কেরালার শবরীমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখনই আবার শিরোনামে উঠে এসেছে রেহানা ফাতেমা'র নাম৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের সরকারি জনসংযোগ বিভাগ, বিএসএনএল-এর টেকনিশিয়ান পদে কর্মরত রেহানা ফাতেমা দেখতে শুনতে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই৷ কিন্তু এরণাকুলাম নিবাসী ৩১ বছর বয়সি এই নারীর পরিচয় এখন আ শুধু ওইটুকুতে সীমাবদ্ধ নেই৷
বর্তমানে ভারতে খবরের শীর্ষে কেরালার শবরীমালা মন্দির৷ সুপ্রিম কোর্টের রায় অবশেষে ইতি টেনেছে কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা এই মন্দিরে নারীদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞায়৷ কিন্তু তাতেও ফল হয়নি কিছুই৷ আদালতের রায়ের পরও কোনো নারীকে এই মন্দিরে ঢুকতে দেননি পুরোহিতসহ অন্যান্য মন্দিরের কর্মকর্তারা৷
ইতিমধ্যে, মুসলমান হয়েও হিন্দুদের মন্দিরে ঢোকার চেষ্টা করার ‘অপরাধে' ভাঙচুর করা হয়েছে ফাতেমার ঘর-বাড়ি৷ কেরালা মুসলিম জামায়াত কাউন্সিলের পক্ষ থেকেও রেহানাকে একই অভিযোগে বহিষ্কার করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে৷
অনেকের মতে, রেহানা ফাতেমা একজন প্রচারমুখী মানুষ৷ তবে তাঁর সাহসের প্রশংসা না করে পারা যায় না৷ বিভিন্ন ইস্যুতে যেভাবে তিনি প্রতিবাদী হচ্ছেন, সাধারণ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করছেন, তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য৷
প্রতিবাদ করতে গিয়ে গোঁড়া হিন্দু এবং গোঁড়া মুসলমান দু' পক্ষেরই রোষের মুখে পড়েছেন তিনি৷
জীবন, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠানে শুভ-অশুভ শক্তি
‘গুড অ্যান্ড ইভিল পাওয়ার’, শুভ এবং অশুভ শক্তি – তা সে আপনি মানুন আর না মানুন – একে অগ্রাহ্য করার কিন্তু উপায় নেই৷ বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান, এমনকি ইসলাম ধর্মেও আমরা অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির জয়ের কথা পাই৷
ছবি: Reuters/S. Pring
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে
শুভ শক্তি থাকুক আর না থাকুক, শুভ বোধ, আদর্শ মানবজীবনকে অবশ্যই সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়৷ আর তাই, এর বিপরীতের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টির সেই আদি কাল থেকে৷ ভূত-প্রেত, আত্মা বা জিন নিয়ে তাই রয়েছে অসংখ্য গল্প, কল্প-কাহিনি আর তার সঙ্গে সঙ্গে অজস্র আচার-অনুষ্ঠান, অন্ধ বিশ্বাস৷
ছবি: Reuters/S. Pring
আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গা
অসুরের অত্যাচার, পাপীদের অনাচার আর অশুভ শক্তির উত্থানে মানবতা যখন ভূলুণ্ঠিত, নিষ্পেষিত, তখন সমস্ত দেবতারা, অর্থাৎ সমস্ত শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা, সব নিপীড়িত-নির্যাতিতরা সংঘবদ্ধ হন৷ তাঁদের আকুল আবেদনেই আবির্ভূতা হন আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গা৷ হিন্দুধর্ম অনুসারে, মহিষাসুর বধের মাধ্যমে শুভ শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...
বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী, চিন্তা জগতে অশুভ ভাবনার নাম হলো ‘মার’৷ অবশ্য শব্দটি রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা এবং মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যেও চোখে পড়ে৷ মহাযান বৌদ্ধধর্ম বলে, অশুভ শক্তি ধ্বংস হলে পৃথিবী স্বর্গীয় হয়৷ বুদ্ধদেবের কথায়, ‘‘কাম, ক্ষুধা, পিপাসা থেকে বিরত থাকে ‘মার’-কে দূরে রাখতে পারলে প্রত্যেক জীব ‘বুদ্ধ’ হয়ে উঠতে হতে পারে৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/E. Jones
রূপকথা আর ইতিহাসের পাতায়
এশিয়া বা আফ্রিকার মতো ইউরোপেও অশুভ ও শুভ শক্তি নিয়ে নানা লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে৷ একটা সময় ইউরোপে ‘ডাইনি’-দের পুড়িয়ে মারার চল ছিল৷ আবার রূপকথাগুলিতেও ছিল আশ্চর্য সব জাদুর গন্ধ৷ গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়ের ‘স্নো হোয়াইট’ বা ‘স্লিপিং বিউটি’-তেও আমরা ডাইনি, এঞ্জেল এবং শুভ-অশুভ শক্তির সংঘাতের নজির পাই৷
ছবি: picture-alliance / akg-images
জিন-পরীর অস্তিত্ব
বৌদ্ধ, হিন্দু আর খ্রিষ্টধর্মের পাশাপাশি ইসলামেও রয়েছে জিন-পরীর উল্লেখ, আছে ‘ইবলিশ’ বা শয়তানের কথা৷ এই ‘ইবলিশ’, ‘সিলা’ বা ‘ইফরিত’-রা নাকি সব দুষ্টপ্রকৃতির জিন বা আত্মা, যারা কবরস্থানে থাকে আর যে কোনো আকার ধারণ করতে পারে৷ অবশ্য শুধু অশুভ জিন নয়, আলাদিনের মতো শুভ জিন বা ফেরেশতার কথাও রয়েছে ‘সহস্র এক আরব্য রজনি’ -তে৷
ছবি: Fotolia/ThorstenSchmitt
‘প্রিং কা-এক’ উৎসব
আধুনিক সমাজেও কিন্তু এমন হাজারো আচার-অনুষ্ঠান চোখে পড়ে৷ কম্বোডিয়ার মানুষদের যেমন আজও বিশ্বাস, অশুভ শক্তি অসুখ-বিসুখ নিয়ে আসে, মানুষের ক্ষতি করে৷ তাই ‘প্রিং কা-এক’ উৎসবে সারা গায়ে কালি মেখে, অশুভ আত্মাকে দূর করার কাজে নেমে পড়ে সহজ-সরল গ্রামবাসী৷ উৎসবের শেষ হয় ভূরিভোজ দিয়ে৷
ছবি: Reuters/S. Pring
6 ছবি1 | 6
এ বছরের মার্চ মাসে কেরালার আরেকটি ঘটনায় খবরে এসেছিল ফাতেমার নাম৷ এক অধ্যাপক নারীদের স্তনের সাথে তরমুজের তুলনা করলে এর প্রতিবাদে রেহানা তরমুজ দিয়ে খোলা বুক আড়াল করে ছবি তুলেছিলেন৷ সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিলে বিস্তর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন৷ এমন অভিজ্ঞতা অবশ্য ফাতেমার জন্য নতুন কিছু নয়৷ ২০১৪ সালের বিতর্কিত ‘কিস অফ লাভ' আন্দোলনের সময় তাঁর সঙ্গী, চিত্রনির্মাতা মনোজ শ্রীধরের সাথে একটি চুম্বনের ভিডিও শেয়ার করেও তীব্র আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ছিলেন তিনি৷
শবরীমালার ঘটনায় রেহানার কাজে তাঁর সহকর্মীরা নাকি অস্বস্তিতে পড়েছেন৷ এ কারণে তাঁকে নাকি বদলি করা হতে পারে৷
এত কিছু পরেও কিন্তু রেহানা বিন্দুমাত্র বিচলিত নন৷ গোঁড়া মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই দুই সন্তানের মা জানিয়েছেন, বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তিনি ধর্মের ওপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করেন৷
নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রেহানা স্বপ্ন দেখেন বিভিন্ন সামাজিক বেড়া ভেঙে একদিন নারীরা নিজেদের শরীর ও চেতনার ওপর পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে৷