বুধবার সন্ধ্যায় কলকাতার ত্রিধারা সম্মিলনী পুজো মণ্ডপের সামনে থেকে আন্দোলনকারীদের আটক করা হয়। পরে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে তাদের নয় জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার তাদের আলিপুর আদালতে তোলা হলে পুলিশ ধৃতদের পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানায়। বিচারক তাদের সাতদিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে ধৃতদের আইনজীবীরা হাইকোর্টে আপিল করেন। শুক্রবার পুজোর মধ্যেই হাইকোর্ট এই মামলা শুনতে রাজি হয়।
নারকেলডাঙার সরস্বতী কালীমাতা মন্দির পরিষদ ক্লাবের দুর্গাপুজোয় উঠে এসেছে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদ। সেখানে মা দুর্গার মূর্তির সামনে রাখা হয়েছে চাদরে ঢাকা অভয়ার শোয়ানো মূর্তি। যা দেখে হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছেন মা দুর্গা। সিংহও নতমুখ। মায়ের হাত অস্ত্রহীন। পাশে প্যান্ডেলে লাগানো চিকিৎসকের পোশাক ও স্টেথো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বলছেন আয়োজকরা
নারকেলডাঙা পুজোর উদ্যোক্তা বিশ্বজিৎ সরকার জানিয়েছেন, নারীর উপর একের পর এক অত্যাচারের খবর আসছে। তাই তাদের থিম এবার লজ্জা। মা দুর্গা লজ্জায় মুখ ঢাকছেন। তার বাহন সিংহও লজ্জায় নতমুখ হয়েছে। এভাবেই তাদের পুজো হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের পুজো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চতুর্থীর প্রদীপ
সোমবার ছিল চতুর্থী। সেই রাতে গিয়ে দেখা গেল, অভয়ার প্রতীকী মূর্তির সামনে ফুলমালা ও তার মধ্যে একটা প্রদীপ জ্বলছে। প্রতিবাদের আলো, অভয়াকে স্মরণ করার প্রদীপ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদের পুজোয় অগ্রণী কাঁকুরগাছি যুবকবৃন্দ
কাঁকুরগাছি যুবকবৃন্দের পুজোর থিম পরিচয়। ৯৫ বছরে পা দেয়া এই পুজোর কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, এবার পুজোয় থিম হবে পোশাকশিল্পী। আরজি করের ঘটনা সবকিছু বদলে দিল। তারা এটা জানলেন, পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত সাধারণ মধ্যবিত্ত বাবা-মা মেয়েকে চিকিৎসক করেছিলেন অনেক কষ্ট করে। তখন তারা থিমের কিছুটা বদল ঘটালেন। তাদের পুজো হয়ে উঠলো প্রতিবাদের পুজো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
জীবন্ত রূপকার
এই পুজোর আরেকটি চমক হলো, জীবন্ত রূপকার। অর্থাৎ, দুইজন পোশাকশিল্পীকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা অভয়ার বাবা-মার প্রতীক। মন্ডপে দর্শকদের সামনে তারা কাজ করছেন। কৃত্রিম মেধা বা এআই ব্যবহার করে চিকিৎসকের প্রতীকী ছবি তৈরি করা হয়েছে। সেই ছবি দেয়া হয়েছে মণ্ডপে। বাকি মণ্ডপজুড়ে রয়েছে পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন অনুসঙ্গ। কিন্তু প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে আছে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আয়োজকের বক্তব্য
এই পুজোর উদ্য়োক্তা শান্তনু সাহা জানিয়েছেন, তাদের থিম হলো 'রূপকার'। যারা আমাদের পোশাকের রূপ দেন তাদের নিয়ে এই পুজোর থিম করার কথা ভাবা হয়েছিল। পরে যখন আরজি কর কাণ্ড হলো, তখন তারা মনে করলেন এই প্রতিবাদটা জরুরি। আর অভয়ার বাবা নিজেও পোশাকশিল্পী ছিলেন। ফলে তাদের মূল থিমের সঙ্গে প্রতিবাদের থিমও মিলে গেল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
থিম যেখানে 'ব্রাত্য'
ভবানীপুর শিবমন্দিরের থিম হলো ব্রাত্য। সেই পুজোতেও রয়েছে প্রতিবাদের চিহ্ন। একটি যন্ত্রণাকতর মুখের ভাস্কর্য রয়েছে সেখানে। আর সেই মুখের গায়ে রয়েছে একটি মেয়ের ছবি। দেখলেই বোঝা যায়, এ কার যন্ত্রণা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোয়
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোয় এবারের থিম হলো লাস ভেগাসের বিখ্যাত আলোর গোলক স্ফিয়ার। ১১ডি প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ১১ দিক থেকে দেখা যাবে এই গোলকের মধ্যে মা দুর্গার অসীম শক্তির প্রতিচ্ছবি। কিন্তু সেই পুজোতেও রয়েছে প্রতিবাদের সুর।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ন্যায়ের দাবি
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোর অন্যতম কর্মকর্তা হলেন বিজেপি নেতা সজল ঘোষ। এখানে পুজোর থিম 'স্ফিয়ার' হলেও পোস্টারে-ফেস্টুনে রয়েছে ন্যায়ের দাবি। যেমন এই বিশালকায় বোর্ডে লেখা রয়েছে, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
9 ছবি1 | 9
বিচারপতি শম্পা সরকারের এজলাসে মামলাটি শোনা হয় এদিন। দীর্ঘ শুনানিতে রাজ্য সরকার অভিযোগ করে, বড় চক্রান্তের চেষ্টা করেছিল ধৃত ছাত্ররা। তাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় শান্তি নষ্ট, শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগের পাশাপাশি অস্ত্র রাখার অভিযোগও তোলা হয়।
পুলিশ হাইকোর্টকে জানায়, ধৃতদের ফোন ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো দরকার। তাহলেই বোঝা যাবে, তারা বড় চক্রান্ত করতে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট থেকে পরিষ্কার যে তাদের সহিংসতার পরিকল্পনা ছিল।
দীর্ঘ শুনানির পর ধৃতদের অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্তি দেওয়ার কথা জানান বিচারপতি। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের জামিন মঞ্জুর করা হয়। তবে ধৃতদের প্রতিদিন থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। আর কোনো মণ্ডপে গিয়ে তারা আন্দোলন করতে পারবেন না। পাশাপাশি পুজো মণ্ডপের ২০০ মিটারের মধ্যে প্রতিবাদ জানানো যাবে না বলেও জানিয়েছেন বিচারপতি। বলেছেন, রাজ্য সরকারের কার্নিভালে কোনোরকম সমস্যা তৈরি করা যাবে না। এক হাজার টাকার বন্ডে দ্রুত এই ছাত্রদের জামিনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন বিচারপতি।
শিল্পীর ভাবনায় আরজি কর 'দ্রোহ', উদ্যোক্তাদের ভয়
কলকাতার পুজোর থিমেও আরজি কর বিতর্ক। শিল্পীদের ভাবনায় উঠে আসছে প্রতিবাদ। মানছেন না উদ্যোক্তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মেরুদণ্ড বিতর্ক
লালবাজার অভিযানে গিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকেরা নিজেদের মেরুদণ্ডের জোরে ‘ভেঙে’ ফেলেছিলেন পুলিশের ‘লৌহকপাট’। কলকাতা পুলিশের নগরপালকে উপহার দিয়ে এসেছিলেন প্রতীকী শিরদাঁড়া। সেই শিরদাঁড়াই এবার পুজোর থিমে প্রতিফলিত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেষ্টপুরে আরজি কর
কেষ্টপুরের মাস্টারদা স্মৃতি সংঘ। তাদের এবারের থিম মানবসভ্যতার রক্ষা কবচ। মণ্ডপের সিলিং-এ শিরদাঁড়ার ইন্সটলেশন নজরকাড়ার মতো। সেই শিরদাঁড়ার গায়ে ফুটে উঠেছে অক্ষর। উদ্যোক্তাদের কথায়, শিক্ষাই মেরুদণ্ডকে সোজা রাখতে শেখায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিতর্কে বেলেঘাটা
তবে শহরের আরও একটি পুজো কমিটি শিরদাঁড়া সংবলিত মণ্ডপ করেও বিতর্ক এড়াতে মণ্ডপে শিরদাঁড়া না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বেলেঘাটা গান্ধী মাঠ ফ্রেন্ডস সার্কলের পুজোর মণ্ডপেও এবার শিরদাঁড়ার ইনস্টলেশন করার কথা ছিল। সেই মোতাবেক মধ্য কলকাতার রামবাগানে তৈরিও করা হয়েছিল বিশালাকার এক মেরুদণ্ড।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শাসকের চাপে?
উদ্যোক্তারা জানালেন, কারো ভাবাবেগে আঘাত করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের থিম ‘বাবারা বরাবর থেকে যান অন্তরালে’, মেরুদণ্ড সোজা রেখে। সেই ভাবনা থেকেই তারা ফেব্রুয়ারি মাসে ঠিক করেন মণ্ডপের প্রবেশপথে বিশালাকার শিরদাঁড়া স্থাপন করবেন। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে তা মিলে যায়, তাই তারা মণ্ডপ সজ্জায় বদল আনার সিদ্ধান্ত নেন। প্রশ্ন উঠছে, মুখে যা-ই বলুন, আসলে শাসকের চাপেই তাদের এই সিদ্ধান্ত!
ছবি: Subrata Goswami/DW
সনাতনের ভাবনায় আরজি কর
শিল্পী সনাতন দিন্দা এবার দুটি দুর্গামূর্তি গড়ছেন। একটি ভবানীপুর ৭৫ পল্লি এবং অন্যটি বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল ক্লাবের জন্য। সনাতনের তৈরি এই বছরের দুটি মূর্তিতেই প্রতিবাদ ধরা পড়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শিল্পীর কথা
বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল ক্লাবের মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে চিরাচরিত প্রথা মেনে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী নন। এই মূর্তিতে দুর্গাকেই সিংহ হৃদয় দেখানো হয়েছে। শিল্পীর কথায়, সাম্প্রতিক কালে আমাদের শহর নারীশক্তির যে ছবি দেখেছে তাই ফুটে উঠেছে মূর্তিতে। দুর্গা এখানে সকল নারীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। শিল্পী বললেন, “আমি দুর্গাকে কোনওদিনও অস্ত্র ধরাইনি, তবে এইবার ধরিয়েছি।”
ছবি: Subrata Goswami/DW
উদ্যোক্তাদের বক্তব্য
তবে সনাতনের এই ভাবনার বিপরীত পথে হেঁটেছেন বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল ক্লাবেরই এক পুজোকর্তা সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। তার বক্তব্য, তাদের এই বছরের পুজোর সঙ্গে সাম্প্রতিক কালের জনজাগরণের কোনও সম্পর্ক নেই। এই ভাবনা তাদের একবছর আগে থেকে ভেবে রাখা। তিনি বলেন, “আমরা উৎসব করছি, এই নির্লজ্জ প্রতিবাদের মধ্যে আমরা নেই। আমরা আগামী প্রজন্মকে একটা সুন্দর পৃথিবী দিতে চাই।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
শিল্পীর ভাবনায় অসুর
সনাতনের ভাবনায়, অসুরকে তিনি শুধু নৃশংসই দেখাননি, ঘৃন্যও দেখাতে চেয়েছেন। দাঁত নখ বের করা ধর্ষকের আদলে তৈরি করেছেন অসুরকে। তাই বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল ক্লাবের অসুরের মূর্তি অন্যান্য সময়ের অসুরের থেকে অন্যরকম সৃষ্টি করেছেন তিনি। কিন্তু বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল ক্লাবের কর্মকর্তাদের কথায়, আরজি কর কাণ্ড একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এমন ঘটনা সারা দেশ জুড়ে অহরহ ঘটে চলেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দ্রোহকালের দুর্গা
ভবানীপুর ৭৫ পল্লির মূর্তির ভাবনাতেও প্রতিবাদের ছোঁয়া রয়েছে। শিল্পী জানালেন, দ্রোহকালের মধ্যেই এই সৃষ্টি, তাই স্বভাবিক ভাবেই বিদ্রোহের আঁচ সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এই দুর্গামূর্তিতে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য নারীর পা। অনেকেই মনে করছেন, প্রতিবাদ মিছিলে হাজার হাজার নারীর পা মেলানোর ছবি এই সৃষ্টিতে ধরা পড়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উদ্যোক্তাদের ভিন্ন মত
৭৫ পল্লির সাধারণ সম্পাদক জানালেন, এই বছর হীরক জয়ন্তী বর্ষে তাদের থিম, ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে’। তাদের এই ভাবনার সঙ্গে আরজি কর কাণ্ডের ‘তিলোত্তমার’ কোনও যোগ নেই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
10 ছবি1 | 10
শুনানি চলাকালীন এদিন বিচারপতি বলেছেন, ধৃতদের কাছ থেকে পুলিশ কেবলমাত্র কিছু হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট এবং প্ল্য়াকার্ড উদ্ধার করেছে। তারা যে স্লোগান দিয়েছে তা ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করেনি। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে অনেকেই এই স্লোগান দিচ্ছে। ধৃতরা নেহাতই কম বয়সি এবং অতি উৎসাহে তারা এই কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি। পাশাপাশি বিচারপতি বলেছেন, যে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট পুলিশ দেখাচ্ছে, তাতে সহিংসতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে পুলিশ যে অভিযোগ করছে, তা ধোপে টিকছে না। বস্তুত, বিচারপতি সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
রাজ্যের তরফে হাইকোর্টকে বলা হয়েছিল, ধৃতরা পুলিশের উপর আক্রমণ করেছিল। তিনজন পুলিশের প্রেসক্রিপশনও আদালতকে দেওয়া হয়। কিন্তু আদালত জানিয়েছে, তিনজন পুলিশের প্রেসক্রিপশনই একরকম। এবং তা দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে, তাদের আঘাত করা হয়েছে।
এদিন এই নয় ছাত্রের জামিনের খবর পেয়ে কেঁদে ফেলেন ধর্মতলায় অনশনরত ডাক্তারেরা। ওই নয় ছাত্রকে 'সহযোদ্ধা' বলে সম্বোধন করেন। পাশাপাশি এদিন সন্ধ্যায় ধর্মতলায় অনশন মঞ্চে মহা সমাবেশের ডাক দিয়েছেন তারা।