হাতির দাঁতের চাহিদা ও আফ্রিকায় চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে চোরাশিকার যোগ হওয়ার ফলে আফ্রিকা থেকে হাতিরা চিরকালের মতো উধাও হতে পারে, এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ তবু কিছু মানুষ এখনও আফ্রিকার হাতিদের বাঁচানোর স্বপ্ন দেখছেন৷
বিজ্ঞাপন
হাতিকে বাঁচাবেন যেভাবে
05:30
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক দেশটি মধ্য আফ্রিকায়; চাড, সুদান, কঙ্গো আর ক্যামেরুনের ঠিক মাঝামাঝি৷ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে ক্রান্তিমণ্ডলীয় অরণ্য; এলাকাটি আপাতত শান্ত, যুদ্ধ চলেছে দেশের অন্যত্র৷
২০১৩ সালের যুদ্ধের সময় যে সব বনকর্মীরা জাংগা-সাংগা এলাকায় থেকে গিয়েছিলেন, গোরিলা বিশেষজ্ঞ টেরেন্স ফু তাদের একজন৷ টেরেন্স শোনালেন, ‘‘বিদ্রোহীরা এখানে এসেছিল, প্রকল্পের অফিসকাছারি লুট করেছিল৷ সুদান থেকেও কিছু চোরাশিকারি এখানে পৌঁছাতে পেরেছিল৷ ওরা সাংগা বে ফরেস্ট ক্লিয়ারিং-এ গিয়ে বহু হাতি মারে, ফলে সেখানে হাতিদের বাস করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে৷''
তবুও জাংগা-সাংগার প্রাণীজগৎ একেবারে লোপ পায়নি – যার একটা কারণ জার্মানি থেকে দরাজ অর্থসাহায্য৷ ন্যাশনাল পার্কটিতে আজও প্রায় ২,০০০ গোরিলা মোটামুটি শান্তিতেই বাস করে – পশ্চিমি সমতলভূমির গোরিলা৷
আফ্রিকার হাতিদের জন্য চীন থেকে সুখবর
গত তিন বছরে হাতির দাঁতের দাম কমেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ৷ ‘সেভ দ্য এলিফ্যান্ট’ সংস্থা চীনে জরিপ করে এই তথ্য প্রকাশ করেছে৷
ছবি: AP
দাম পড়ল
২০১৪ সালে হাতির দাঁতের দাম উঠেছিল চরমে৷ তখন চীনের কালোবাজারে গজদন্তের দাম উঠেছিল কিলো প্রতি ২,১০০ ডলারে৷ কিন্তু ২০১৭ সালের সূচনায় সেই দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৭৩০ ডলারে৷
ছবি: Anup Shah
চাহিদা কমছে
হাতির দাঁতের ব্যবসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দুনিয়ায় হাতির দাঁতের সবচেয়ে বড় গ্রাহক দেশ চীনে হাতির দাঁতের চাহিদা কমছে, যার ফলে হাতির দাঁতের দাম কমছে৷ তবুও হাতির চোরাশিকার বন্ধ হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/W. Hong
বলি
চীনে হাতির দাঁতের বিপুল চাহিদার কারণে গত এক দশকের মধ্যে আফ্রিকায় হাতির সংখ্যা ১,১০,০০০ কমে ৪,১৫,০০০-এ দাঁড়িয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Okapia
চাহিদা কমার কারণ
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস এবং সেই সঙ্গে সরকারের দুর্নীতি রোধ কর্মসূচি হাতির দাঁতের চাহিদা কমার জন্য দায়ী, বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান৷ বিশেষ করে যখন সরকারি কর্মচারীদের ঘুস হিসেবে হাতির দাঁতের জিনিসপত্র দেওয়া আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Hofford
সচেতনতা বেড়েছে
জনসাধারণের মধ্যে বর্ধিত সচেতনতাও হাতির দাঁতের চাহিদা কমার একটা কারণ হতে পারে৷ সাধারণ মানুষ বুঝতে শুরু করেছে যে, হাতির দাঁতের ব্যবসা চলতে থাকলে, হাতিদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে৷
ছবি: Getty Images
হস্তি নড়ান হস্তিরে চড়ান...
‘সেভ দ্য এলিফ্যান্ট’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ডগলাস-হ্যামিল্টনের মতে, হাতির দাঁতের সামগ্রীর সঙ্গে হাতির অস্তিত্বের সংকটের যোগসূত্রটি চীনের মানুষের অজ্ঞাত ছিল না, কিন্তু এখন ক্রমেই আরো বেশি মানুষ তার গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন৷
ছবি: Getty Images
কারখানা বন্ধ
হাতির দাঁতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত লাইসেন্স-প্রাপ্ত ৩৪টি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে চীন৷ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এই আজ্ঞা বলবৎ হয়৷ এ বছর শেষ হওয়ার আগে হাতির দাঁতের সামগ্রী বিক্রির বিপণীগুলিও বন্ধ করে দেওয়া হবে৷
ছবি: Imago/Gong Bing
বেআইনি ব্যবসা
এখন প্রশ্ন হলো, হাতির দাঁত নিয়ে অবৈধ ব্যবসা কিভাবে রোখা যায়, কেননা, তা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে চোরাশিকার পুরোপুরি বন্ধ করার কোনো উপায় নেই৷
ছবি: AP Photo/Courtesy Karl Amman
নিষেধাজ্ঞা
হাতির দাঁতের আন্তর্জাতিক ব্যবসা ১৯৮৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয়৷ কিন্তু কালোবাজারে হাতির দাঁত কেনা-বেচা যতদিন চলবে, ততদিন হাতির চোরাশিকার বন্ধ হবে না, কেননা, অপরাধী আর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তারা হাতির দাঁতের চোরাচালান থেকে বিপুল মুনাফা করে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images GmbH
অগ্নিতে আহুতি
২০১৬ সালে কেনিয়া সরকার কোটি কোটি ডলার মূল্যের হাতির দাঁত জনসমক্ষে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেন৷ উদ্দেশ্য ছিল, সর্বসাধারণের কাছে জ্ঞাপন করা যে, কেনিয়া সরকার হাতির দাঁত নিয়ে ব্যবসা করার বিরোধী৷ মালাউয়িতেও এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. de Souza
দূর অস্ত
‘সেভ দ্য এলিফ্যান্ট’ সংগঠনের ইয়ান ডগলাস-হ্যামিল্টনের মতে, চীনে যে হাতির দাঁতের চাহিদা কমেছে, সেটা খুব ভালো খবর৷ কিন্তু হাতিদের বাঁচানোর জন্য তা পর্যাপ্ত নয়, কেননা, চীনে যখন চাহিদা কমছে, ঠিক তখনই লাওস, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে হাতির দাঁতের চাহিদা বাড়ছে৷
ছবি: AP
11 ছবি1 | 11
টেরেন্স বললেন, ‘‘এই পার্ক এখানকার কর্মীদের জন্য একটা রোজগারের উৎস – আমাদের প্রকল্পে তাদের ৬০ জন কাজ করে৷ সেটা খুব কম নয় – আমরা এভাবে ১২০টি পরিবারের অন্ন যোগাই৷ স্থানীয় মানুষজনের তা থেকে সুবিধা হয়৷''
তথাকথিত ‘ফরেস্ট এলিফ্যান্ট' বা জঙ্গলের হাতিরা খোলা তৃণভূমির হাতিদের চেয়ে আকারে ছোট এবং জঙ্গলেই বাস করে৷ জাংগা-সাংগায় এরকম প্রায় বারোশো হাতি আছে৷
জঙ্গলের মাঝখানে খানিকটা খোলা জায়গা৷ এখানকার মাটি নোনা৷ জন্তুজানোয়াররা সেই লবণ খেতে আসে৷
বছর খানেক হলো লুইস আরানৎস ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড ফর নেচার বা ডাব্লিউডাব্লিউএফ সংস্থার হয়ে এখানে কাজ করছেন৷ সংকটপীড়িত এলাকায় প্রকৃতি সংরক্ষণে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা আছে৷
ডাব্লিউডাব্লিউএফ জাংগা-সাংগার কর্মী লুইস আরানৎস বললেন, ‘‘আমরা খুব বেশি করতে পারি না৷ আমাদের রেঞ্জার আছে৷ আমরা চোরাশিকারিদের থামানোর চেষ্টা করি৷ কিন্তু হাতির দাঁতের চোরাচালান বন্ধ না হলে আমরা সব হাতিদের খোয়াবো বলে আমার ধারণা৷''
২০১৭ সালে এখানে ২১টি হাতি চোরাশিকারিদের হাতে মারা পড়েছে – আফ্রিকায় যা খুব বেশি বলে গণ্য করা হয় না৷ অপরদিকে কর্তৃপক্ষের কাছে বাজেয়াপ্ত করা হাতির দাঁতের পরিমাণ বাড়ছে৷ লুইস আরানৎস দেখালেন, ‘‘এটা হলো আমাদের সবচেয়ে বড় হাতির দাঁতগুলোর মধ্যে একটা; ওজনে প্রায় ১৭ কিলো৷ চোরাশিকারিদের কাছে অনেক টাকা৷''
একটি হাতির পদচিহ্নে জীবনধারণ
হাতিরা সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর এক প্রাণি৷ না, শুধু তাদের শুঁড়ের কারণে নয়, তাদের পা-ও ভীষণ স্বতন্ত্র৷ হাতিদের রেখে যাওয়া যে পদচিহ্নগুলো যখন জলে ভরে যায়, তখন তাতে অনেক প্রাণি এসে বাস করে৷ চলুন তাদের দেখে নেওয়া যাক...৷
ছবি: picture-alliance/Mary Evans Picture Library
প্রাকৃতিক প্রকৌশলী
হাতি ছাড়া আফ্রিকার কী দশা হতো একবার ভেবে দেখেছেন? পর্যটকদের বিরাট একটা আকর্ষণ যেত উধাও হয়ে৷ আফ্রিকাতে গিয়ে মস্ত কানের হাতিগুলোর আর দেখা মিলতো না৷ তবে বাস্তুসংস্থান এবং পরিবেশ রক্ষাতেও এই বিশাল প্রাণিগুলোর অবদান কিন্তু কম নয়৷
ছবি: CC BY 2.0/Benh LIEU SONG
বিশাল পায়ের পাতা
একটা বড় হাতির ওজন কমপক্ষে ৫ মেট্রিকটন৷ তাই এদের পায়ের পাতাও যে বিশালাকার হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক৷ তাই না? তা হাতিরা যখন জঙ্গল বা শুষ্ক এলাকায় হেঁটে বেড়ায়, তখন মাটির ওপর পায়ের গভীর ছাপ রেখে যায় তারা৷ মানে তাদের পায়ের চাপে মাটিতে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়৷
ছবি: picture-alliance/Mary Evans Picture Library
ছোট্ট পুকুর
মাটির ধরনের ওপর নির্ভর করে হাতিদের পায়ের চাপে ঠিক কত বড় ও গভীর গর্ত হবে৷ যত নরম মাটি, তত গভীর গর্ত৷ তবে সাধারণত হাতির পায়ের ছাপ দেড় ফুট পর্যন্ত গভীর হয়৷ আর সেই গর্ত যখন পানিতে ভরে যায়, তখন তা রূপ নেয় একটা ছোট্ট পুকুরের৷ এবং নিমেষেই তা পোকা-মাকড়ের ঘরবসতি হয়ে ওঠে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Senckenberg Museum of Natural History Görlitz/Viola Clausnitzer/
গণনা
সেনকেনব্যার্গ নেচার রিসার্চ সোসাইটি-র গবেষকরা রুয়ান্ডার কিবাল জঙ্গলে হাতির পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে দেখেছেন৷ এক একটি পায়ের ছাপে কমপক্ষে ৬১ রকম প্রজাতির পোকা-মাকড়ের সন্ধান পেয়েছেন তারা৷ এদের মধ্যে পানির পোকাও রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Hartl
প্রজননের জন্য বিস্তর জায়গা
অনেক পোকা-মাকড় ডিম পাড়ার জন্য এ ধরনের ছোট্ট পুকুরকে বেছে নেয়৷ এর দু’টি উদাহরণ হলো – ফড়িং এবং মশা৷ তাই ডিম পাড়ার মাত্র পাঁচদিনের মধ্যেই এই গর্তগুলোর পানি শূককীটে ভরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/F. Fox
আমার এলাকা
পূর্ণ বয়স্ক ফড়িংরা তাদের এই পুকুরটিকে ভীষণ ভালোবাসে৷ শুধু তাই নয়, অন্যরা যাতে সেখানে ভাগ না বসায় সেটা প্রতিরোধ করে তারা৷ এ ধরনের সুন্দর একটা বাড়ি তো রক্ষা করাই উচিত, তাই না?
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/P. Schuetz
অন্ধকার দিক
যেসব মশা ঐ পুলে জন্ম নেয়, সেগুলো ঐ এলাকার পাখিসহ অন্যান্য প্রাণিদের খাদ্য৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রে বাস্তুসংস্থানেরও একটা গুরুত্ব রয়েছে৷ তবে ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুর মতো রোগ ছড়াতেও তাদের তুলনা নেই!
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/F. Dana
7 ছবি1 | 7
লুইস আরানৎস ৩৭ বছর ধরে আফ্রিকায় প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজ করছেন ও দেখেছেন, মহাদেশটি থেকে হাতিরা কীভাবে ধীরে ধীরে উধাও হচ্ছে৷ তিনি জানেন যে, ‘‘সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের শেষ হাতিগুলো আজ এখানে, বাকি দেশটায় আর কোনো হাতি নেই; চোরাশিকারিরা তাদের সবাইকে শেষ করেছে ও আমরা জানি যে, ওরা এবার এখানে এসে আমাদের হাতিগুলোকে মারার চেষ্টা করবে৷ কাজেই হাতিগুলোকে তাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে৷''
পার্কে টহল দেবার মতো রেঞ্জারের অভাব নেই, অভাব হল বন্দুক ও গুলিবারুদের, যা ছাড়া পেশাদার চোরাশিকারিদের সাথে যোঝা সম্ভব নয়৷ গোটা আফ্রিকাতেই এই অবস্থা৷ লুইস আরানৎসের ভাষ্যে, ‘‘এভাবে বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন – যারা হাতির দাঁত কেনেন, তাদের ওটাই মূল সমস্যা৷ তারা ভাবেন যে, শুধু হাতিরাই মারা যাচ্ছে৷ কিন্তু বাস্তবে চোরাশিকারি আর রেঞ্জাররা মিলে বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন৷''
লুইস আরানৎস ইতিপূর্বে চাড ও উত্তর কঙ্গোয় কর্মকালে চোরাশিকারিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মোট ৪০ জন সহকর্মীকে হারিয়েছেন৷ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন লুইস: ‘‘খুবই দুঃখের কথা৷ আমরা আফ্রিকাকে ধ্বংস করতে চলেছি, অথচ তা রোখার জন্য কিছুই করছি না৷ আমরা যেন একটা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি ও সেই যুদ্ধে হারতে চলেছি – কিন্তু কেউ তা স্বীকার করতে চায় না৷ আমরা যদি আগামী পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে কিছু না করি, তাহলে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে৷''
জঙ্গলের মাঝখানে সাংগা ফরেস্ট ক্লিয়ারিং-এ আজও যে অনেক হাতি দেখতে পাওয়া যায়৷ লুইসের মতে তার কারণ: ‘‘বন্দুক আর গুলিবারুদ নিয়ে আমাদের চিরকালই একটা সমস্যা ছিল৷ সবাই বলে: ‘তোমরা বন্দুক দিয়ে কী করে হাতিদের বাঁচাবে?' আমরা হাতিদের বাঁচানোর জন্য বন্দুক চাই না; আমরা বন্দুক চাই, যারা হাতিদের বাঁচাচ্ছে, তাদের বাঁচানোর জন্য৷ সেটা আলাদা৷ চোরাশিকারিরা বন্দুক নিয়ে আসে; আমাদের রেঞ্জারদের বন্দুক না থাকলে তারা মারা পড়বে৷''