একই বয়সের মানুষের চেয়ে হাতির ক্যানসারে মৃত্যুহার অনেক কম৷ প্রাণীর দেহে বিশেষ এক ধরনের সুপ্ত জিন আছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরে ফেলতে পারে৷ হাতি এ জিন কাজে লাগাচ্ছে ক্যানসার প্রতিরোধে৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের ১৭ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে৷ হাতির ক্ষেত্রে এ হার কেবল ৫ শতাংশ৷ কিন্তু হাতিও মানুষের মতোই গড়ে ৭০ বছরের কাছাকাছি বাঁচে৷
আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, ক্যানসার সৃষ্টিতে যেসব কোষ ভূমিকা রাখে, হাতির শরীরে সেসব কোষের সংখ্যা মানুষের তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ বেশি৷ অবাক হওয়া স্বাভাবিক, কী আছে হাতির শরীরে?
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিনসেন্ট লিঞ্চের নেতৃত্বে উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু জেনেটিক্স গবেষক ধারণা করছেন, এই ঘটনায় জড়িত একটি বিশেষ জিন- পি৫৩৷
মানুষসহ প্রায় সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহে এই জিন একটি করে রয়েছে৷ এই জিনের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ চিহ্নিত করে তাকে ধ্বংস করে ফেলা৷ শরীরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতোই কাজ করে এ জিন৷
হুমকির মুখে যেসব প্রাণী
হুমকির মুখে থাকা কিছু প্রজাতির প্রাণী লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে আফ্রিকার ওকাপিসহ আরো ২০০ পাখি রয়েছে৷ তবে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ওকাপি’র সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে
জিরাফের মতো দেখতে এই ওকাপি’র বাস কঙ্গোতে৷ আফ্রিকার ঐ অঞ্চলে কত প্রাণীর বাস তার হিসাব রাখে ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন)৷ সংস্থাটি সম্প্রতি হুমকির তালিকায় থাকা প্রাণীদের নাম প্রকাশ করেছে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে, কঙ্গোর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকা এই ওকাপির সংখ্যা নব্বইয়ের দশকে ছিল ৪,৪০০৷ দশ বছর পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২,৫০০ তে৷ কঙ্গোর সহিংসতা এবং খনি ব্যবসাকে এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে৷
ছবি: cc-by-sa-3.0/Raul654
বিলুপ্তির পথে
আইইউসিএন জানিয়েছে, ওকাপি এখন হুমকির মুখে৷ তাদের তৈরি তালিকার একেবারে তলানিতে আছে ওকাপির নাম৷ অর্থাৎ এরাই সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে৷ এমন অনেক প্রাণী আছে, আজ থেকে ২০০ বছর আগেও যাদের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন বালি টাইগার৷ বাঘের প্রায় সব প্রজাতিই আজ হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুইশ প্রজাতির পাখি হুমকির মুখে
নতুন রেড লিস্টে দুইশ প্রজাতির পাখিও রয়েছে৷ এদের মধ্যে অনেক শকুন আছে, যাদের বাস ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়৷ আইইউসিএন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, চীন ও মালয়েশিয়ার অনেক শকুন এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে৷ ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা অনেক শকুন এখন হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এশিয়ার হাতি দ্রুত কমছে
বিশ্বে এখনও এশিয়ান এলিফেন্টের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার৷ কিন্তু এরাও হুমকির মুখে রয়েছে৷ গত তিন প্রজন্ম ধরে এই প্রজাতির হাতির সংখ্যা কমছে৷ আইইউসিএন বলছে, তিন প্রজন্মে হাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান হাতি দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
পাচার ও দাঁত বিক্রির কারণে বিপদ
কেবল এশিয়া নয়, আফ্রিকার হাতিরাও হুমকির মুখে৷ বন উজাড় এবং দাঁতের জন্য শিকারীদের উৎপাতও হাতিদের সংখ্যা কমানোর জন্য দায়ী৷ সেইসাথে অবৈধভাবে শিকার এবং চুরি করে পাচার করাও দিন দিন বাড়ছে৷ হাতি পাচার রোধে এ মাসের ২ থেকে ৪ ডিসেম্বর বতসোয়ানায় ‘আফ্রিকান এলিফেন্ট সম্মেলন’-এর আয়োজন করে আইইউসিএন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিলুপ্তির পথে মাছ
ডলফিনের মত দেখতে এই পরপয়েসদের সচরাচর দেখা যায় ক্যালিফোর্নিয়ায়৷ মাছ ধরার জালে আটকে প্রায়ই মারা যায় এরা৷ কখনো কখনো জেলেরা এদের ধরে নিয়ে যায়৷ ফলে হুমকির মুখে রয়েছে এই প্রজাতিটি৷ বিশ্বে এখন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ পরপয়েস রয়েছে৷
ছবি: WDC
কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে আশার আলো
কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে অবশ্য উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেমন লেদারব্যাক কচ্ছপ৷ অথচ এক দশক আগে এই প্রজাতির কচ্ছপটি ছিল রেড লিস্টে, অর্থাৎ হুমকির মুখে৷ দুই মিটার লম্বা এবং আধা টন ওজনের এই কচ্ছপগুলো আকারে সবচেয়ে বড় হয়৷ এদের হুমকির মুখে পড়ার কারণ সাগরের দূষণ৷
ছবি: gemeinfrei
প্রাণী কল্যাণ সংস্থার অবস্থা
এছাড়া ব্ল্যাকব্রোও অ্যালবাট্রসের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে৷ নতুন লাল তালিকায় এই প্রজাতির পাখির আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে৷ আইইউসিএন এর পরিচালক ইয়ান স্মার্ট জানান, অনেক প্রজাতির উন্নতি হলেও এখনও ২১,০০০ প্রাণী হুমকির মুখে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষবার দেখার সুযোগ: পান্ডা, গন্ডার, লিঙ্কস
হুমকির মুখে থাকা প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম জায়ান্ট পান্ডা৷ বিশ্বে এদের সংখ্যা মাত্র ১০০০ থেকে ২০০০৷ আর আছে সুমাত্রার গন্ডার, যাদের মোট সংখ্যা মাত্র ২২০৷ এছাড়া লাইবেরিয়ার লিঙ্কসও আছে এই তালিকায়৷ এদের সংখ্যা মাত্র ৮০ থেকে ১৫০টি৷ ১৯৬৩ সাল থেকে এই রেড লিস্ট প্রকাশ করে আসছে আইইউসিএন৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
হাতির শরীরে বেশি জিন
গবেষকরা একটি তথ্য জেনে অবাক হয়েছেন যে, হাতির শরীরে এই বিশেষ জিন আছে ২০টি৷ এর ফলে হাতির শরীরে এই ব্যবস্থা আরো দ্রুত এবং কার্যকরভাবে কাজ করে৷ ক্ষতিগ্রস্ত কোষ সময়মতো ধ্বংস করতে না পারলে তা একসময় টিউমারে রূপ নেয়৷
তবে গবেষকদের মূল আবিষ্কার অবশ্য অন্য জায়গায়৷ লিঞ্চ বলছেন, ‘‘জিন সবসময়ই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে৷ কখনো কখনো তারা ভুলও করে, ফলে তৈরি হয় জিনের কিছু অকার্যকর ছদ্মজিন৷''
পি৫৩ নিয়ে গবেষণার সময় গবেষকরা আরেক জিনের খোঁজ পান, যার নাম লিউকোমিয়া ইনহিবিশন ফ্যাক্টর ৬, সংক্ষেপে এলআইএফ৬৷
গবেষকরা বলছেন, মানবদেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও হাতির শরীরে হঠাৎ করে কাজ করা শুরু করেছে এই জিনটি৷ বলতে গেলে মৃত্যু থেকেই ফিরে এসেছে জিনটি৷
‘জোম্বি জিন'
হাতির শরীর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ সরিয়ে ফেলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই এলআইএফ৬ জিন৷ কোষের শক্তিকেন্দ্র বলে পরিচিত মাইটোকন্ড্রিয়ায় ছিদ্র করে কোষকে মেরে ফেলে এই জিন৷
লিঞ্চ বলেন, ‘‘এটা অসাধারণ, কারণ, যখনই ক্যানসারের কোষ তৈরি হওয়া শুরু করে, তখনই তা সরিয়ে ফেললে ক্যানসারের ঝুঁকি প্রায় নির্মূল হয়ে যায়৷''
২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন বছর আগে এই জিন হাতির পূর্বপুরুষ হাইরেক্সের শরীরে কার্যকর ছিল৷ তবে হাইরেক্সের আকার ছিল বানরের আকারের কাছাকাছি৷ হাতির বিশাল আকৃতিও ক্যানসার প্রতিরোধী এই জিনকে জাগিয়ে তোলার আংশিক কারণ বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা৷
বড় প্রাণীর দেহে কোষের সংখ্যা বেশি, ফলে কোষ বিভাজনের পরিমাণও বেশি৷ ফলে বিজ্ঞানীদের ধারণা, বড় প্রাণীদের ক্ষেত্রে টিউমার কোষ সারানো বা সরিয়ে ফেলতেও বেশি কার্যকর মেকানিজমের প্রয়োজন হয়৷
হাতির শরীরের এই ক্যানসারবিধ্বংসী পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে মানুষের জন্য ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছেন লিঞ্চ ও তাঁর সহকর্মীরা৷