বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ব্যবস্থাকে হাইব্রিড রেজিম বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ৷
বিজ্ঞাপন
১৯৯০ সালের পর থেকে এর যাত্রা শুরু হয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে এ অবস্থায় পৌঁছেছে বলে ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মত দেন তিনি৷
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থাকে হাইব্রিড রেজিম কেন বলছেন?
আলী রীয়াজ: রাষ্ট্র বিজ্ঞানে হাইব্রিড রেজিম বলতে বোঝায় একটি দো-আঁশলা ব্যবস্থাকে যেখানে গণতন্ত্রের উপাদানগুলো অনুপস্থিত থাকে৷ ১৯৯১ সালের পর বাংলাদেশ গণতন্ত্রের যে প্রতিশ্রুতি ছিল সেগুলো পূরণ হয়নি৷ কখনো বিএনপি, কখনো আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেছে৷ কিন্তু কী দাঁড়ালো? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হচ্ছে না, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে না, দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে না৷ ৯১ পররবর্তী সময় থেকেই আমরা এ অবস্থাটি খেয়াল করছি৷ ৯৬ সালে বিএনপি একদলীয় নির্বাচন করলো৷ দেখা গেলো গণতন্ত্রের ইনক্লুসিভনেস এর ধারণাকে সে নিশ্চিত করছে না৷ সৌভাগ্য যে সেটা টেকে নি৷
পরিক্রমায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর একটি অথারিটারিয়ান ইলেকটোরাল সিস্টেমে প্রবেশ করল বাংলাদেশ৷ আর সব মিলিয়ে এটিকে হাইব্রিড রেজিম বলা যায়৷ এ তালিকায় রয়েছে রাশিয়া, তুরস্ক, ভেনিজুয়েলাসহ আরো অনেক দেশ৷
‘অথারিটারিয়ান ইলেকটোরাল সিস্টেমে প্রবেশ করল বাংলাদেশ’
ডয়চে ভেলে: একবছর হলো বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে? এ সময়ে জাতীয় সংসদকে কতোটা কার্যকর দেখতে পান?
আলী রীয়াজ: এই সংসদ থেকে আমার কোন প্রত্যাশা নেই৷ কারণ এর নৈতিক বৈধতা নেই৷ ২০১৪ সালেও ছিল না৷ শুধু বিরোধী দল অংশ নেয়নি বলে নয়৷ আপনি হয়তো এর সাংবিধানিক বৈধতা দেখাতে পারেন৷ কিন্তু এর নৈতিক বৈধতা নেই৷ আপনি যদি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জিতে আসতেন...এমনকি পরাজিত শক্তিরও নৈতিক বৈধতা থাকে যদি স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন হয়৷
ডয়চে ভেলে: পশ্চিমা বিশ্ব সবসময়ই গণতন্ত্রের কথা বলে৷ আপনি বলছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র উপস্থিত নেই৷ কিন্তু পশ্চিমা সরকারগুলোতো বর্তমান সরকারের সাথে কাজ করে যাচ্ছে? এটা কেন হচ্ছে?
আলী রীয়াজ: পশ্চিমা দেশগুলো এ স্বীকৃতিকে আমি এতোটা গুরুত্ব দেখি না৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তাহলে আপনি চাপ প্রয়োগ করবেন কীভাবে? সেই স্বার্থেই তারা যোগাযোগ রাখছে৷ যেমন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি সম্পর্ক নষ্ট করে তাহলে বিশ্বের অনেক দেশের সাথেই তাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে৷ সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র এ মানবাধিকারের যে মূলনীতি নিয়ে তারা কাজ করতে চায় সেটি নিয়ে আর এগুতে পারবে না৷
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে গনতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় গণমাধ্যম কতোটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখেছে বলে আপনি মনে করেন?
আলী রীয়াজ: গণতন্ত্র না থাকলে গণমাধ্যম স্বাধীন থাকবে এটা হয় না৷ আপনি যদি বিরোধী কন্ঠগুলো না রাখেন, শক্তি প্রয়োগকে প্রধান বলে বিবেচনা করেন, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করেন তাহলে সংবাদপত্র থাকবে, টেলিভিশন থাকবে তারা আবার বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছেন সেটি হবে না৷ অধিকাংশ গণমাধ্যম এখন ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার বর্ম হিসেবে কাজ করছে৷ যেটি বর্ম সেটি কীভাবে স্বাধীন হয়?
ডয়চে ভেলে: জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আলী রীয়াজ: আপাত দৃষ্টিতে সাফল্য অর্জিত হয়েছে৷ তবে জঙ্গীবাদ থামানো হয়েছে শক্তি প্রয়োগ করে৷ কিন্তু দেখুন, ২০০৭ সালে জেএমবির পুরো নেতৃত্বকে দমন করা হয়েছিল৷ ২০১৬ সালে দেশে আবারো জঙ্গীবাদ দেখা গেল৷ কেন হলো? কারণ সহিংস উগ্রবাদী চিন্তায় কেউ কেউ কেন আকৃষ্ট হয়েছে সে বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না৷ এ বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে মোকাবেলা করতে হবে৷
স্বৈরাচারী সরকারের ১০ লক্ষণ
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ‘গণতান্ত্রিক’ ও স্বৈরাচারী’ সরকারের মধ্যে তফাত করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়৷ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের তথ্য অনুসারে এই ছবিঘরে থাকছে স্বৈরাচারী সরকারের ১০টি লক্ষণ৷
ছবি: DW/S. Elkin
গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে গণমাধ্যম বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকে৷ সরকারের সমালোচনা ও ভুল ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক৷ ফলে সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাংবাদিকদের দূরে রাখতে স্বৈরাচারী শাসকরা পত্রিকা, টেলিভিশনকে ভয় দেখিয়ে কোণঠাসা করতে চান৷
ছবি: DW/S. Elkin
সরকারপন্থি গণমাধ্যম সৃষ্টি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে৷ ফলে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না৷ পালটা ব্যবস্থা হিসেবে স্বৈরশাসকরা সরকারপন্থি গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন৷ এর ফলে ব্যাপক হারে সরকারের নানা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো সহজ হয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/J. Büttner
রাষ্ট্রীয় সংস্থার দলীয়করণ
রাষ্ট্রের সকল স্তরে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে স্বৈরাচারী শাসকরা পুলিশ, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সরকারি আমলাদের মধ্যেও দলীয়করণ প্রতিষ্ঠা করে থাকেন৷ এর ফলে রাষ্ট্রের ভেতর থেকে ক্ষোভ দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP
বিরোধীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি
রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীতাকারীদের ওপর নজরদারির কাজে লাগানো হয়৷ গোয়েন্দা মারফত পাওয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে নানাভাবে হেয় করা ও কোণঠাসা করতে অপব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Chromorange
বিশেষ সুবিধা ও দমনপীড়ণ
স্বৈরাচারী সরকার বা সরকারপ্রধানকে যেসব কর্পোরেট সংস্থা বা ব্যক্তি নানাভাবে সহায়তা করে থাকেন, তাদের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেয়া হয়৷ বেআইনি উপায়ে কাজ পাইয়ে দেয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে সহায়তা করা হয়৷ অন্যদিকে, যেসব সংস্থা সহায়তা করে না, তাদের ক্ষেত্রে চলে যে-কোনো উপায়ে দেউলিয়া বানানোর প্রক্রিয়া৷
ছবি: Imago/blickwinkel
বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ
আদালত স্বাধীন থাকলে স্বৈরাচারী শাসকদের নানা সময়ে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়৷ ফলে শুরু থেকেই স্বৈরাচারী শাসকরা সুপ্রিম কোর্টকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করেন৷ অনুগত বিচারক নিয়োগ দেয়া, বিরোধীদের ছাঁটাই করা থেকে শুরু করে, নানাভাবে চেষ্টা চলে এ নিয়ন্ত্রণের৷
ছবি: Fotolia/Sebastian Duda
একপাক্ষিক আইন প্রয়োগ
স্বৈরাচারী শাসকদের শাসনামলে ‘আইন সবার জন্য সমান’ বাক্যটি থাকে শুধু কাগজে-কলমে৷ বাস্তবে প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য পাস করা হয় নতুন নতুন আইন৷ বিরোধীদের নানা উছিলায় গ্রেপ্তার নির্যাতন করা হলেও, নিজের সমর্থকদের রাখা হয় আইনের আওতার বাইরে৷
ছবি: Fotolia/axentevlad
‘জুজুর ভয়’ দেখানো
বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে ভয়াবহ অবস্থা হবে, দেশ রসাতলে যাবে, বিরোধীরা কত খারাপ, ক্রমাগত সে প্রচার চালানো হয়৷ এর ফলে এমন অবস্থা তৈরির চেষ্টা হয় যাতে জনগণের মনে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করা যায়৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
দৃষ্টি সরাতে ভীতি সৃষ্টি
ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ধরনের ভীতি তৈরি করে থাকেন স্বৈরাচারী শাসকরা৷ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, গণতন্ত্রহীনতা ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে কোথাও জঙ্গি সংকট, কোথাও মাদকবিরোধী যুদ্ধ, কোথাও অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়৷
ছবি: Fotolia/lassedesignen
নির্বাচনে কারচুপি
আগে জোর করে ক্ষমতায় থাকার উদাহরণ থাকলেও, এখন স্বৈরাচারী শাসকরাও নিয়মিত বিরতিতে নির্বাচন দিয়ে থাকেন৷ ‘গণতন্ত্র আছে’ জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলে এমন ধারণা দেয়ার জন্য তারা নির্বাচন দেন৷ কিন্তু সে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের আয়োজন আগে থেকেই করা থাকে৷