রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স এ গ্যাং এবং নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াইয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো অচল হাইতি। কুখ্যাত এক গ্যাং নেতা মানুষকে বাড়ির ভিতরে থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, "যতদিন প্রয়োজন যুদ্ধ চলবে"।
বিজ্ঞাপন
হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে কয়েকটি সশস্ত্র গ্যাং। পোর্ট-অ-প্রিন্স শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং একটি কারাগারের কাছে ভারি বন্দুকযুদ্ধ চলছে।
হাইতির গ্যাং নেতা জিমি চেরিজিয়ার শুক্রবার একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তিনি হেনরিকে অপসারণের চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
বারবিকিউ নামেও পরিচিত এই গ্যাং নেতা বলেন, "যুদ্ধ যতদিন দরকার ততদিন চলবে। আমরা এরিয়েল হেনরির সাথে লড়াই চালিয়ে যাব। জামানত সংক্রান্ত ক্ষতি এড়াতে, বাচ্চাদের বাড়িতে রাখুন।"
সাবেক এলিট পুলিশ কর্মকর্তা চেরিজিয়ের জি-নাইন অ্যান্ড ফ্যামিলি অ্যান্ড অ্যালাইজ নামে একটি গ্যাং ফেডারেশন পরিচালনা করেন। ২০২২ সালে দেশের বৃহত্তম তেল টার্মিনাল অবরুদ্ধ করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অচল করে দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তার ওপর।
এবারের সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত চার পুলিশ কর্মকর্তা নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। শুক্রবার একদল পুলিশ কর্মকর্তা তাদের চার সহকর্মীর মরদেহ উদ্ধারের দাবিতে ব্যবস্থাপনা অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখান।
লড়াই শুরু হওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী হেনরি দেশের বাইরে ছিলেন। আন্তর্জাতিক পুলিশিং এবং শান্তিরক্ষী মোতায়েনে সমর্থন জোরদার করার চেষ্টার অংশ হিসাবে কেনিয়ায় অবস্থান করছিলেন হেনরি।
একাধিক গ্যাং একজোট
রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স এর রাস্তায় পোড়া বাস এবং ব্যারিকেডের সংখ্যা বেড়েছে। সহিংসতা এড়াতে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এই সহিংসতায় একাধিক গ্যাং "ভিভরে এনসেম্বল" ("একসঙ্গে বসবাস") স্লোগানে একজোট হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইতির বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে নানা সশস্ত্র গ্যাং। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এক কোটি ১০ লাখ মানুষের এই দেশে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র নয় হাজার।
হেনরি কেনিয়া সফরে যাওয়ার পর সহিংসতার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। শুক্রবার (১ মার্চ) দুই দেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। নাইরোবি আশা করছে, এর ফলে একটি আন্তর্জাতিক পুলিশিং এবং শান্তিরক্ষা মিশনে নেতৃত্ব দেয়ার অংশ হিসাবে হাইতিতে এক হাজার পুলিশ কর্মকর্তা পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে কেনিয়ার আদালতের আর আপত্তি থাকবে না।
জাতিসংঘ কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন দেশকে এমন অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আবেদন করে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী হেনরির দপ্তর থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে "সশস্ত্র দস্যুদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে" ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয়েছে। সরকার সংঘাত সমাধানের জন্য কাজ চালিয়ে যাবে বলেও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
নতুন লড়াইয়ের ফলে দেশটিতে পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাবে, হাইতির প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা তীব্র ক্ষুধায় ভুগছেন।
২০২১ সালের গ্রীষ্মে সাবেক প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়েস খুব হওয়ার পর নির্বাচন আয়োজনে দেরি করার পেছনে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে দায়ী করে আসছে হেনরির সরকার।
২০২১ সালের ছবিঘর
প্রেসিডেন্টকে হত্যা, আরও অনিশ্চয়তায় হাইতি
হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভনেল ময়িজকে বুধবার তার বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে৷ ফলে আগে থেকে অশান্ত থাকা ক্যারিবীয় এই দেশটির পরিস্থিতি আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে৷
ছবি: Dieu Nalio Chery/AP Images/picture alliance
প্রেসিডেন্টকে হত্যা
হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভনেল ময়িজকে বুধবার তার বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে৷ ফার্স্ট লেডিও গুরুতর আহত হয়েছেন৷ ৪৮ বছর বয়সি ব্যবসায়ী ময়িজ ২০১৫ সালে নির্বাচনে জিতেছিলেন৷ কিন্তু সেটা বাতিল করে আবারও তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়৷ ময়িজ সেটিও জেতেন৷ অবশেষে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি শপথ গ্রহণ করেন৷ দায়িত্ব নিয়ে ময়িজ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: Dieu Nalio Chery/AP Images/picture alliance
সমালোচনা
সমালোচকদের অভিযোগ দায়িত্ব নিয়ে ময়িজ একনায়কের মতো আচরণ শুরু করেন৷ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সংসদ ভেঙে দেয়ার পর থেকে তিনি ডিক্রি জারির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে আসছিলেন৷
ছবি: picture alliance
হত্যাচেষ্টা
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ময়িজ জানিয়েছিলেন যে, ক্ষমতা থেকে তাকে সরাতে এ পর্যন্ত সাতবার চেষ্টা করা হয়েছে৷ একই মাসে তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে হত্যাচেষ্টার দায়ে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তবে একটি আপিল আদালত পরবর্তীতে ময়িজের অভিযোগ খারিজ করে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিয়েছিল৷ এদের মধ্যে একজন বিচারক ও পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন৷
ছবি: Dieu Nalio Chery/AP/picture alliance
হত্যার পেছনে কারা?
এখনও পরিষ্কার নয়৷ তবে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ক্লোদ জোসেফ বলছেন, হত্যাকারীরা উচ্চ প্রশিক্ষিত ছিলেন৷ তাদের কয়েকজন স্প্যানিশ ও কয়েকজন ইংরেজি ভাষায় কথা বলছিলেন৷ এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত হাইতির রাষ্ট্রদূত বোচিত এডমন্ড হামলাকারীদের ‘পেশাদার কমান্ডো’ ও ‘বিদেশি ভাড়াটে গুন্ডা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ হামলাকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এজেন্টের বেশ ধরেছিল বলেও জানান তিনি৷
ছবি: Valerie AFP/Getty Images
চার সন্দেহভাজনকে হত্যা
হাইতির প্রেসিডেন্ট ময়িজকে হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর কর্তৃপক্ষ জানায়, পুলিশ চার সন্দেহভাজনকে হত্যা করেছে এবং দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ তবে তাদের পরিচয় বা প্রেসিডেন্টকে হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি৷
ছবি: Joseph Odelyn/AP Photo/picture alliance
দারিদ্র্য ও অপরাধ
১৯৫৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ফ্রাসোয়া ডুভালিয়ে ও তার ছেলে জ্য ক্লোদ ডুভালিয়ের (ছবি) একনায়ক শাসনামল শেষ হওয়ার পর হাইতিতে মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে৷ সেই সঙ্গে আছে চরম দারিদ্র্য আর অপরাধ৷ শুধু এ বছরেই ক্রিমিনাল গ্যাংদের কারণে হাজার হাজার মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP/Dieu Nalio Chery
যেন গেরিলা যুদ্ধ
ইউনিসেফে হাইতির প্রতিনিধি ব্রুনো মাস গতমাসে হাইতির গ্যাং পরিস্থিতিকে গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন৷ আর হাইতির ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্স নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক পিয়ের এসপেরাঁস বলছেন, হাইতির প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন ক্রিমিনাল গ্যাং৷
ছবি: Joseph Odelyn/AP/dpa/picture alliance
পুলিশ ও সেনার অবস্থাও তথৈবচ
ক্রিমিনাল গ্যাংরা মাঝেমধ্যেই পুলিশ ও সেনাসদস্যদের উপর হামলা চালায়৷ এদিকে, অভ্যুত্থান চেষ্টার দায়ে বন্দি সহকর্মীদের ছাড়াতে গত মার্চ মাসে মাস্ক পরা কয়েক ব্যক্তি (যারা নিজেদের পুলিশের বিক্ষুব্ধ অংশের সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছে) কয়েকটি পুলিশ স্টেশনে হামলা চালিয়েছিল৷ ১৯৯৫ সালে একজন একনায়কের পতনের পর হাইতিতে সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করা হয়েছিল৷ এরপর ২০১৭ সালে পুনরায় তা গঠন করা হয়৷
ছবি: Reginald Loussaint/AFP/Getty Images
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়ছিল
গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বন্দ্ব বাড়ছিল৷ কারণ বিরোধীরা দাবি করছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ময়িজের মেয়াদ শেষ৷ কিন্তু ময়িজের যুক্তি ছিল তিনি ২০১৫ সালে নির্বাচনে জিতলেও শপথ নিয়েছেন ২০১৭ সালে৷ সুতরাং তার মেয়াদ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে বলে দাবি করেছিলেন তিনি৷ এরপরও বিরোধীদের দাবির মুখে ময়িজ সেপ্টেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন৷
ছবি: Sabin Johnson/AA/picture alliance
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ
হাইতিতে হত্যা ও অপহরণের ঘটনা বাড়তে থাকার মধ্যে গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুট পদত্যাগ করেন৷ এরপর ক্লদ জোসেফকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী করা হয়৷ তবে খুন হওয়ার একদিন আগে নিউরোসার্জন আরিয়েল হেনরিকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ময়িজ৷ কিন্তু সেটা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: Jean Mark Herve Abelard/imago images/Agencia EFE
এখন কী?
প্রেসিডেন্ট খুন হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের সভাপতির এখন দায়িত্ব নেয়ার কথা৷ কিন্তু তিনি সম্প্রতি করোনায় মারা গেছেন৷ ফলে নতুন নেতা হিসেবে একজনকে নির্বাচিত করার কথা জাতীয় পরিষদের৷ কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়৷ কারণ বর্তমানে কার্যকর কোনো জাতীয় পরিষদ নেই৷ নিম্নকক্ষের সব সদস্য ও সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যেরও মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে৷ ফলে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জোসেফকেই (ছবি) এখন কাজ চালিয়ে যেতে হতে পারে৷