অবশেষে জেরুসালেমের টেম্পল মাউন্টে ঢোকার পথ থেকে মেটাল ডিটেক্টর সরিয়ে নেয়ার পথই বেছে নিয়েছে ইসরায়েল৷ বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হলো তারা৷
বিজ্ঞাপন
বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনার পর ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জেরুসালেমের এই পবিত্র স্থানে প্রবেশদ্বারে মেটাল ডিটেক্টর সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়৷ দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিস থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মেটাল ডিটেক্টরের বদলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে৷
কিন্তু কখন এই মেটাল ডিটেক্টর সরছে এবং এর বদলে কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রকাশ যে, মুখ চিনতে পারে এমন ক্যামেরা ব্যবহার করা হতে পারে, মুসলিম ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই পবিত্র বলে পরিচিত এই হারাম আল-শরিফ বা টেম্পল মাউন্টে প্রবেশের সময়৷
আপাতত মনে করা হচ্ছে, যদি মেটাল ডিটেক্টর উঠিয়ে নেয়া হয়, তাহলে উত্তেজনা প্রশমিত হবে৷ তবে স্পষ্টতই এ নিয়ে দ্বিমুখী চাপে পড়েছে ইসরায়েলের প্রশাসন৷
একদিকে, প্যালেস্টাইনবাসী এই ডিটেক্টরের মধ্য দিয়ে পবিত্র স্থানে যেতে নারাজ৷ অন্যদিকে, দেশটির ভেতরে সরকারের এই ‘নতজানু' অবস্থানের সমালোচনা চলছে৷ ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎস-এ আলোচিত সাংবাদিক জুডি মল্জ লিখেছেন যে, মেটাল ডিটেক্টর সরিয়ে নেয়া মানে শুধু প্যালেস্টাইনের চাপের কাছেই নতি স্বীকার করা নয়, বরং সন্ত্রাসের কাছে নতজানু হওয়া৷
বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উস্কানির অভিযোগ উঠেছে৷ প্যালেস্টাইনের পত্রিকা আল-কুদসের মতে, ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল গঠিত হয়, তখন থেকেই আল-আকসা মসজিদকে ‘ইহুদীকরণ'-এর চক্রান্ত চলছিল৷ এতদিন পর তারা সেই প্রক্রিয়াই শুরু করেছে৷ অন্যদিকে, ইসরায়েলের এক সাংবাদিক টেম্পল মাউন্টে ইসরায়েলি পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেশটির এক মুসলিম নেতার যোগ আছে বলে অভিযোগ করেছেন৷
Israel is to remove metal detectors from the Temple Mount
00:44
তবে এ বিষয়টিকে অনেকেই পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক' বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রী গিলাড এরডান রেডিওতে বলেছেন যে, এর সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগ নেই৷ টেম্পল মাউন্টে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ঠেকাতে এই মেটাল ডিটেক্টর বসানোর বিকল্প ছিল না বলে মনে করেন তিনি৷
অন্যদিকে, প্যালেস্টাইনের রামাল্লা থেকে প্রকাশিত হওয়া পত্রিকা আল-আইয়ামও মনে করছে যে, এই সংকট একেবারেই ধর্মীয় নয়৷ বরং ইসরায়েল ঘটনাটিকে ‘ধর্মীয় রং' দিয়ে সারা বিশ্বকে দেখাচ্ছে৷ এই সংকটের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণটিকে পাশ কাটিয়ে গেলে তা প্যালেস্টাইনদের সার্বভোমত্ব, স্বাধীনতা ও নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের অধিকারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় বলে মনে করে পত্রিকাটি৷
এদিকে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে৷ আরব লিগের চেয়ারম্যান আহমেদ আবদুল ঘাইত ইসরায়েল ‘আগুন' নিয়ে খেলছে বলে অভিযোগ করেছেন৷ তুর্কি প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান মেটাল ডিটেক্টর বসিয়ে ইসরায়েল মুসলিম বিশ্বকে অপমান করেছে বলে মন্তব্য করেছেন৷
প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের কিছু ছবি
১৯৬৭ সালের ছ’দিনের যুদ্ধে জয়ের পর, তথাকথিত ‘উইপিং ওয়াল’ বা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের কাছে জড়ো হয়েছিল ইসরায়েলি সেনারা৷ ঘটনাটি ক্যামেরাবন্দি করেন ফটো সাংবাদিক ডেভিড রুবিংগার৷ দেখুন সদ্য প্রয়াত সেই ফটোগ্রাফারের কিছু বিখ্যাত ছবি৷
ছবি: Getty Images/Newsmakers/GPO/David Rubinger
১৯৬৭ সাল: গাজা স্ট্রিপ
১৯২৪ সালে ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন ডেভিড রুবিংগার৷ কিন্তু নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচতে প্যালেস্টাইনে পালিয়ে গিয়েছিলেন৷ নিজে বাঁচলেও, মা মারা যান হলোকস্টে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলন, সে সময়ই তাঁর মধ্যে ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়, পরবর্তীতে ফটোসাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ছ’দিনের সেই যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনারা কীভাবে মিশরের সেনা ও ফিলিস্তিনিদের আটক করছে৷
ছবি: Getty Images/GPO/David Rubinger
ওয়েস্টার্ন ওয়ালে একত্রিত প্যারাট্রুপাররা
ডেভিড রুবিংগারের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ এটি৷ এখানে ইসরায়েলি সেনাদের জেরুজালেমের তথাকথিত ‘উইপিং ওয়াল’ বা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের ওপর দেখা যাচ্ছে৷ ১৯৬৭ সালের ছ’দিনের যুদ্ধে প্রথমবারের মতো পশ্চিম তীর এবং গাজা স্ট্রিপ দখল করতে সক্ষম হয় ইসরায়েল৷ রুবিংগার এই ছবিটি তোলেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে৷ ইসরায়েলি সরকার খুব কম দামে সকলের কাছে এই ছবিটি বিক্রি করে৷ ফলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় ছবিটি৷
ছবি: Getty Images/Newsmakers/GPO/David Rubinger
যুদ্ধের সময় আরিয়েল শারন
এই ছবিটি সাবেক ইসরায়েলি সেনা প্রধান আরিয়েল শারনকে (মাঝে) দেখা যাচ্ছে অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে, ১৯৬৭ সালের ১ জুন ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমিতে৷ ছ’দিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন চারেক আগে তোলা এই ছবিটি৷ শারন পরবর্তীতে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন৷ ২০১৪ সালে মারা যান তিনি৷
ছবি: Getty Images/GPO/Newsmakers/David Rubinger
দ্বন্দ্ব সংঘাতের ইতিহাসের প্রামাণ্যচিত্র
এ ছবিতে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তের দিকে চলেছে ইসরায়েলি সেনারা৷ ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে সিরিয়া যখন গোলান উপত্যকায় হামলা চালায়৷ রুবিংগার সেসময় জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ১০টি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে গিয়ে ছবি তোলেন৷ ২০০৭ সালে নিজের বইটিতে তিনি লেখেন, ‘‘এই ছবিগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, আমি সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম৷ তাই বেঁচে ফিরতে পেরেছি৷’’ তাঁর বইটির নাম ‘ইসরায়েল থ্রু মাই লেন্স: একজন ফটোসাংবাদিক হিসেবে ৬০ বছর’৷
ছবি: Getty Images/AFP/GPO/David Rubinger
১৯৭৩ সালে ইয়ুম কিপুর যুদ্ধ
১৯৭৩ সালে ইয়ুম কিপুর যুদ্ধে সিরিয়ার সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ইসরায়েল৷ এ যুদ্ধ অক্টোবর যুদ্ধ নামেও পরিচিত৷ রুবিংগারের এই ছবিতে গোলান উপত্যকায় ইসরায়েলি ট্যাংকের বহর আর সিরীয় সেনাদের দেখা যাচ্ছে৷ ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথমবারের মতো পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতিও ফুটে উঠেছে ছবিতে৷ আশির দশকেও এ অঞ্চলে উচ্ছ্বসিত ইসরায়েলি সেনা আর বিষাদগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের ছবি তুলেছিলেন রুবিংগার৷
ছবি: Getty Images/AFP/GPO/David Rubinger
জাতি নিমার্ণের আলোকচিত্রী
ডেভিড রুবিংগার তাঁর জীবনের দীর্ঘ ৫০ বছর ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন৷ ইসরায়েলের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেস ডেভিডকে রুবিংগারকে ‘একটি জাতি তৈরির আলোকচিত্রী’ হিসেবে গণ্য করেছিলেন৷