কোভিড ধাক্কায় বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ৷ কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফসল এ যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল৷
বিজ্ঞাপন
একজন সংবাদকর্মী হিসেবে পেশাগত কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে এ বিষয়ে খবরগুলো গভীর মনযোগে দেখছিলাম৷ ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণ করার প্রায় দুই মাস আগে থেকে সীমান্তে সেনা জড়ো করছিল রাশিয়া৷ যা দেশটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা ছিল৷ কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ছাড়া আর কোনো বিশ্বনেতা বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব দিয়েছিল বলে আমার মনে হয়নি৷
রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের কারণ স্পষ্ট করেই জানিয়েছিল৷ কেইবা চায় প্রতিবেশীর ঘরে শত্রুর বসতি হোক৷ তাই ইউক্রেন যখন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে চাইলো, তখন রাশিয়া তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হলো৷ পূর্ব ইউরোপে ন্যাটের সম্প্রসারণ নিয়ে রাশিয়া অবশ্য আগে থেকেই জোর আপত্তি জানিয়ে আসছিল৷
১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং আরো ১১টি দেশ (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইটালি, কানাডা, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, আইসল্যান্ড এবং লুক্সেমবার্গ) মিলে নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো গঠন করে৷
১২ সদস্যের ন্যাটো এখন ৩০ সদস্যে পৌঁছেছে৷ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোর সীমান্ত মস্কোর দিকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে৷ তাই রাশিয়ার আশঙ্কা একেবারে অমূলক বলার সুযোগ নেই৷
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা কিন্তু চাইলে আলোচনার টেবিলে রাশিয়ার ওই শঙ্কা দূর করে বিরোধ মেটাতে পারতো৷ আমার অন্তত তাই মনে হয়৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ রাশিয়ার আক্রমণের পর এখন ইউক্রেনও ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ হারিয়েছে৷ তাহলে কেনো এই যুদ্ধ?
যুক্তরাষ্ট্র হয়তো চিরশত্রু রাশিয়াকে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল৷ অন্যদিকে, ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে প্রশ্ন গত কয়েক বছর ধরে উঠেছিল সেটাও এবার বন্ধ হবে৷ ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপের উপর যুক্তরাষ্ট্র নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়৷
বিশ্বে ২০২২ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০২২ সালে ঘটে যাওয়া কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Efrem Lukatsky/AP Photo/picture alliance
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা
২০২১ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন৷ সেই সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টসহ ইউরোপের অনেক নেতা যুদ্ধ লাগবে না বলে মত প্রকাশ করেছিলেন৷ কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে৷ তবে ক্রেমলিন ও সামরিক বিশ্লেষকদের অবাক করে দিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে ইউক্রেন এখন রাশিয়ার উপর মাঝেমধ্যে হামলা করছে৷
ছবি: Efrem Lukatsky/AP Photo/picture alliance
পাকিস্তানে তিন ঘটনা
১০ এপ্রিল জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান৷ এরপর ক্ষমতা নেয়া শাহবাজ শরিফের সরকার পতনের লক্ষ্যে কয়েকটি বিক্ষোভ করেন৷ নভেম্বরে ইমরান খানের উপর হামলা হয়েছিল৷ আইএমএফ আগস্টে পাকিস্তানের জন্য বেলআউট প্যাকেজের অনুমোদন দেয়৷ এরই মধ্যে বছরের মাঝামাঝি সময়ে বন্যায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তান ডুবে গিয়েছিল৷
ছবি: Abdul Majeed/Getty Images/AFP
ল্যাটিন অ্যামেরিকায় বামেদের জয়
এবছর হন্ডুরাসে সোশ্যালিস্ট সিওমারা কাস্ত্রো, কলম্বিয়ায় বামপন্থি গুস্তাভো পেট্রো ও ব্রাজিলে লুলা ডা সিলভা (ছবি) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন৷ এর আগে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু ও চিলিতে সোশ্য়ালিস্ট, মধ্য-বামপন্থি ও বামপন্থিরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন৷
ছবি: Andre Penner/AP Photo/picture alliance
ইরানে বিক্ষোভ
ঠিকভাবে চুল ঢাকা না থাকার অভিযোগে সেপ্টেম্বরে নীতি পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর মাহসা আমিনির মৃত্যু হলে ইরানজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়৷ বিক্ষোভ দমনে সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চারশ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ বিক্ষোভকারীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে৷
ছবি: UGC/AFP
করোনা ‘প্রায় শেষ’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেপ্টেম্বরে জানায় করানো মহামারির ‘শেষ দেখা যাচ্ছে’৷ বিভিন্ন দেশ লকডাউনের নীতিমালা, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি তুলে দিয়েছে৷ তবে চীনের কয়েকটি শহরে জিরো কোভিড নীতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷ দেশটির অর্থনীতির উপর এর প্রভাব পড়েছে৷ এছাড়া প্রভাব পড়েছে বিশ্বের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাতেও৷
ছবি: JEFF PACHOUD/AFP
দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি
প্রায় চার দশক পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে৷ করোনা কমে যাওয়ার পর পণ্যের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় ইউক্রেন যুদ্ধ ও চীনের জিরো কোভিড নীতির কারণে সরবরাহব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ায় পর্যাপ্ত সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না৷
ছবি: Frank Hoermann/SvenSimon/picture alliance
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ
ইউরোপে রেকর্ড পরিমাণ গরমের কারণে দাবানলে বন পুড়ে গিয়েছিল৷ নদীও রেকর্ড পরিমাণ শুকিয়ে গিয়েছিল৷ বন্যায় পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ ডুবে গিয়েছিল৷ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমে রেকর্ড খরায় ফসল উৎপাদন কমে গিয়েছিল৷ অন্যদিকে ফ্লরিডায় হ্যারিকেন আঘাত হেনেছিল৷ তবে নভেম্বরে কপ সম্মেলনে সাফল্যের কারণে গরিব দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা
চীনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার প্রতি সমর্থন, তাইওয়ানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা ও মেধাসত্ত্ব চুরির অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র৷ আগস্টে ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর ঐ এলাকায় চীন সামরিক মহড়া বাড়িয়েছে৷ এরপর নভেম্বরে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের সময় বাইডেন ও শি জিনপিং বৈঠক করে উত্তেজনা কমানোর অঙ্গীকার করেন৷
ছবি: Saul Loeb/AFP/Getty Images
আরবে প্রথম বিশ্বকাপ, আর্জেন্টিনার তৃতীয় শিরোপা
নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়৷ আরব অঞ্চলে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ ছিল এটি৷ বিশ্বকাপ শুরুর আগে পশ্চিমা গণমাধ্যমে কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা ও সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল৷ ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে ৩৬ বছর পর শিরোপা জিতে নেয় মেসির আর্জেন্টিনা৷
ছবি: Julian Finney/Getty Images
বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি পেরিয়েছে
১৮০৩ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা একশ কোটি পেরিয়েছিল৷ ২১৯ বছর পর এ বছরের ১৫ নভেম্বর বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি পেরিয়ে যায়৷
ছবি: Adek Berry/AFP/Getty Images
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনে ছিলেন তিনি৷ ৮ সেপ্টেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মারা যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ৷ বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি৷ হাঁটাচলা ও দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা হচ্ছিল তার৷ ১৯৫২ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনে তার অভিষেক ঘটেছিল৷
ছবি: Eddie Mulholland/REUTERS
পেলে
অনেকের মতে সর্বকালের সেরা ফুটবলার এডসন আরান্তেস ডো নাসিমেন্তো পেলে ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার মারা যান৷ ব্রাজিলকে তিন বার বিশ্বকাপ জেতানো এ ফুটবল কিংবদন্তি দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন৷
ছবি: Martin Hoffmann/IMAGO
12 ছবি1 | 12
যুক্তরাষ্ট্রের এই কূটনীতির বলির পাঁঠা হয়েছে ইউক্রেন৷ শুধু কী ইউক্রেন, নাকি পুরো বিশ্ব৷ বিপদে পড়েছে রাশিয়াও৷
খোদ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনও হয়তো ভাবেননি ইউক্রেন যুদ্ধ এত দীর্ঘায়িত হবে৷ সামরিক শক্তির বিচারে নেহাতই শিশু ইউক্রেন এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে৷ এ যুদ্ধের কারণে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে রাশিয়া৷
এদিকে, এই যুদ্ধ বিশ্ব কূটনীতিকে নতুন পথে চালিত করেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব এখন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে৷ তাইতো ওয়াশিংটনের ঘোর আপত্তি স্বত্তেও দেশটি তেল উৎপাদনকারী দেশের জোট ওপেক প্লাসকে নিয়ে তেল উৎপাদন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ যা রাশিয়ার পক্ষে গেছে৷
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব৷
ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মূল্যছাড়ের সুযোগ নিয়ে চীন ও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এ বছর কয়েকগুণ বেশি তেল কিনেছে৷ রাশিয়ার সঙ্গে চীনের মিত্রতা দীর্ঘদিনের৷ কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এক্ষেত্রে নামতে হয়েছে কূটনীতির জটিল খেলায়৷ যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু৷ এদিকে, রাশিয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক ভারতের৷ ভারত সরকার অবশ্য বলছে, তাদের কাছে দেশের স্বার্থ সবার আগে৷ তাই কোনো পক্ষ নিয়ে নয় বরং দেশের স্বার্থে তারা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বাড়িয়েছে৷
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই এবছর আরো একটি যুদ্ধের আশঙ্কার কালো মেঘ আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল৷ অগ্রীম ঘোষণা ছাড়াই গত অগাস্টের শুরুর দিকে তাইওয়ান সফরে যান যু্ক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি৷ যার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় চীন৷ যার জের এখনো চলছে৷ ২৫ ডিসেম্বরও চীনের কয়েকডজন যুদ্ধবিমান ও ড্রোন তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং সেদিনই চীন সরাসরি বলেছে, এটা তাদের ‘হামলার মহড়া' ছিল৷
তাই শুধু দীর্ঘায়িত ইউক্রেন যুদ্ধই নয় বরং কূটনীতির ব্যর্থতায় আরো একটি যুদ্ধ বেধে যাওয়ার শঙ্কা নিয়েই নতুন বছরে পা রাখছে বিশ্ব৷
যেমন করে কূটনৈতিক ব্যর্থতায় ভেস্তে যেতে বসেছে ইরান পরমাণু চুক্তি৷ তেহরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে ২০১৫ সালে যে চুক্তি হয়েছিল তার অস্তিত্ব এখন কেবলই কাগজেকলমে৷ বরং ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু' এই প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করে ইরান ও উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে৷ যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে ইরান ও উত্তর কোরিয়া৷ বিনিময়ে রাশিয়া তাদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে৷
উত্তর কোরিয়া তো এ বছরই নিজেদের পরমাণু শক্তিধর দেশ বলে ঘোষণা দিয়েছে৷ রেকর্ড সংখ্যায় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে৷ রাশিয়ার প্রযুক্তি সহায়তা পেলে ইরানের হাতেও পরমাণু অস্ত্র পৌঁছে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না৷
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে গেছে তুরস্ক৷ যারা এতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে অপাঙক্তেয় হয়েছিল৷ ন্যাটোর সদস্য হলেও তুরস্ক রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান যোগ্য লোক বলেই আমার মনে হয়৷ ফলে ইউরোপের কাছে হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন এই ‘একনায়ক'৷ ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিপদ যে ইউরোপের৷
বিশ্ব কূটনীতি মত এ বছর বাংলাদেশের কূটনীতিতেও বেশ টানাপোড়েন দেখা গেছে৷
বিশেষ করে বছরের একেবারে শেষদিকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিচার হাসকে নিয়ে ওয়াশিংটন-ঢাকা-মস্কো কূটনৈতিক নাটক বেশ জমে গেছে এবং এর মূল কারণ বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন বলেই আমার মনে হয়েছে৷
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আসন্ন৷ নির্বাচন ঘিরে প্রধান দুইদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশজুড়ে জনসংযোগ করছে৷ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তত ঘোলাটে হচ্ছে৷ বিশ্বমোড়লদের হস্তক্ষেপের খেলাও শুরু হয়ে গেছে৷
পিটার হাস ডিসেম্বরে বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় গেলে একদল লোক তাকে ঘিরে ধরে৷ নিরাপত্তা উদ্বেগে তিনি বৈঠক অসম্পূর্ণ রেখেই সেখান থেকে বেরিয়ে যান৷
পরে যুক্তরাষ্ট্রের নানা পর্যায় থেকে হাসের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের নানা পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়৷
এদিকে, পিটার হাসের এভাবে বিএনপি নেতার বাসায় যাওয়া পছন্দ হয়নি সরকার দলীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতার৷ তারা এ ঘটনাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করে বসেন৷ সেই সুযোগে দৃশ্যপটে হাজির হয় ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস৷ লম্বা বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপকে আধিপত্যবাদী বৈশ্বিক রাজনীতির প্রকাশ বলে অভিযোগ করে৷ বাংলাদেশসহ অন্য যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়া হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর বলেও জানায়৷ অথচ, তারাই কিন্তু প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করেছে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছে৷
বছরের প্রথমার্ধে জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারকে নিয়ে যে হইচই হয়েছিল তার কারণও অনেকটাই নির্বাচন৷ গত এপ্রিলে ট্র্যোস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন৷ সেখানে তিনি বলেছিলেন, ট্র্যোস্টার বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ এর মাধ্যমে বিএনপি হয়তো জার্মানির সমর্থন তাদের দিকে এটা বোঝাতে চেয়েছিল৷ কিন্তু তাতে পানি ঢেলে দেন খোদ জার্মান রাষ্ট্রদূত৷ পরে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, তাকে নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে তিনি অসন্তুষ্ট৷ কারণ, তারা তার বক্তব্য ঠিকভাবে উপস্থাপন করেনি৷
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অনেক কিছুর জন্য বহির্বিশ্বের উপর নির্ভর করতে হয়৷ ফলে রাজনীতিতে দেশের বাইরের হস্তক্ষেপও অনেক বেশি৷ নির্বাচনের আগে দিয়ে যেগুলো প্রকট হয়ে ওঠে৷
ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান দিনদিন গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে বলে আমার মনে হয়৷ আঞ্চলিক দুই প্রতিপক্ষ চীন এবং ভারত উভয় বাংলাদেশকে পাশে চায়৷মহামন্দার চোখ রাঙানি নিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন বছর৷ মন্দার ঝড় সামাল দিতে আঞ্চলিক দুই শক্তি চীন ও ভারত উভয়কে পাশে প্রয়োজন বাংলাদেশের৷ সঙ্গে নির্বাচনের বছরের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাকেও সামাল দিতে হবে৷ রোহিঙ্গা ইস্যুও ঘাড় থেকে নামানো যাচ্ছে না৷ কূটনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আসছে বছরে তাই অনেক মেপে পা ফেলতে হবে৷
বিদেশি দূতদের আলোচিত কথা, কাজ
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড আলোচনার জন্ম দিয়েছে৷ বিশেষ করে গত নির্বাচন নিয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূতের করা মন্তব্য বেশ আলোচিত হয়েছে৷
ছবি: CGS
‘রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল বলে শুনেছি’
১৪ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ‘‘গত (জাতীয় সংসদ) নির্বাচনে আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল বলে আমি শুনেছি৷ অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্ত নেই৷ আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না৷’’
ছবি: U.S. Embassy Dhaka
‘অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’
১৩ অক্টোবর জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মানে হচ্ছে নিয়মিতভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন৷ এ ধরনের নির্বাচন দেশের স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা বিশ্বাস করি, ভোটারদের ভোট দেওয়ার এবং সরকার গঠনে ভূমিকা রাখার অধিকার রয়েছে৷ তাই সমালোচিত হলেও বন্ধু হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে তিনি কথা বলে যাবেন বলে উল্লেখ করেন৷’’
ছবি: bdnews24.com
পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের খবরে উদ্বিগ্ন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
৭ ডিসেম্বর ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের পরদিন এক ফেসবুক পোস্টে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, ‘‘রাজনৈতিক সহিংসতা ও ভয়-ভীতি দেখানোর খবরে আমরা উদ্বিগ্ন৷ আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়-ভীতি দেখানো থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি৷’’ এর আগে ৩১ মে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র৷
ছবি: Sam Panthaky/AFP
গুম হওয়া ব্যক্তির বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় যান৷ সাজেদুলের বোন গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়ক৷ এ সময় ‘মায়ের কান্না’ নামে আরেক সংগঠনের লোকজন রাষ্ট্রদূতকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন৷ ওই ঘটনায় নিরাপত্তার উদ্বেগ জানাতে হাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের কাছে যান৷ পরদিন এ নিয়ে উদ্বেগ জানাতে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকেও তলব করা হয়েছিল৷
ছবি: United States Department of State
‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে’
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার ৬ নভেম্বর ঢাকায় বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা মিশন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা ইউএসএইডের বাংলাদেশ কার্যালয় আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে৷
ছবি: Brendan Smialowski/AFP
বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে কড়াকড়ির ঘটনায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, বাংলাদেশে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপের ঘটনা নিয়ে তার দেশ উদ্বিগ্ন৷ তিনি বলেন, ‘‘কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীকে হুমকি, উসকানি অথবা এক দল আরেক দল বা প্রার্থীর ওপর যাতে সহিংসতা ঘটাতে না পারে, বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই৷’’
ছবি: Nicholas Kamm/AP Photo/picture alliance
নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন নেড প্রাইস
একই ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র৷ তিনি বলেন, ‘‘অর্থপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করতে হলে সহিংসতা, হয়রানি ও নির্ভয়ে ভোটারদের সঙ্গে প্রার্থীদের জনসংযোগ করার সুযোগ করে দিতে হবে৷’’
ছবি: Manuel Balce Ceneta/AP Photo/picture alliance
অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী
১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ৭ ডিসেম্বর বিকেলে এক বিবৃতিতে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে মতপ্রকাশ, গণমাধ্যম ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে অঙ্গীকারের কথা বাংলাদেশকে স্মরণ করিয়ে দেন৷ ঢাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার এক ঘণ্টা পর ঐ বিবৃতি দেন গোয়েন লুইস৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Roberts
ইইউ ও ১৪ দেশের বিবৃতি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ১৪টি দেশের মিশন ৬ ডিসেম্বর বলেছে, ‘‘আমরা বাংলাদেশের বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করছি৷’’ মিশনগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের পালটাপালটি বিবৃতি
২০ ডিসেম্বর ঢাকার রুশ দূতাবাস বিবৃতিতে বলে, গণতন্ত্র সুরক্ষা বা অন্য অজুহাতে বাংলাদেশসহ তৃতীয় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে রাশিয়া বদ্ধপরিকর৷ ইউক্রেনের ক্ষেত্রে রাশিয়া এই নীতি প্রয়োগ করেছে কিনা, পরদিন সেই প্রশ্ন তোলে মার্কিন দূতাবাস৷ একদিন পর রুশ দূতাবাস টুইটারে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে৷ ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র যে পশ্চিমা বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছে, তা তুলে ধরা হয় এতে৷
ছবি: Valery Sharifulin/dpa/TASS/picture alliance
‘বহুপক্ষীয় ও স্বচ্ছ গণতন্ত্র দেখতে চায় যুক্তরাজ্য’
১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতো যুক্তরাজ্যও বাংলাদেশে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনি প্রক্রিয়াসহ বহুপক্ষীয় ও স্বচ্ছ গণতন্ত্র দেখতে চায়৷
ছবি: Reuters/T. Melville
‘অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অন্য দেশের ওপর নির্ভর করে না’
১৬ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান বলেন, ‘‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সরকার, রাজনৈতিক দল ও বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে, অন্য কোনো দেশের ওপর নয়৷’’