শনিবারের হামলার পর সিরিয়া সংক্রান্ত নীতি নিয়ে অ্যামেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ অন্যদিকে রাশিয়া, সিরিয়া ও ইরান এই হামলার তীব্র সমালোচনা করে পশ্চিমা বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র সারা স্যান্ডার্স বলেছেন, শনিবারের হামলা সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্যদের যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরাতে বদ্ধপরিকর৷ তবে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট সংগঠনকে পুরোপুরি দমন করে তাদের প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা দূর করতে চায় ওয়াশিংটন৷ তাছাড়া অ্যামেরিকা চায়, আঞ্চলিক সহযোগী দেশগুলি সেই অঞ্চলে নিরাপত্তার খাতিরে আরও সামরিক ও আর্থিক দায়দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিক৷
জাতিসংঘে মার্কিন দূত নিকি হ্যালি রাশিয়ার উপর আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চাপানোর আভাস দিয়েছেন৷ বিশেষ করে যেসব রুশ কোম্পানি আসাদ প্রশাসনকে রাসায়নিক হামলার সাজসরঞ্জাম সরবরাহ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে, বলেন তিনি৷ সোমবারই সেইসব নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হবে৷
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ রবিবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি ট্রাম্পকে সিরিয়ায় মার্কিন সৈন্য আপাতত মোতায়েন রাখার গুরুত্ব বোঝাতে পেরেছেন৷ তাছাড়া শনিবারের হামলা শুধু রাসায়নিক হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত এলাকায় সীমিত রাখতেও পেরেছেন তিনি৷ মাক্রোঁ বলেন, সিরিয়া সংকটের সার্বিক সমাধানের লক্ষ্যে ফ্রান্স জাতিসংঘে এক প্রস্তাব পেশ করতে চলেছে৷ সোমবারই কূটনৈতিক উদ্যোগ শুরু হবে৷
রাশিয়ার সঙ্গে বর্তমান উত্তেজনা সত্ত্বেও সে দেশের সঙ্গেও সিরিয়ার বিষয়ে সংলাপ চালানো হবে৷ শনিবারের হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাশার আল আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে মোটেই কোনো যুদ্ধ শুরু হয়নি৷ নিরীহ মানুষের উপর রাসায়নিক অস্ত্র হামলার শাস্তি দিতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ তিনি মনে করিয়ে দেন, ২০১৩ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাব অনুযায়ী সিরিয়া তার রাসায়নিক অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করার অঙ্গীকার করেও কার্যত তা মনেনি৷ সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সম্মতি ছাড়াও সিরিয়ার উপর হামলা বৈধ বলে তিনি মনে করেন৷
সিরিয়ায় শনিবার অ্যামেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হামলার পর রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের উত্তেজনা আরও বেড়ে গেছে৷ সিরিয়ার সরকার ও রাশিয়া এখনো ৭ই এপ্রিল রাসায়নিক হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে চলেছে৷ তারা শনিবারের হামলার তীব্র সমালোচনা করেছে এবং বলেছে, দুই দেশ শুধু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নয়, আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষেও লড়াই করে চলেছে৷ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন৷ ‘বেআইনি’ এই হামলার ফলে সিরিয়া সংকট সমাধানের সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে উঠছে বলে দুই দেশ মনে করে৷
এদিকে ইউরোপে সিরিয়া নীতি নিয়ে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ সোমবার ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বিভাজন কাটিয়ে ঐক্য আনার উদ্যোগ নিচ্ছেন৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল শনিবারের হামলার প্রতি সমর্থন জানালেও সার্বিকভাবে ইইউ দেশগুলি ইউরোপের দোরগোড়ায় উত্তেজনা সীমিত রাখার পক্ষে৷ তাছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি নিয়েও দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, এএফপি)
শীতল যুদ্ধ কি ফিরে আসছে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বার্লিন প্রাচীর পতনের সময় পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলেছে৷ সিরিয়াসহ আরও কয়েকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও অ্যামেরিকার মধ্যে সংঘাত বেড়ে চলেছে৷
ছবি: AP
শীতল যুদ্ধের চরিত্র
শুধু দুটি পরাশক্তি নয়, পরমাণু অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত দুই শিবির যে কোনো সময়ে একে অপরের উপর হামলা চালাতে পারে৷ অথচ বাস্তবে সেরকম হামলা অথবা ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে একটি কাঠামো সফলভাবে কাজ করেছে৷ ‘শান্তিপূর্ণ’ সেই সহাবস্থানে আঁচ পড়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Wieseler
উত্তেজনা সত্ত্বেও ‘স্থিতিশীলতা
অ্যামেরিকার নেতৃত্বে সামরিক জোট ন্যাটো ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ জোট আজকের দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট স্থিতিশীল ছিল৷ রাতারাতি কোনো আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনাও ছিল অকল্পনীয়৷ এমনকি জোটের বাইরেও ওয়াশিংটন ও মস্কোপন্থি দেশগুলির অবস্থান সহজে বদলায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শান্তির ‘অলীক’ প্রত্যাশা
বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর রাশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপে প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তনের ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বৈরি মনোভাবের চূড়ান্ত অবসান ঘটবে, এমন আশা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো প্রায় রাশিয়ার দোরগোড়ায় গিয়ে পৌঁছে যায়৷ খোদ রাশিয়াকেও পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে৷
ছবি: Reuters/Axel Schmidt
‘দুর্বল রাশিয়া’
মিখাইল গর্বাচভ ও বরিস ইয়েলৎসিন শীর্ষ নেতা হিসেবে রাশিয়ার গৌরব খর্ব করে সে দেশের পতন তরান্বিত করেছেন, অনেক মানুষের মনে এমন অভিযোগ রয়েছে৷ ভ্লাদিমির পুটিন সেই গৌরব ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট সফল হয়েছেন বলে মনে করেন তাঁরা৷ রাশিয়ার স্বার্থ জোরদার করতে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে লাগাতার সংঘাতেও ভয় পান না, এমন ধারণা তাঁকে ক্রমশ আরও শক্তিশালী করে তুলছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP/SZ Photo
স্বার্থের সংঘাত
ইউক্রেন, ইরান, সিরিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকটের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থের সংঘাত তীব্র হয়ে উঠছে৷ নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও রাশিয়া প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তার ঘোষিত স্বার্থ কায়েম করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ প্রশাসনের প্রতি সমর্থন ও সাহায্য তারই অন্যতম দৃষ্টান্ত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Tass/M. Metzel
অস্থায়ী আনুগত্য
শীতল যুদ্ধের সময়ে দুই পরাশক্তির কোনো একটির প্রতি বাকি দেশগুলির স্থায়ী আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি৷ আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ তুরস্কের মতো ন্যাটো সদস্য দেশ জোটসঙ্গীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে৷ পূর্ব ইউরোপের কিছু ইইউ সদস্য দেশও পুটিন প্রশাসনের প্রতি বেশি ঝুঁকতে শুরু করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Saribas
সিরিয়াকে ঘিরে আবার বিশ্বযুদ্ধ?
আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে এর আগেও রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে রাশিয়াকে সতর্ক করে সিরিয়ার উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছেন, তার ফলে দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা বাস্তব হয়ে উঠেছে৷ শেষ পর্যন্ত এমন সংঘাত এড়ানো সম্ভব হলেও এমন যুদ্ধ এড়ানোর কাঠামো দুর্বল হয়ে উঠেছে৷