জলবায়ু পরিবর্তন এখনো অনেকের জন্য তাত্ত্বিক বিতর্কের বিষয় হলেও কিছু মানুষের অস্তিত্ব বিষয়টির উপর নির্ভর করছে৷ মরক্কোর একটি অঞ্চলের মানুষ দ্রুত এই সংকটের কুপ্রভাব টের পাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
হালিম সাবাই মরক্কোর দক্ষিণেই বড় হয়েছেন৷ তিনি মরুভূমির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখাতে চান৷ তাঁর কাছে যাবার পথে মরুদ্যান পড়ে বটে, তবে তার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই৷
এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে তিনি এক মৃত খেজুর গাছ কেটে আসবাব তৈরির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে চান৷ কারণ, গাছে বহুদিন ধরে খেজুর হচ্ছে না৷ এগিয়ে আসা বালুর থাবায় গাছপালা আর টিকে থাকতে পারছে না৷ হালিম বলেন, ‘‘আমরা যেন এই খেজুর গাছকে শেষবারের মতো সম্মান জানাচ্ছি৷ এটা আসলে এক গোরস্তান৷ গাছের অবশিষ্টই শুধু রয়ে গেছে৷’’
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব
এই মরুদ্যান মরুভূমির বালুতে ডুবে যাচ্ছে৷ কয়েক বছর ধরে উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে, বৃষ্টিপাত কমে চলেছে৷ বালুর ঝড়ও আরও ঘনঘন দেখা যাচ্ছে৷ হালিমের বাবা সেখানে গাছ পুঁতে খেজুর বেচে ভালই রোজগার করতেন৷ হালিম বলেন, ‘‘এখানে কেন এই গোরস্তান রয়েছে? উত্তরটা খুব সহজ৷ পানির অভাব৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এই অভাব দেখা যাচ্ছে এবং মরুভূমি বেড়ে চলেছে৷’’
মরক্কোয় চাষিদের জন্য জলবায়ু বিমা!
05:24
সাহারা মরুভূমির প্রান্তে মহামিদ এল গিজলান গ্রামে মরুদ্যানের সামান্য অংশ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে৷ সামান্য কিছু টুকরো জমিতে এখনো চাষবাস করা সম্ভব৷ চাষি হিসেবে লাহবিব বাহাদির ছোট সবজির খেত রয়েছে৷ ৬১ বছর বয়সি লাহবিবের ১১ জন সন্তান রয়েছে৷ তাদের মধ্যে বেশিরভাগই অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছে৷ তিনি জানেন না, খেতে আর কতকাল ফলন হবে৷ নিজস্ব কুয়ো থাকলেও পানির জন্য তাঁকে আরও গভীরে মাটি খুঁড়তে হচ্ছে৷ লাহবিব মনে করেন, তরুণ প্রজন্মকে অন্য কোথাও কাজ খুঁজতে হবে৷ শুধু বয়স্কদের প্রজন্মই এখানে টিকে রয়েছে৷
বালুর পাহাড় সবজির খেতের কাছেই এগিয়ে এসেছে৷ হাতে গোনা কয়েকটি খেজুর গাছ এখনো মরুদ্যানের কথা মনে করিয়ে দেয়৷ গ্রামে বর্তমানে মাত্র প্রায় সাত হাজার মানুষ বসবাস করছেন৷ বেশিরভাগ মানুষই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন৷
জলবায়ু পরিবর্তন: পালটে যাচ্ছে নদীও
কেবল খাবার পানি নয়, অন্য নানা কাজেই নদীর ওপর নির্ভর করতে হয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে৷ কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ এই জল সরবরাহ প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছে৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Nesdis
পানির অপর নাম...
বিশ্বের মোট জলের বেশিরভাগই রয়েছে সমুদ্রে৷ মোট জলের কেবল ১০০ ভাগের এক ভাগ নদী দিয়ে বয়ে যায়৷ কিন্তু এই নদীগুলো ছাড়া ভূপৃষ্ঠে মিষ্টি পানি অন্যসব উৎস, যেমন হ্রদ ও জলাভূমি শুকিয়ে যাবে৷ এরই মধ্যে এমন আলামত দেখা যেতে শুরু করেছে৷ কেবল মানবজাতি নয়, প্রাণিজগত ও উদ্ভিদজগতেও পড়ছে এর প্রভাব৷
ছবি: picture-alliance/APA/B. Gindl
দশকের পর দশক
ওপরে আফ্রিকার শাড হ্রদের ১৯৬৩, ১৯৭৩, ১৯৮৭ এবং ১৯৯৭ সালের ছবি দেখানো হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৬০ বছরে হ্রদটির আকার ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও নীচে নেমে এসেছে৷ দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য বাঁধ ও সেচব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়েছে৷ কিন্তু গবেষকরা জানতে পেরেছেন, এই অঞ্চলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নদী কোমাদুগুর জলও ধীরে ধীরে তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে কমে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
জীববৈচিত্র্য এবং খাদ্য সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ কিভাবে বাধ্য হচ্ছে খাদ্য ও জলের নতুন উৎস খুঁজে নিতে, শাড হ্রদ তার অন্যতম উদাহরণ৷ কৃষক এবং পশু খামারের মালিকেরা জলের জন্য ধীরে ধীরে উর্বর জমির সন্ধানে যাচ্ছেন৷ কিন্তু উর্বর জমি কমে যাওয়ায় অঞ্চলটিতে জমি নিয়ে উত্তেজনাও দেখা দিয়েছে৷ অন্য বিভিন্ন মহাদেশেও অত্যধিক গরমে নদীর জল শুকিয়ে যাওয়া এবং মাছ মরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/R. F. Bukaty
ইউরোপেও তাপদাহ
২০১৮ সালের গ্রীষ্মে তাপদাহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, খরস্রোতা রাইন নদীর জল শুকিয়ে খালের আকার ধারণ করে৷ তাপমাত্রা একসময় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়িয়ে যায়৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মালামাল পরিবহনে রাইন নদীর ওপর নির্ভর করে৷ কিন্তু এক পর্যায়ে প্রশস্ত এ নদী এতটাই অগভীর হয়ে পড়ে যে, কেবল একটি লেন চলাচলের জন্য চালু রাখা সম্ভব হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
গলে যাচ্ছে হিমবাহ
পানীয় জলের নির্ভরযোগ্য উৎসগুলোও হুমকির মুখে৷ বিভিন্ন পর্বতমালায় জমে থাকা হিমবাহকে জলের আধার মনে করা হয়৷ শীতকালে প্রচুর জল বরফ আকারে জমিয়ে রাখে হিমবাহগুলো৷ গ্রীষ্মকালে সে বরফ গলেই বিভিন্ন নদীতে জল যায়৷ হিমবাহগুলো অন্তত ২০০ কোটি মানুষের জল সরবরাহ করে৷ কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন হিমবাহে বরফ কমতে শুরু করেছে৷ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ শতাব্দীর শেষের দিকে হিমালয়ের তিন ভাগের এক ভাগ বরফ একেবারে গলে যাবে৷
ছবি: DW/Catherine Davison
হিমালয় ও দক্ষিণ এশিয়া
সিন্ধু অববাহিকার কৃষকেরা বিভিন্ন শস্য চাষের জন্য হিমালয়ের বরফ গলা পানির ওপর নির্ভর করেন৷ পুরো অঞ্চলটি সুপেয় জল ছাড়াও সেচ, মাছ ও পরিবহনের জন্য অনেকাংশেই নির্ভর করে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ওপর৷ এই তিন অববাহিকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ১৩ কোটি কৃষক ও ৯০ কোটি বাসিন্দার জলের জোগান দেয়৷
ছবি: Imago/Aurora
দাবানল
ছবিতে দেখানো অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের মতো সম্প্রতি অনেক ভয়াবহ দাবানল দেখেছে বিশ্ব৷ জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক দিক এটি৷ দাবানল নদীও ক্ষতি করছে৷ অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে গাছ পুড়ে ছাই পড়ছে মারে-ডার্লিং অববাহিকার নদীতে৷ এর ফলে নদীর জল দূষিত হচ্ছে৷ এতে কেবল নদীর জলের ওপর নির্ভরশীল ২৬ লাখ মানুষ নয়, অনেক প্রজাতির প্রাণীও পড়েছে হুমকির মুখে৷
ছবি: Reuters/Maxar Technologies
শ্যাওলা এবং ডেড জোন
কেবল দাবানলের ছাইই যে নদীর ক্ষতি করে, এমনও না৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতিবৃষ্টির ফলে নানা কারখানার বর্জ্য আরো দ্রুত নদী হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে৷ এর ফলে নিউ ইয়র্ক উপকূলের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে শ্যাওলা জন্মে সেখানকার জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলছে৷ কোনো কোনো স্থানে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডেড জোনের সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/NASA
বৃষ্টি বেশি মানেই সুখবর নয়
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মিসিসিপি নদীতে নাইট্রোজেন দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ অতিবৃষ্টির ফলে আরো বেশি বর্জ্য ও নাইট্রোজেন জমা হচ্ছে নদীর জলে৷ একই সঙ্গে বন্যা ও সংখ্যায় ক্রমশ বাড়তে থাকা হারিকেনও ফেলছে প্রভাব৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Nesdis
9 ছবি1 | 9
আফ্রিকার উত্তরের ভয়াবহ পরিস্থিতি
হালিম সাবাই-এর একটা ছোট ক্যাফে রয়েছে৷ তিনি পর্যটকদের গাইড হিসেবেও কাজ করেন৷ নিজের জন্মস্থানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তাঁকে উদ্বেলিত করে৷ রসায়নবিদ মেরইয়েম তানার্তে কাসাব্লাংকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন৷ পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে বাকি বিশ্বের তুলনায় আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে৷ মেরইয়েম মনে করেন, ‘‘বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে মরুভূমির জলবায়ু আরও উত্তপ্ত হয়ে পড়বে৷ সবকিছু ভালো থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি বাড়বে৷’’
বিগত একশো বছরে মরোক্কোর মরুদ্যানের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ লোপ পেয়েছে৷ হালিম ও অন্য চাষিরা মরুভূমির সম্প্রসারণ মোকাবিলা করতে ঝোপঝাড় ও গাছপালা লাগাচ্ছেন৷ নেদারল্যান্ডসে তৈরি ‘ওয়াটারবক্স’ নামের এক জৈব প্লাস্টিকের টব সেই কাজে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ তার মধ্যে চারা বসিয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়৷ তারপর ওয়াটারবক্সে অনেক পানি ঢালতে হয়৷
মরুভূমির মোকাবিলায় মরিয়া প্রচেষ্টা
কয়েক মাসের জন্য নিজস্ব প্রাকৃতিক পানির ট্যাংকের কল্যাণে গাছের টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়৷ গাছপালা ও ঝোপঝাড়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সাহারার শেষ উর্বর খেতগুলি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে৷ হালিম সাবাইয়ের মতে, ‘‘এটা বিশ্বের জন্য অশনিসংকেত৷ কিছুকাল পর এখানে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না৷ মরুভূমি দ্রুত আমাদের মরুদ্যান গ্রাস করে নেবে৷’’
গ্রামের কাছেই মরোক্কোর সবচেয়ে বড় মরুভূমি এর্গ চেগেগা অবস্থিত৷ পর্যটকদের কাছে জায়গাটি বেশ জনপ্রিয়৷ বিশাল বালিয়াড়িগুলি সতর্কবাণী বয়ে আনছে৷ কারণ সেগুলি বলগাহীনভাবে বেড়ে চলেছে৷ মরুভূমি হালিম ও অন্যান্যদের ভিটেমাটি গ্রাস করে নিচ্ছে৷