রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে কয়েকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা৷
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘পরিস্থিতির ভয়াবহতা' অনুভব করার আহ্বান জানান৷
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন রোহিঙ্গারা; এই সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে পৌঁছে যায় সাত লাখে৷ আর আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা৷
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি দারুণভাবে সামাল দিলেও তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরাতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সাফল্য আসেনি একেবারেই৷ এরইমধ্যে কক্সবাজারে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ অনেক বাংলাদেশিই মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের আর কখনই মিয়ানমারে ফেরানো সম্বব হবে না৷
শেখ হাসিনার চার প্রস্তাব
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চারটি প্রস্তাব নিম্নরূপ:
২) মিয়ানমারকে বৈষম্যমূলক আইনের বিলোপ ঘটাতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন অঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শনের অনুমতি দিতে হবে৷
৩) রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক বেসামরিক পরিদর্শক মোতায়েন করতে হবে৷
৪) রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ দূর করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য অপরাধের সুষ্ঠু বিচার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিশ্চিত করতে হবে৷
সৌদি আরব যেতে চান বেশিরভাগ রোহিঙ্গা
কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ১২৭৭ জনের উপর একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে৷ জরিপটি চলেছে চলতি বছরের মার্চ থেকে এপ্রিলব্যাপী তিন সপ্তাহ৷ এক্সচেঞ্জ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করেছে৷
ছবি: Jibon Ahmed
বাসস্থান
জরিপে অংশ নেয়া রোহিঙ্গাদের ১০ জনের ৪ জন ক্যাম্পে তাদের থাকার জায়গা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন৷ দশ জনের ৬ জন অসন্তোষ বা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ তবে ৯৩ ভাগই মনে করেন, ক্যাম্পের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর৷ ৯৭ ভাগই স্বাস্থ্যসেবার পর্যাপ্ত সুবিধা আছে বলে জানিয়েছেন৷ কিন্তু ৪৭ ভাগই ক্যাম্পে বাড়ির মতো অনুভব করেন না৷
ছবি: Jibon Ahmed
শিক্ষার সুযোগ
৯৯ ভাগ রোহিঙ্গাই মনে করেন ১২ বছরের নীচের শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ রয়েছে৷ কিন্তু কিশোর বা বয়স্কদের উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা৷ মসজিদ, মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছেন ৯৯ ভাগ৷ ৯৯ দশমিক ৮ ভাগ জানিয়েছেন, তাঁরা স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের সুযোগ পাচ্ছেন৷
ছবি: Jibon Ahmed
যৌননিপীড়ন
চার জনের একজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, ক্যাম্পে যৌননিপীড়নের ঘটনা ঘটে৷ এর মধ্যে ৭৯ দশমিক ৮ ভাগ বলেছেন, তাঁরা রাস্তাঘাটে এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হন৷ ১৯ দশমিক সাত ভাগ জানিয়েছেন, সেখানকার হাট-বাজারগুলোতে বেশি যৌননিপীড়নের ঘটনা ঘটে৷
ছবি: Jibon Ahmed
ভাষানচরে না
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৯৮ দশমিক ৭ ভাগই ভাষানচরে স্থানান্তরের সরকারি পরিকল্পনার বিষয়ে অবগত৷ কিন্তু মাত্র ১ দশমিক ৬ ভাগ সেখানে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখছেন৷ ৯৮ দশমিক ৪ ভাগ সেখানকার পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং নিজেদের বাসভূমি মিয়ানমার থেকে দূরে যেতে হবে বলে কক্সবাজার ছাড়তে রাজি নন৷
মিয়ানমার নিয়ে আশা
আগামী দুই বছরের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ৬৯ ভাগই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন৷ ৯৩ ভাগ আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাই এখনো সেখানে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন৷ তবে ৭৩ ভাগই মনে করেন সেটি অন্তত দুই বছরের মধ্যে সম্ভব নয়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
অন্য দেশে
মিয়ানমার ছাড়া অন্য বিকল্প কোন দেশে যাওয়ার সুযোগ হলে কোথায় যাবেন, এমন প্রশ্ন ছিল তাঁদের কাছে৷ সেখানে প্রতি তিনজনে একজন বা ৩৩ ভাগই বলেছেন তাঁদের প্রথম পছন্দ সৌদি আরব৷ ক্যানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ইচ্ছুক ২১ ভাগ৷ অস্ট্রেলিয়া যেতে চান ১৬ ভাগ৷ ১২ ভাগ বাংলাদেশ আর মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোনো বিকল্পের কথা বিবেচনায় নিতেই আগ্রহী নন৷
ছবি: Jibon Ahmed
6 ছবি1 | 6
শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঘটনার গুরুত্ব বোঝার আহ্বান জানাবো৷ ক্যাম্প ছাড়িয়ে এ সংকট বাইরেও বিস্তৃত হচ্ছে৷ আমাদের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটা একটা আঞ্চলিক হুমকিতে পরিণত হয়েছে৷''
একমত রোহিঙ্গারাও
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাস করা রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্টরা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন৷ জার্মানিতে বসবাসরত নেই সান লুইন মনে করেন, শেখ হাসিনার প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মনের কথারই প্রতিফলন ঘটেছে৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বিচার, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং পূর্ণ নাগরিকত্ব সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন৷ শেখ হাসিনা এর সবকটিই তার প্রস্তাবে অন্তর্ভূক্ত করেছেন৷''
তবে, ২০১৭ সালের আগস্টে সবশেষ সংকট শুরুর পর থেকে শেখ হাসিনা এ নিয়ে তৃতীয়বার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রস্তাব দিলেন, এটিও মনে করিয়ে দেন নেই সান লুইন৷ তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বনেতারা সবসময়ই তার প্রস্তাব শোনেন, কিন্তু কখনই মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে তাকে সাহায্য করেন না৷''
যুক্তরাজ্যের বার্মিজ রোহিঙ্গা অরগানাইজেশনের সভাপতি তুন খিনও একই রকম মনে করেন৷ তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করছে না৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রায় ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা গত কয়েক বছরে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছে৷ কিন্তু এখনও রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাস করছেন৷ তারা ‘গণহত্যার' হুমকিতে রয়েছেন৷ মায়ানমারকে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন করতে হবে৷
ভাসান চর কি রোহিঙ্গাদের জন্য স্বর্গ?
প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ৷ তবে দ্বীপটি ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হওয়ায় তা রোহিঙ্গাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: DW/A. Islam
মূল ভূখন্ড থেকে দূরে
বিশ বছরেরও কম সময় আগে ভাসান চর জেগে উঠেছিল৷ বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে এটি ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷ সেখানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে যেতে চাইছে বাংলাদেশ৷
ছবি: DW/A. Islam
যাওয়া সহজ নয়
ভাসান চরে যেতে সাধারণ মানুষের উপযোগী কোনো বাহন নেই৷ ঐ দ্বীপের কয়েকজন দোকানি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বর্ষার সময় সাগর উত্তাল থাকায় সাধারণ মাছ ধরার নৌকায় করে ভাসান চরে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়৷
ছবি: DW/A. Islam
তিন মিটার উঁচু বাঁধ
উঁচু ঢেউ ও বন্যার হাত থেকে ভাসান চরকে বাঁচাতে সরকার ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও তিন মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করেছে৷ এক দোকানি জানালেন, মাসে দু’বার বাঁধের বাইরের দিকে থাকা বাজার এক মিটার পর্যন্ত ডুবে যায়৷
ছবি: DW/A. Islam
একইরকম ভবন
রোহিঙ্গাদের জন্য ১,৪৪০টি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে৷ প্রতিটি ভবনে ১৬টি ঘর রয়েছে৷ ১২x১৪ ফুটের একেকটি ঘরে একটি পরিবারের অন্তত চার জন সদস্যকে থাকতে হবে৷ ঘূর্ণিঝড়ের সময় ব্যবহারের জন্য ১২০টি চারতলা আশ্রয়কেন্দ্রও নির্মাণ করা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
সৌরশক্তি
ভবনগুলোর জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সেগুলোতে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে৷ এছাড়া প্রয়োজনের সময় ব্যবহারের জন্য দুটি ডিজেল জেনারেটর ও বিশাল এক মাঠে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে৷ খাবার পানির জন্য রয়েছে নলকূপ৷ আরও আছে বৃষ্টির পানি থেকে খাবার পানি পাওয়ার ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/A. Islam
ক্ষয় রোধের ব্যবস্থা
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবিতে ২০০২ সালে প্রথম এই দ্বীপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়৷ এরপর কয়েকবার এটি স্থান পরিবর্তন করেছে৷ ভূমিক্ষয় ঠেকাতে সরকার চরটিতে তিন স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে৷
ছবি: DW/A. Islam
দ্বীপটি কি বাসযোগ্য?
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, দ্বীপটি এখনও বসবাসের উপযোগী নয়৷ তবে আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত মনে করছেন, বাঁধের উচ্চতা যদি সাড়ে ছয় থেকে সাত মিটার করা যায় তাহলে দ্বীপটি বসবাসযোগ্য হতে পারে৷ তবে ভাসান চরে ফসল ফলানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW/A. Islam
রোহিঙ্গাদের ভয়
কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গারা ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাঁদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়া হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাঁরা মারা যেতে পারেন৷ তবে প্রকল্পের প্রধান স্থপতি আহমেদ মুক্তা বলেন, ‘‘চরটি রোহিঙ্গাদের জন্য এক স্বর্গ৷’’
ছবি: DW/A. Islam
রোহিঙ্গারা কি ভাসান চরে যাবেন?
কয়েকটি সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে যে, নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে৷ তবে রোহিঙ্গারা সেখানে না গেলে গৃহহীন বাংলাদেশিদের ভবিষ্যতে সেখানে নিয়ে যাওয়া হতে পারে৷