হলিউডের ‘জস’ ছবিতে খুনে হাঙরের কাণ্ড দেখে রোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু সেই হাঙরের ত্বকের যে কতটা কদর, তা কি জানতেন? জাহাজ থেকে বিমান – সবেতেই হাঙরের ত্বকের গুণ কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
হাঙর প্রায় বিনা বাধায় পানির মধ্যে এগিয়ে চলে৷ তাদের ত্বকে যে ক্ষুদ্র ‘রিবলেট' রয়েছে, সেগুলিই এটা নিশ্চিত করে৷ এই আঁশগুলি এমনভাবে সাজানো যে, হাঙরের ত্বক স্রোতের ধাক্কা কমিয়ে আনতে পারে৷
বিজ্ঞানীরা এই কাঠামো প্রযুক্তিগতভাবে অন্যান্য সারফেস বা পৃষ্ঠভাগের উপর প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ হাঙরের ত্বকের আদলে তৈরি সাঁতারের পোশাক পরে অ্যাথলিটরা গত কয়েক বছরে অনেক রেকর্ড ভাঙতে পেরেছেন৷ এই ‘রিবলেট' নৌকা দৌড়ের গতিও বাড়িয়ে দিয়েছে৷ এমনকি বিমানের উপরেও একটি ‘রিবলেট'-এর স্তর পরীক্ষা করা হয়েছে৷ তবে সেই ফয়েল এখনো পুরোপুরি ব্যবহারের উপযোগী হয়নি৷
ব্রেমেন শহরে ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট এবার এমন এক তরল পদার্থ তৈরি করেছে, যা রংয়ের মতো লাগালে হাঙরের ত্বকের গুণাগুণ নকল করা সম্ভব৷ এই রং অত্যন্ত জটিল মালমশলা দিয়ে তৈরি৷ সূর্যের অতি-বেগুনি রশ্মি, তাপমাত্রার হেরফর এবং চাপ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে এই পদার্থ৷ ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের ইভন ভিলকে বলেন, ‘‘যে কোনো রংয়ের মতো এই রংয়েরও প্রয়োজনীয় গুণাগুণ থাকতে হবে৷ তবে বিমানে লাগাতে হবে বলে তাপমাত্রার বিশাল হেরফের সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে৷ ১০,০০০ মিটার উচ্চতায় সূ্র্যের আলোর অভাব নেই৷ চাই প্রবল ঘর্ষণ প্রতিরোধের ক্ষমতাও, যাতে রিবলেট ও তার গোড়া টেকসই হয়৷''
গবেষকরা এই রং সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ এক প্রক্রিয়াও তৈরি করেছেন৷ হাঙরের ত্বকের কাঠামো রংয়ের মধ্যে চেপে বসিয়ে দেওয়া হয়৷ অতি বেগুনি রশ্মি তাকে আরও শক্ত করে তোলে, যাতে তা ছড়িয়ে না যায়৷
চওড়া এক চোঙা স্টেনসিলের মধ্যে রং পুরে দেয়৷ নীচের বাঁ-দিকে সেটি তরল রংয়ের উপর অতি ক্ষুদ্র ‘রিবলেট' খোদাই করে৷ একই সঙ্গে অতি বেগুনি রশ্মির ল্যাম্প রংকে শক্ত করে তোলে৷ ফলে হাঙরের ত্বকের কাঠামো অক্ষত থাকে৷
প্রাণিজগতের রেকর্ডধারীদের কথা
প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবলে অবাক হতে হয়৷ কেউ খুব ছোট, কেউ খুব বড়৷ প্রাণীদের চলন-বলনেও কত বৈচিত্র্য! কেউ দৌড়ায় ঝড়ের বেগে, কেউ লাফিয়ে চলে, কারো আবার বিচরণ আকাশের কাছাকাছি৷ ছবিতে দেখে নিন তাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিতা : দ্য স্প্রিন্টার
ক্ষুধার্ত চিতার সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে চিতা৷ নিঃশব্দে শিকারের কাছাকাছি গিয়ে এমন বেগে তাড়া করতে শুরু করলে ভয়ঙ্কর এই শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার৷ একটাই আশার কথা- চিতা বেশিক্ষণ খুব দ্রুত দৌড়াতে পারেনা৷ তাই কয়েকশ মিটারের মধ্যে ধরতে না পারলে হরিণের মতো পছন্দের খাবার হাতছাড়া করার হতাশায়ও ভুগতে হয় চিতাকে৷
ছবি: Fotolia/stephane angue
গতির সঙ্গে কষ্টসহিষ্ণুতা
‘প্রংহর্ন’ অন্য হরিণদের মতোই ক্ষিপ্রগতির হলেও এক জায়গায় পৃথিবীর বাকি প্রাণীদের চেয়ে এগিয়ে৷ কিছু প্রাণী শুরুতে খুব দ্রুত ছুটতে পারলেও কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ফলে গতিও কমে আসে দ্রুত৷ প্রংহর্ন সেরকম নয়৷ পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত অনায়াসে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে৷ ফলে চিতা, বাঘ, সিংহ বা অন্য যে-কোনো প্রাণীই শিকার করতে আসুক, শুরুর ঝড়টা সামলে নিলে প্রংহর্নকে আর কে পায়!
ছবি: Getty Images
দ্রুততম পাখি
সব পাখি কিন্তু ওড়ে না৷ কোনো কোনো পাখি ডানা না মেলে দু পায়ে ছুটতেই বেশি ভালোবাসে৷ বিশালদেহী উটপাখি তো উড়তেই পারেনা৷ তবে দৌড়ায় অবিশ্বাস্য গতিতে৷ ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছোটে বলে তারা যে শুধু পাখিজগতের দ্রুততম সদস্য তা-ই নয়, অন্তত আধঘণ্টা পর্যন্ত ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেগ ধরে রাখতে পারে বলে তাদের কষ্টসহিষ্ণুতারও প্রশংসা করতে হয় আলাদাভাবে৷
ছবি: AP
‘শকুন হইতে সাবধান’
১৯৭৩ সালে একটা বিমান প্রায় বিধ্বস্ত হতে বসেছিল শকুনের কবলে পড়ে৷ ১১ হাজার ২০০ মিটার অর্থাৎ ৩৬ হাজার ৭৪৫ ফুট ওপর দিয়ে উড়ছিল বিমানটি৷ এক রুপেল শকুন উড়তে উড়তে সেখানে গিয়ে হাজির এবং বিমানের সঙ্গে ধাক্কা৷ পাখি সাধারণত ১০০ থেকে ২,০০০ মিটার উঁচুতে ওড়ে৷ শুধু অভিবাসী পাখিরাই প্রবল শীতে মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে বাঁচতে যখন দেশান্তরী হয়, বিশেষ করে যখন হিমালয়ের ওপর দিয়ে উড়তে হয়, তখন বড় জোর ৯,০০০ মিটার উঁচুতে ওঠে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবচেয়ে উঁচুতে লাফ
বিশাল আকৃতির বুনো বেড়াল শ্রেণির এই প্রাণী একেবারে জায়গায় দাঁড়িয়ে সাড়ে পাঁচ মিটার, অর্থাৎ ১৮ ফুট ওপরের মগডাল থেকে শিকার ধরে আনতে পারে৷ স্থলচর আর কোনো প্রাণী লাফিয়ে এত উঁচুতে উঠতে পারেনা৷ ৫০ কেজি ওজনের শরীর নিয়ে পুমা কী করে যে এত উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে, কে জানে! প্রাণীকুলে ডলফিনই শুধু পুমার চেয়ে বেশি, ৭ মিটার উঁচুতে উঠতে পারে লাফিয়ে৷ তবে জলচর ডলফিন লাফের আগে অনেকটা পথ সাঁতরে গতি বাড়িয়ে নেয়৷
ছবি: Bas Lammers
সবচেয়ে ছোট পাখি
সবচেয়ে ছোট পাখির নাম হামিং বার্ড৷ সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ে এটা নিশ্চয়ই অনেক আগেই জেনে গেছেন সবাই৷ সবচেয়ে ছোট হামিং বার্ডের শরীর দুই ইঞ্চি বা ৬ সেন্টিমিটারের মতো৷ ওজন অন্য পাখির পালকের সমান, মাত্র ২ গ্রাম! খুব ছোট পাখি, খুব ছোট ডানাও তাদের৷ তাই উড়তে হয় অনেক কষ্ট করে৷ ওড়ার সময় সেকেন্ডে ৪০ থেকে ৫০ বার ডানা ঝাপটায় হামিং বার্ড৷
ছবি: Fabian Schmidt
সবচেয়ে গভীরে
ডাইভ দিয়ে সমুদ্রের পানির ৩,০০০ মিটার গভীরে চলে যায় তিমি৷ একঘণ্টা শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে থাকতেও পারে সেখানে৷ আর কোনো স্তন্যপায়ী প্রানী পানির এত গভীর তলদেশে যেতে পারে না৷ এতক্ষণ ধরে তিমির মতো শ্বাস বন্ধ রাখাটা অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়৷ তিমি নাকি ডাইভ দেয়ার সময়ই মস্তিস্ক আর হৃৎপিণ্ডে রক্ত পাঠিয়ে দেয়৷ আর এভাবেই দম বন্ধ করে ঘণ্টা পার করার জাদু দেখায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই প্রাণী৷
ছবি: 2010 Universum Film GmbH / Richard Herrmann
খরতাপে নির্বিকার
‘অরিক্স’ হরিণ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তপ্ত হাওয়া গায়ে মেখে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়৷ মানুষ হলে অমন তাপে মৃত্যু নির্ঘাত৷ অরিক্সের দেহের রক্ত শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ তাছাড়া তৃষ্ণা খুব কম পায় বলে অন্য প্রাণীদের মতো গরমে ঘন ঘন পানি পান করারও দরকার পড়েনা৷ সপ্তাহে একবার পানি পান করলেই সুস্থ থাকে অরিক্স৷ এমন হলে কারো গায়ে তাপ দুর্ভোগ হয় কী করে!
ছবি: picture-alliance/zb
সেরা কান
প্রাণীকুলে সেরা কান বাঁদুরের৷ নিশাচর এই প্রাণী তার বড় বড় কান শব্দের উৎসের দিকে ঘোরালে যেন দীর্ঘ এক চোঙ চলে যায় সেখানে, টেনে নিয়ে আসে শব্দকে৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারেও বাঁদুরের তাই পোকামাকড় ধরে খেতে কোনো অসুবিধা হয়না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লাফের আসল চ্যাম্পিয়ন
মাছিদেরও আছে অসাধারণ এক ক্ষমতা৷ শরীরের উচ্চতার চেয়ে ২০০ গুণ উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে তারা৷ ফ্রগহপার তো আরেক কাঠি সরেস৷ নিজের শরীরের উচ্চতার চেয়ে ৪০০ গুণ বেশি উঁচুতে এক লাফে হেসেখেলে উঠে যায় তারা!
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
গবেষকরা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নীচে নিয়মিত সেই ‘রিবলেট'-এর কাঠামোর মান পরীক্ষা করেন৷ মাত্র কয়েক মাইক্রো মিটার চওড়া খাঁজ পানিকে উত্তাল হতে দেয় না, ঠিক যেমনটা হাঙরের ত্বকের ক্ষেত্রে ঘটে৷ ফলে জ্বালানির সাশ্রয় ঘটে৷ ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের ড. ফল্কমার স্টেনৎসেল বলেন, ‘‘এমন সারফেসের এয়ারোডায়নামিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এমন স্তরের মাধ্যমে ঘর্ষণের মাত্রা প্রায় ৭ শতাংশ কমানো সম্ভব৷ ফলে বাস্তবে জাহাজ বা বিমানে এমন স্তর ব্যবহার করলে জ্বালানি বাঁচানো সম্ভব হবে৷''
উইন্ড মিলে এমন স্তর বসালে আরও জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব৷ ড. স্টেনৎসেল বলেন, ‘‘আমরা উইন্ড মিলের চ্যানেল পরিমাপ করে দেখেছি৷ বিশেষ স্তর বসানো এবং সাধারণ পাখার মধ্যে তুলনা করেছি৷ তাতে দেখা গেছে, এই স্তর থাকলে ‘গ্রাইড রেশিও' প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে৷ অর্থাৎ একদিকে পাখার ধাক্কা, অন্যদিকে বাতাসের চাপ – এই দুইয়ের মধ্যে সংঘাত কমে যায়৷ ফলে এমন উইন্ড মিলে অনেক বেশি জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব৷''
যেখানেই বাতাস বা পানির ‘রেজিস্টেন্স'-এর ভূমিকা রয়েছে, সে সব ক্ষেত্রে হাঙরের ত্বকের গুণাগুণসম্পন্ন রং জ্বালানি উৎপাদনের খরচ কমাতে পারে, গোটা প্রক্রিয়ার আরও উন্নতি ঘটাতে পারে৷ তখন কার্বন নির্গমনের মাত্রাও কমে যায়৷