জার্মানির হামবুর্গ শহরে শুক্রবার এক হামলার পর কট্টর ইসলামপন্থি ও ‘বিপজ্জনক' রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের বহিষ্কার বা আটক করার জন্য চাপ বাড়ছে৷ তাদের অবাধ বিচরণ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি উঠছে৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার দুপুরে হামবুর্গ শহরে এক সুপারমার্কেটে এক আততায়ী নির্বিচারে আশেপাশের মানুষের উপর ছুরি হামলা চালিয়েছে৷ সম্ভবত সেখানেই সে ছুরিটি চুরি করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হামলা চালিয়েছে৷ তার ছুরির আঘাতে এক ব্যক্তি নিহত ও সাতজন আহত হয়েছে৷ পুলিশ তাকে আটক করেছে৷ সংযুক্ত আরব আমিরাতে জন্মগ্রহণ করা ফিলিস্তিনি ব্যক্তি ২০১৫ সালে শরণার্থী হিসেবে জার্মানিতে এসেছিল৷ তার আগে সে নরওয়ে, সুইডেন ও স্পেনে গিয়েছিল বলে জানা গেছে৷ ২৬ বছর বয়সি আততায়ী যে উগ্র ইসলামি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তা অজানা ছিল না৷ কিন্তু সেই ব্যক্তিকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো কারণ দেখেন নি কর্মকর্তারা৷ আততায়ীর উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট নিয়ে পুলিশ এখনো তদন্ত চালাচ্ছে৷ তার মানসিক সমস্যা ছিল, এমন ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে৷
জার্মানিতে কোনো হামলার নেপথ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী জড়িত থাকলে সেই অপরাধকে ঘিরে বাড়তি আগ্রহের সৃষ্টি হয়৷ বিশেষ করে সেই আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন খারিজ হওয়ার পরেও তাকে কেন জার্মানি থেকে বহিষ্কার করা হয়নি বা যায়নি, এই প্রশ্ন বার বার উঠতে থাকে৷ গত বছর ডিসেম্বর মাসে বার্লিনে সন্ত্রাসী হামলার পর এমন আশ্রয়পার্থীদের প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে বাড়তি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে৷ তবে হামবুর্গ শহরে সপ্তাহান্তে হামলার পর বিষয়টি নিয়ে আবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷
হামবুর্গের কর্তৃপক্ষ এমন মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারতো কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ নগর রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে, যে কর্তৃপক্ষ আততায়ী সম্পর্কে সব তথ্য ঠিকমতো বিশ্লেষণ করে বিপদের আশঙ্কার সঠিক মূল্যায়ন করেছিল কিনা৷ রক্ষণশীল মহলের রাজনীতিকদের মতে, কট্টর ইসলামপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হবার পর এমন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের অবাধ বিচরণ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত৷ তাছাড়া যে সব দেশ তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে সহযোগিতা করছে না, তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো উচিত৷ তাছাড়া জার্মানির ফেডারেল কাঠামোর কারণে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে, তার ফলেও এমন আশ্রয়প্রার্থীদের স্বদেশে ফেরাতে সমস্যা দেখা দেয় বলে সমালোচকরা মনে করছেন৷ এই দায়িত্ব পুরোপুরি ফেডারেল সরকারের হাতে তুলে দেবার জন্যও চাপ বাড়ছে৷ তবে প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত বর্তমান নীতির ফলে অনেক আশ্রয়প্রার্থীর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠছে বলেও অভিযোগ উঠছে৷
শনিবারই জার্মানিতে নতুন এক আইন কার্যকর করা হয়েছে, যার আওতায় আবেদন নাকচ হলে ‘বিপজ্জনক' হিসেবে চিহ্নিত আশ্রয়প্রার্থীদের অনেক সহজে আটক রাখা সম্ভব হবে অথবা তাদের উপর নজরদারি চালানো যাবে৷ তাছাড়া তাদের পায়ে ইলেকট্রনিক বেড়ি পরিয়ে রাখা যাবে, যাতে তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখা সম্ভব হবে৷
এসবি/ডিজি (ডিপিএ, এএফপি)
ইউরোপে শরণার্থী সংকট কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় সহিংসতা বৃদ্ধি থেকে ইউরোপের অসংলগ্ন শরণার্থী নীতি অবধি ইউরোপে শরণার্থী সংকটে কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যতা থেকে পালানো
২০১৪ সালের শেষের দিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চতুর্থ বছরে পা দেয়ার প্রাক্কালে এবং দেশটির উত্তরাঞ্চলে তথাকথিত ‘ইসলামিট স্টেট’-এর বিস্তার ঘটার পর সিরীয়দের দেশত্যাগের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়৷ একইসময়ে সহিংসতা এবং দারিদ্র্যতা থেকে বাঁচতে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, নিগার এবং কসভোর অনেক মানুষ ইউরোপমুখী হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সীমান্তের ওপারে আশ্রয় খোঁজা
সিরীয় শরণার্থীদের অধিকাংশই ২০১১ সাল থেকে সে দেশের সীমান্ত সংলগ্ন তুরস্ক, লেবানন এবং জর্ডানে আশ্রয় নিতে শুরু করেন৷ কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ সেসব দেশের শরণার্থী শিবিরগুলো পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেখানকার বাসিন্দারা সন্তানদের শিক্ষা দিতে না পারায় এবং কাজ না পাওয়ায় এক পর্যায়ে আরো দূরে কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পায়ে হেঁটে লম্বা পথ পাড়ি
২০১৫ সালে ১৫ লাখের মতো শরণার্থী ‘বলকান রুট’ ধরে পায়ে হেঁটে গ্রিস থেকে পশ্চিম ইউরোপে চলে আসেন৷ সেসময় ইউরোপের শেঙেন চুক্তি, যার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই চলাচাল সম্ভব, নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ কেননা শরণার্থীরা গ্রিস থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপের অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলোর দিকে আগাতে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardy
সমুদ্র পাড়ির উন্মত্ত চেষ্টা
সেসময় হাজার হাজার শরণার্থী ‘ওভারক্রাউডেড’ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে শুরু করেন৷ লিবিয়া থেকে ইটালি অভিমুখী বিপজ্জনক সেই যাত্রায় অংশ নিতে গিয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে সাগরে ডুবে যায় অন্তত আটশ’ মানুষ৷ আর বছর শেষে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার৷
ছবি: Reuters/D. Zammit Lupi
সীমান্তে চাপ
ইউরোপের বহির্সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় কয়েকটি রাষ্ট্র চাপে পড়ে যায়৷ হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, ম্যাসিডোনিয়া এবং অস্ট্রিয়া এক পর্যায়ে সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, সেসময় শরণার্থী আইন কঠোর করা হয় এবং শেঙেনভুক্ত কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে৷
ছবি: picture-alliance/epa/B. Mohai
বন্ধ দরজা খুলে দেয়া
জার্মান চ্যান্সেল আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর ‘ওপেন-ডোর’ শরণার্থী নীতির কারণে বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে অনেক শরণার্থীই ইউরোপে আসতে উৎসাহ পেয়েছেন৷ এক পর্যায়ে অবশ্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত পথ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে জার্মানিও৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি
২০১৬ সালের শুরুতে ইইউ এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়৷ এই চুক্তির আওতায় গ্রিসে আসা শরণার্থীদের আবারো তুরস্কে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করে৷ নভেম্বর মাসে অবশ্য তুরস্কের ইইউ-তে প্রবেশের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা স্থগিত ঘোষণার পর, সেই চুক্তি আবারো নড়বড়ে হয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Altan
পরিস্থিতি বদলের কোনো লক্ষণ নেই
ইউরোপজুড়ে অভিবাসীবিরোধী মানসিকতা বাড়তে থাকলেও সরকারগুলো সম্মিলিতভাবে শরণার্থী সংকট মোকাবিলার কোনো সঠিক পন্থা এখনো খুঁজে পাননি৷ কোটা করে শরণার্থীদের ইইউ-ভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চলমান সহিংসতার ইতি ঘটার কোনো লক্ষণও নেই৷ ওদিকে, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে শরণার্থীদের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে৷