা হামলায় অংশ নেয়৷ তবে ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
৬৩ জেলায় বোমা হামলা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷ এই হামলায় দুজন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হয়েছিলেন৷
ছবি: DW/H. U.R.Swapan
ব্লগার হত্যা
জঙ্গি হামলায় বেশ কয়েকজন ব্লগার ও মুক্তমনা নিহত হয়েছেন৷ ২০১৩ সালে আহমেদ রাজিব হায়দার হত্যা দিয়ে শুরু৷ এরপর ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন হত্যার শিকার হন৷ ২০২১ সালে অভিজিৎ হত্যার মামলার রায়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷ তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷
ছবি: Robert Richter
হোসেনি দালানে হামলা
২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর আশুরা উপলক্ষ্যে হোসেনি দালানের শোক মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা৷ এ ঘটনায় একজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ চলতি বছরের মার্চে দেয়া রায়ে জেএমবির দুই সদস্যকে দশ ও সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
শিয়া মসজিদে হামলা
২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর বগুড়ার এক শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ হামলার প্রায় ১৪ মাস পর আদালতে দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল জেএমবি এবং ইসলামি ছাত্রশিবির হামলায় অংশ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোলি আর্টিজানে হামলা
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হন৷ পাঁচজন জঙ্গি অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে বেকারিতে ঢোকার পর সবাইকে জিম্মি করেন৷ এরপর পুলিশ ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের দুই কর্মকর্তা জঙ্গিদের গুলি ও বোমার আঘাতে মারা যান৷ কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও জঙ্গিরা অন্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ জঙ্গিরা সবাই সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়৷ ইসলামিক স্টেট এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: bdnews24.com
জাফর ইকবালের উপর হামলা
২০১৮ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক তরুণ ছুরি নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায়৷ এই ঘটনায় এ বছরের এপ্রিলে ফয়জুল হাসান নামের একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ফয়জুল কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য কিনা তা প্রমাণিত হয়নি৷ তবে তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
হলি আর্টিজানের ঘটনাকে অনেকেই আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা করেন। বলতে পারেন- এর সঙ্গে সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদির সম্পর্ক নেই। আমি তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। হলি আর্টিজানের ঘটনায় জড়িতরা কিংবা এরপর দেশের বিভিন্নপ্রান্তে জঙ্গি আস্তানার যে সন্ধান পাওয়া গিয়েছে এবং অভিযানের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগযোগ থাকতেও পারে, কিন্তু দেশিয় গোষ্ঠীগুলোর মদদ নেই তা বললে চোখ বন্ধ করে প্রলয় আড়ালের চেষ্টা হবে মাত্র।
প্রায় তিনযুগ ধরে প্রিয় সোনার বাংলার সংবিধান রাষ্ট্রধর্ম বয়ে বেড়াচ্ছে। তিনযুগে এই রাষ্ট্রধর্ম শব্দটি ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে আড়ালে আবডালে। পাখা গজিয়েছে সেই শব্দটির। ছানাপোনারাও বড় হয়েছে। তারা চোখ রাঙিয়েছে বহুবার। শেষমেষ স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর তাদের সাহসে ভর করে একেবারে নিরীহ ধর্মপ্রাণ ধর্মীয় সম্প্রীতির চর্চাকারী মানুষটিও নড়েচড়ে বসেছে। তারা রাষ্ট্রধর্মের শক্তিতে বড় হওয়া ভূত না তাড়িয়ে ভয় দেখানো সমর্থন করেছে প্রকাশ্যে না হলেও।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মূলধারা গণমাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার আলাপ করেই দেখুন আপনি কতশত জনের বাক্যবাণের মুখে পড়েন। আপনার খুব কাছের বা পরিচিতজনও ধর্মের ঝাণ্ডা নিয়ে আপনার দিকে তেড়ে আসবে। তারাও আসবে যাদের সঙ্গে আপনার কখনো কোন মসজিদে অন্তত শুক্রবারের জুমার নামাজেও দেখা হয়নি। বিপদে না পড়লে যারা আল্লাহকে ডাকেন না, যারা ইসলামের আদর্শের ন্যূনতমও ধারণ করেন না, তারাও আপনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করবে। কেন?
রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা দলগুলো মূলত সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে মৌলবাদের প্রবণতাকেই প্রশ্রয় দিয়েছে। রাষ্ট্রের সামান্য প্রশ্রয়ের কী ভয়াবহ প্রভাব জনমনে পড়তে পারে তা আর সবিস্তারে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
এই হচ্ছে রবিউলের সঙ্গে আমার সাত বছরের আলাপের সারসংক্ষেপ।
এই দিনে প্রিয়বন্ধু রবিউলের আত্মার শান্তি কামনা করছি। রবিউলের মায়ের অবিরাম অশ্রুপাত, ওর স্ত্রী সন্তানদের মলিনমুখ কিংবা ওর ভাইয়ের অসহায়দশা কোনদিন কাটবে না। কারণ ওরা ওদের সন্তান, স্বামী, বাবা এবং ভাইকে হারিয়েছেন। ওদের ক্ষত সংবিধান বা রাজনীতি কোন কিছুর প্রলেপেই আড়াল হবে না। হবারও নয়। কিন্তু সংবিধান ও রাজনীতি চাইলেই আরও রবিউলের মৃত্যু ঠেকাতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
রবিউলের মত আরও যারা বিভিন্ন জঙ্গি বা মৌলবাদী হামলায় বাংলাদেশে নিহত হয়েছেন তাদের আত্মারও মাগফেরাত কামনা করছি।