সস্তার ঘড়ির সম্ভারে যান্ত্রিক ঘড়ি যেন হারিয়ে যাচ্ছে৷ দক্ষ হাতে তিলে তিলে তৈরি করা উচ্চ মানের ঘড়ির আকর্ষণ কিন্তু আজও ফুরিয়ে যায়নি৷ জার্মানির এমন এক প্রস্তুতকারক পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ঘড়ি সত্যি বিস্ময়কর এক যন্ত্র৷ কখনো তাদের আয়ু মালিকদের থেকেও বেশি৷ এর সৃষ্টিকর্তারা তাদের মাস্টারপিসের মধ্যে এমনকি কিছু মানবিক চরিত্রও ভরে দিয়েছেন৷ ঘড়ি প্রস্তুতকারক হিসেবে অলিভার মাৎসডর্ফ মনে করেন, যান্ত্রিক ঘড়ি আসলে জীবন্ত সত্তা, অস্থিরতার সঞ্চালন, হৃৎস্পন্দনের মতো৷
লাঙে অ্যান্ড সান্স কোম্পানিতে চিরায়ত পদ্ধতিতে হাতে করে যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরি হয়৷ শিক্ষানবিশ রিশার্ড স্টেফান বলেন, ‘‘শুরুতে অনেকে সাহস পায় না, কারণ তারা এর মূল্য জানে৷ তার পেছনে কতটা পরিশ্রম রয়েছে, সেটাও হয়ত জানে৷ সেই অনুভূতি কেটে গেলে ধীরে ধীরে স্পর্শ করে৷''
অলিভার মাৎসডর্ফ বলেন, শুরুতে সবাই সতর্ক থাকে৷ মনে করে, একেবারে না ছোঁয়াই ভালো৷ মনের জোরে ঘড়ি তৈরি করার বাসনা জাগে৷''
রিশার্ড স্টেফান তৃতীয় প্রজন্মের ঘড়ি প্রস্তুতকারক হতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন৷ উচ্চ মানের একটি ঘড়ি তৈরি করতে শিক্ষানবিশদের অনেক বছরের প্রস্তুতি লাগে৷ তাদের কাছে প্রত্যাশার মাত্রা দিনে দিনে বেড়ে যায়৷ রিশার্ড বলেন, ‘‘শুরুতে স্ক্রু ড্রাইভার পিছলে গেলে অথবা হাত ফসকে কিছু মেঝেতে পড়ে গেলেও কিছু এসে যেত না৷ দ্রুত সে সব খুঁজে পাওয়া যেত৷ এখন খুঁজতে অনেক সময় লাগে৷ অনেক হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়নি৷''
ঘড়ির কারণে গ্রেপ্তার, তারপরই ‘হিরো’ আহমেদ
ডালাস শহরের ঘরে বসে একটি ঘড়ি বানিয়েছিল আহমেদ মোহামেদ৷ তা নিয়েই শুরু হয়ে গেল হুলুস্থুল৷ প্রথমে গ্রেপ্তার৷ তারপর গ্রেপ্তারের নিন্দা আর আহমেদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ৷ বারাক ওবামাও দাওয়াত দিয়েছে তাকে!
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/V. Bryant
শিক্ষককে খুশি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার
সুদানি বংশোদ্ভূত আহমেদ মোহামেদ ডালাসের একটি স্কুলে পড়ে৷ ঘরে বানানো একটা ঘড়ি সেই স্কুলেই নিয়ে গিয়েছিল ১৪ বছর বয়সি কিশোর৷ লক্ষ্য ছিল শিক্ষক এবং সহপাঠিদের অবাক এবং খুশি করা৷ উল্টো ফল হয়েছে তাতে৷ এক শিক্ষক দেখে প্রশংসা করেছিলেন ঠিকই, তবে একসময় যেই না ঘড়িটির অ্যালার্ম বেজে উঠল অমনি অন্য ক্লাসের এক শিক্ষক ফোন করে দিল পুলিশে৷ তারপরই হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় আহমেদকে৷
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/V. Bryant
প্রতিবাদের ঝড়
নিরীহ, আদুরে চেহারার আহমেদকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার একটা ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে৷ সেই ছবি দেখেই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সবাই৷ সবার এক কথা – নিজের বানানো ঘড়ি স্কুলে নিয়ে যাওয়ায় একটি ছেলে গ্রেপ্তার হবে এ কেমন কথা? এ তো ভারি অন্যায়! ছবিতে বাবার সঙ্গে আহমেদ৷
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/B. Wade
সমর্থনের জোয়ার, ওবামার নিমন্ত্রণ
সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামাও স্কুল এবং টেক্সাস পুলিশের আচরণে প্রতিবাদ জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেননি৷ হোয়াইট হাউসে তাঁর সঙ্গে একটু সময় কাটানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন ওবামা৷ আহমেদের উদ্দেশ্যে টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘‘সুন্দর ঘড়ি, আহমেদ! তুমি কি ওটা হোয়াইট হাউসে নিয়ে আসতে চাও? বিজ্ঞান ভালোবাসো তুমি, তোমার মতো শিশুদের আমরা উৎসাহ দিতে চাই৷ ’’
ছবি: Reuters/J. Ernst
গুগল মেলায় বিশেষ আসন
উদ্ভাবনের নেশা আছে এমন কিশোর আহমেদ মোহামেদের জন্য গুগলও দারুণ এক অফার দিয়েছে৷ তারা জানিয়েছে, মিষ্টি ছেলে আহমেদের জন্য গুগল-এর বিজ্ঞান মেলায় একটি আসন ইতিমধ্য বরাদ্দ করা হয়ে গেছে৷
ছবি: www.google.de
সাকারবার্গও আহমেদের পাশে
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক সাকারবার্গও আহমেদকে কিছুক্ষণের জন্য পাশে চান৷ যখনই সময় হবে আহমেদ যেন একবার ফেসবুকের প্রধান কার্যালয়ে ঘুরে যায় – এই অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
নাসায় আমন্ত্রণ
ঘড়িসহ যখন স্কুল থেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় আহমেদের পরনে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা-র লোগো আঁকা টি-শার্ট৷ নাসা তাতে খুবই খুশি৷ তারাও সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছে আহমেদকে৷
ডালাসের স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগে পুলিশ আহমেদকে গ্রেপ্তার করায় হিলারি ক্লিনটনও ক্ষুব্ধ৷ আহমেদ যাতে ভবিষ্যতেও উদ্ভাবনের নেশা না ছাড়ে এমন অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি টুইটারে৷
ছবি: AP
পুলিশের বক্তব্য...
ডালাস পুলিশ বলেছে, আহমেদ মোহামেদের খারাপ কোনো ভাবনা ছিল না, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত৷ স্কুল কর্তৃপক্ষ বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এক মুসলিম কিশোরের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে – সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকেই এমন ধারণা প্রকাশ করেছেন৷ তবে টেক্সাসের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘এখন সময়টাই এমন যে কোনো কিছুকেই হালকাভাবে দেখা খুব কঠিন৷ তাছাড়া ডিভাইসটা দেখলে কারো কারো সন্দেহ হতেই পারে৷’’
ছবি: Reuters/N. Wiechec
আহমেদ যা বললো...
ডালাস মর্নিং নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কারো প্রতি বিশেষ কোনো অভিযোগ করেনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়া ১৪ বছর বয়সি মুসলিম কিশোর৷ নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে তার খুব ভালো লাগে – এ কথা জানিয়ে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ও শুধু বলেছে, ‘‘আমি একটি ঘড়ি বানিয়েছিলাম৷ আমি ছোটখাট একটা কিছু দেখাতে চেয়েছিলাম....কিন্তু ওরা ভুল বুঝল আর তাই ওটা বোমার মতো কিছু হতে পারে ভেবে গ্রেপ্তার করা হলো৷’’
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/V. Bryant
9 ছবি1 | 9
প্রত্যেক ঘড়ির মধ্যে প্রায় ১,০০০ যন্ত্রাংশ থাকে৷ সেই ঘড়ি প্রায় একই সংখ্যক মানুষের হাতবদল হয়৷ অলিভার মাৎসডর্ফ বলেন, ‘‘এগুলি অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ৷ প্রত্যেকটি সামনে অথবা পিছনে কোনো না কোনো কাজ করা হয়েছে৷ ক্রেতারা প্রায়ই তা দেখতে পান না৷ কিন্তু আমরা তাদের সেই প্রতিশ্রুতি দেই এবং নতুন ঘড়ি প্রস্তুতকারককেও এখানে সেটা অনুভব করতে পারেন৷ বিশেষ কিছু করার অনুভূতি থাকতে হবে৷''
রুপোর ক্ষুদ্র অংশগুলি পালিশ করতে হয়৷ ১৬৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান প্রতিটি যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে উচ্চ মান বজায় রেখে চলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ এর গ্যারেন্টি হিসেবে প্রত্যেক ঘড়ির মধ্যে প্রস্তুতকারকের ব্যক্তিগত স্বাক্ষর শোভা পাচ্ছে৷ রিশার্ড জানেন, শুধুমাত্র সেরা শিক্ষানবিশরাই কোনোদিন মাস্টার ওয়াচমেকার হয়ে উঠতে পারেন৷ অলিভার মাৎসডর্ফ বলেন, ‘‘শুরুর দিকে একটা ভয় কাজ করে৷ একদিকে সেটা থাকলে ভালো৷ প্রত্যেক ঘড়ি প্রস্তুতকারকের ধীরে ধীরে ভয় কমতে থাকে৷ কিন্তু ঘড়ির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ লোপ পেলে চলবে না৷ কারণ সেই শ্রদ্ধা লোপ পেলে আমার মনে হয় মানও লোপ পাবে৷''
আজকের দিনে সহজ কোয়ারৎস ঘড়ি যান্ত্রিক ঘড়ির জায়গা নিতে পারে৷ তা সত্ত্বেও হাতের কাজের কদর এখনো রয়েছে৷ বড় আকারে তৈরি পণ্যের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহের মনোভাবও কাজ করছে৷ অলিভার মাৎসডর্ফ বলেন, ‘‘এই ঘড়ির নিজস্ব এক চরিত্র রয়েছে৷ প্রত্যেকটি ঘড়িই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷''
এমন সব ঘড়ি বহুকাল ধরেই সংগ্রাহকদের প্রিয়৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির মূল্যও বেড়ে যায়৷