ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার উঁচুতে থাকা হাবল টেলিস্কোপের ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে এ বছর৷ মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্যোতির্বিদদের ধারণা একেবারেই পালটে দিয়েছে এটি৷
বিজ্ঞাপন
মহাবিশ্বের ‘লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউড' এলাকায় অবস্থান করা ‘ট্যারানচুলা নীহারিকা’, পৃথিবী থেকে সাড়ে ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ‘কারিনা নীহারিকা'র ছবি তুলেছে হাবল টেলিস্কোপ৷
জার্মানির রুয়র ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট রাল্ফ-ইয়ুর্গেন ডেটমার শুরু থেকেই হাবল টেলিস্কোপ ব্যবহার করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘হাবল টেলিস্কোপের উচ্চ রেজ্যুলেশনের কারণে আমাদের মহাবিশ্বের আকার যে খুব দ্রুত বাড়ছে, তা প্রমাণিত হয়েছে৷ গত ৫০ বছর ধরে আমরা এমনটা ভাবছিলাম৷ কিন্তু প্রমাণ করতে পারছিলাম না৷ এখন এটা প্রমাণিত হওয়ায় মহাবিশ্বের শুরু ও প্রসার সম্পর্কে আগের ধারনা বদলে গেছে৷’’
কয়েক দশকের পরিকল্পনা শেষে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল স্পেস শাটল ডিসকোভারি হাবল টেলিস্কোপ নিয়ে অর্বিটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে৷ পৃথিবী থেকে সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার উঁচুতে এই টেলিস্কোপের অবস্থান৷ এটি পৃথিবীর পরিবেশের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে তথ্য পাঠাবে বলে মনে করা হয়েছিল৷
কিন্তু শুরুতে ঝাপসা ছবি পাঠাচ্ছিল দেড় বিলিয়ন ডলারের এই টেলিস্কোপ৷ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমনটা হয়েছিল৷ নির্মাণের পর পৃথিবীতে পরীক্ষা করে না দেখায় এই সমস্যা হয়েছিল৷
ত্রুটি দূর করতে নভচারীরা ১৯৯৩ সালে হাবলের কাছে উড়ে গিয়েছিলেন৷ তারা একটি লেন্স বসিয়ে দিয়েছিলেন- যেমনটা চোখের সমস্যা দূর করতে আমরা চশমা ব্যবহার করি৷
মহাকাশে তিন লাখ নতুন ছায়াপথ আবিষ্কার
‘লোফার’ রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে নতুন প্রায় তিন লাখ ছায়াপথ আবিষ্কার করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা৷ বিজ্ঞানীদের আশা, এর মাধ্যমে কৃষ্ণগহ্বর এবং ছায়াপথ কীভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে৷
ছবি: LOFAR/Maya Horton
লাল আলোকচ্ছটা
‘হেটডেক্স’ এলাকার এই ‘মোন্টাজ’ এ অনেকগুলো ছায়াপথ দেখা যাচ্ছে৷ ১৮টি দেশের ২০০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী এই লাখো ছায়াপথ আবিষ্কার করেছেন, যা আগে অন্য কেউ কখনও দেখেনি৷ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রেডিও টেলিস্কোপ নেটওয়ার্ক ‘লো ফ্রিকোয়েন্সি অ্যারে’ বা ‘লোফার’ এর মাধ্যমে উত্তর আকাশে একটি নতুন মানচিত্র তৈরি করেছেন৷
ছবি: LOFAR/Judith Croston
জ্যোতির্ময় পাখা
রেডিও উৎস ‘বিথ্রি জিরো ওয়ান ফাইভ সেভেন প্লাস ফোর জিরো সিক্স’ উৎসের চৌম্বকক্ষেত্র সম্পর্কে বিশাল আকারের আলোড়নের উপস্থিতি নির্দেশ করে৷ অনেকেই এটাকে পাখার আকৃতি হিসেবে দেখতে পায়৷
ছবি: LOFAR/Maya Horton
সর্পিল ছায়াপথ
এই উজ্জ্বল বর্ণিল লেজটি সর্পিল ছায়াপথ ‘এম ওয়ানজিরোসিক্স’ এর৷ গবেষকদের বিশ্বাস, অগ্নিশিখার মতো দেখতে এই কাঠামো ছায়াপথের কেন্দ্রীয় বিশাল আকারের কৃষ্ণগহ্বরের কর্মকাণ্ডের ফলাফল৷ হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ মারকুস ব্রুগেন বলেন, ‘‘লোফারের মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করছি, ছায়াপথের যেখানে কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে, সেখানে এটা থাকার কারণ কি?’’
ছবি: LOFAR/Cyril Tasse
‘ঘূর্ণাবর্ত ছায়াপথ’
এমফিফটিওয়ান ‘ঘূর্ণাবর্ত ছায়াপথ’ নামে পরিচিত বলে জানিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা৷ এর অবস্থান পৃথিবী থেকে দেড় থেকে সাড়ে তিন কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে৷ এর কেন্দ্রে রয়েছে বেশ বড় আকারের কৃষ্ণগহ্বর৷
ছবি: LOFAR/Sean Mooney
রক্তচক্ষু
‘সিআইজেডএ জেটুটুফোরটু পয়েন্ট এইট প্লাস ফাইভ থ্রি জিরো ওয়ান’ ছায়াপথ গুচ্ছের এই নাম দেয়া হয়েছে৷ গবেষকদের আশা, লোফারের নতুন তথ্য ছায়াপথ গুচ্ছ কীভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কেও ধারণা দেবে৷
ছবি: LOFAR/Duy Hoang
মহাকাশে বিস্ফোরণ
ছায়াপথ ‘আইসি থ্রিফোরটু’ এর সর্পিল বাহুতে সুপারনোভার বিস্ফোরণের ছবি আপনারা দেখছেন এখানে৷ নতুন আবিষ্কৃত ছায়াপথগুলো সম্পর্কে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সাইরিল টাসে জানালেন, ‘‘এর মাধ্যমে মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন দিক উন্মোচিত হলো৷’’
ছবি: LOFAR/Maya Horton
চমকপ্রদ তারকাপুঞ্জ
লোফারের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অপূর্ব কিছু ছবির জন্য মাঝে মাঝে কৌশলের আশ্রয় নেন৷
ছবি: LOFAR/Cyril Tasse
এক কোটি ডিভিডি
ছায়াপথ গুচ্ছ ‘অ্যাবেল ওয়ানথ্রিওয়ানফোর’ পৃথিবী থেকে অন্তত ৪৬ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত৷ লোফারের গবেষকরা এটি সহ অন্তত তিন লাখ নতুন ছায়াপথের অনেক তথ্য সংগ্রহ করছেন৷ জার্মানির বিলেফেল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডোমিনিক সোয়ার্ৎস জানালেন, ‘‘আমরা এত তথ্য পেয়েছি যা অন্তত এক কোটি ডিভিডিতে ধারণ করা যায়৷ আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি৷’’
ছবি: LOFAR/Amanda Wilber
8 ছবি1 | 8
ফলে শুরুর তিন বছর পর স্পষ্ট দেখা শুরু করেছিল হাবল৷
ডেটমার বলেন, ‘‘এরপরই আসলে হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী ছবি পাওয়া সম্ভব হয়েছিল৷ হাবলকে মেরামত করতে পারার সুযোগ থাকায় পরেও আরো উন্নয়ন কাজ করা গেছে৷ অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি ইনস্টল করতে পারায় ৩০ বছর পর এখনও আমরা হাবলকে কাজে লাগাতে পারছি৷’’
এখন পর্যন্ত মোট পাঁচবার হাবল ঠিক করতে নভচারীরা সেখানে উড়ে গিয়েছেন৷ শেষবার গেছেন ২০০৯ সালে৷ সেই সময় সেন্সরগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে, ক্যামেরার শক্তি বাড়ানো হয়েছে, সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে৷ এসব কারণে হাবল এখনও সক্রিয় রয়েছে এবং মহাবিশ্বের ছবি তুলে যাচ্ছে৷
অন্যান্য গ্যালাক্সিতে গ্যাস আর তারার চলাফেরার ছবি তুলেছে হাবল৷ তারার চারদিকে ঘোরা গ্রহ আবিষ্কার করেছে৷ হাবলের কারণেই আমরা এখন জানি, আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৭ বিলিয়ন!