বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে শেখ হাসিনার মন্তব্য উপমহাদেশের রাজনীতির আসল চিত্রটি আরও একবার স্পষ্ট করল৷
বিজ্ঞাপন
যে বন্ধুর কথা লিখছি, ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার পরিবার বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসে৷ বন্ধুর বাবার বড় ব্যবসা ছিল৷ সব কাজ ছেড়ে কার্যত এক কাপড়ে গোটা পরিবার কলকাতা চলে এসেছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে৷
আজও আড্ডার সময় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথা উঠলেই ওর চোখ ছলছল করে৷ মনে পড়ে যায় ফেলে আসা স্মৃতি৷ অনর্গল বলতে থাকে, ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল! পরিচিত মানুষ, পাড়ার বন্ধুদের কথাবার্তা, আচরণ কীভাবে হঠাৎ বদলে গিয়েছিল এক লহমায়৷ তারপর সেই দুঃসহ রাত এবং কলকাতায় পালিয়ে আসা সব ছেড়ে ছুড়ে৷
সম্প্রতি দুর্গাপুজো নিয়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবৃতি শুনে ওই বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল৷ হাসিনা বলেছেন, ‘‘সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয় যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে৷ আর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে৷’’ ১৯৯২ সালে এমনই এক আঘাতের কথা বলে, বলতেই থাকে আমার ওই আপাদমস্তক বাংলাদেশপ্রেমী বন্ধু৷ ভারতের নাগরিক হয়েও তার মন পড়ে থাকে মেয়েবেলার বাংলাদেশে৷
হাসিনা যখন একথা বলছেন, তখন সাংবাদিকের হোয়াটসঅ্যাপে একটি উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের একের পর এক মেসেজ ঢুকছে৷ বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে গর্জে ওঠার আহ্বান নয়, নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে ওই সমস্ত মেসেজে৷ এপার বাংলার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ভরে যাচ্ছে বাংলাদেশের একাধিক ঘটনার সত্য এবং ভূয়া ছবিতে৷ ওই সমস্ত বার্তা ঘিরে যে আলোচনা হচ্ছে, উসকানি এবং ঘৃণার চূড়ান্ত উদাহরণ হতে পারে সে সব৷ কোনো কোনো মন্তব্যে সরাসরি টার্গেট করা হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের৷
এটাই হয়৷ সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয় ঠিক এভাবেই৷ ফলে আপাত চোখে শেখ হাসিনার মন্তব্য যুক্তিপূর্ণ এবং গভীর৷ আগুন কীভাবে ছড়ায় তা তিনি জানেন৷ এবং সে কারণেই প্রতিবেশী দেশকে সতর্ক করেছেন৷ বস্তুত, সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রতিবেশী দেশের দাঙ্গা তার দেশের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল, সেকথাও মনে আছে নিশ্চয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর৷
দিল্লি দাঙ্গার কথা বলছি৷ সহিংসতার আগুনে উত্তর-পূর্ব দিল্লি যখন জ্বলছে, বাংলাদেশে তার বিপুল প্রভাব পড়েছিল৷ মিছিল হয়েছিল৷ কোনো কোনো ধর্মীয় সংগঠন উসকানিমূলক কার্যকলাপেও ব্রতী হয়েছিল৷ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ভরে গিয়েছিল সত্য এবং ভূয়া ছবিতে৷ এর কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর৷ তা ঘিরেও ব্যাপক গন্ডগোল হয়েছিল ঢাকায়৷
অর্থনীতির একটি পরিচিত তত্ত্ব ‘ট্রিকল ডাউন থিওরি’৷ অর্থাৎ চুইয়ে চুইয়ে এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে যা ঢুকে পড়ে৷ সমাজবিজ্ঞানেও এই তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য৷ এক সমাজের ঘটমান বর্তমান চুইয়ে চুইয়ে প্রতিবেশীর সমাজকেও প্রভাবিত করে৷ হাসিনার বক্তব্যে সেই বিষয়টিই প্রতিভাত হয়েছে৷ তাছাড়া ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই জানে দেশভাগের ভয়াবহ ইতিহাস৷ সামান্য আগুন দুই দেশে কী মারাত্মক আকার নিতে পারে, তা কারো অজানা নয়৷
হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা পরিক্রমা
কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়া যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে৷ ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি কোরআনটি সেখানে রেখেছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
কুমিল্লায় শুরু
১৩ অক্টোবর বুধবার দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়া দীঘি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চকবাজার এলাকায় (কাপুড়িয়াপট্টি) শত বছরের পুরনো চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে সকাল ১১টায় প্রথম হামলা হয়৷ এর আগে সকালে পূজা মণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন উদ্ধার করেন কোতোয়ালী থানার ওসি আনোয়ারুল আজিম৷ কোরআন রাখার অভিযোগে ইকবাল হোসেন (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
অন্যান্য জেলায় হামলা
কুমিল্লা ছাড়াও একইদিন চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ভোলা, চট্টগ্রাম, ও কক্সবাজারে হামলা হয়েছে বলে ১৬ অক্টোবর জানায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ৷ এছাড়া ১৪ অক্টোবর বান্দরবান ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হামলার ঘটনা ঘটে৷ আর ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনী ও চট্টগ্রামে হামলা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
তিন দিনে ৭০ মণ্ডপে হামলা
১৬ অক্টোবর শনিবার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানায়, দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিনে ৭০টি পূজা মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ এসবের বাইরে ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানেও ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
ফেনীতে হামলা
মন্দিরে মণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের আহ্বানে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল৷ ফেনীতে সেই কর্মসূচির প্রস্তুতি চলার সময় হামলা হয়৷ এরপর শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়৷ কয়েকটি মন্দির ও হিন্দুদের মালিকানাধীন বেশ কিছু দোকানপাটে ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া যায়৷ বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ফেনীতে থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
রংপুরের পীরগঞ্জে হামলা
১৭ অক্টোবর রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের এক হিন্দু তরুণের ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে রামনাথপুর ইউনিয়নে জেলেপল্লির হিন্দু পরিবারের উপর হামলা হয়৷ হামলাকারীরা ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাটও করে৷
ছবি: bdnews24.com
নয় বছরে ৩,৬৭৯ হামলা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর তিন হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে এক হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা৷ ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা৷ আর প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৬৭৮টি৷ এসব হামলায় আহত হয়েছেন ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ নিহত হয়েছেন ১১ জন৷
ছবি: Tarun Chakraborty Bishnu
প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে৷ শাহবাগের আন্দোলনকারীরা তিন দফা দাবি পূরণ করতে সরকারকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছেন৷ দাবিগুলো হলো, দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে দোষীদের বিচার; ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহত ও নিহতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
হিন্দুদের প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ১৮ অক্টোবর সোমবার হিন্দুদের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance
জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ
কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে ১৫ অক্টোবর শুক্রবার জুমার নামাজের পর ‘মালিবাগ মুসলিম সমাজ’ এর ব্যানারে ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করেন কয়েকশ মানুষ৷ কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ের কাছে পুলিশ বাধা দিলে মিছিলকারীরা দুই ভাগ হয়ে যান৷ তাদের একটি অংশ বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে শুরু করে৷ পুলিশ তখন বিভিন্ন গলির মুখে অবস্থান নেয় এবং টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোঁড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিক্ষোভ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ব্যানারে প্রায় দশ হাজার মুসলিম ১৬ অক্টোবর শনিবার বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ করেন৷ ইসলাম অবমাননার অভিযোগে তারা এই বিক্ষোভ করেন৷
ছবি: Abdul Goni/AP Photo/picture alliance
মাশরাফির প্রতিক্রিয়া
সোমবার ফেসবুকে পীরগঞ্জে হামলার ছবি শেয়ার করে মাশরাফি লেখেন, এই ঘটনা তার হৃদয় ভেঙে চুরমার করেছে৷ ‘‘এ লাল সবুজতো আমরা চাইনি৷ কতো কতো স্বপ্ন, কতো কষ্টার্জিত জীবন যুদ্ধ এক নিমিষেই শেষ৷ আল্লাহ আপনি আমাদের হেদায়েত দিন৷’’
ছবি: Facebook
১০২ মামলা, গ্রেপ্তার ৫৮৩
হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ, প্রতিমা ও বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলায় শুক্রবার পর্যন্ত ১০২টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস৷ হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫৮৩ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্যও দিয়েছে তারা৷
ছবি: bdnews24.com
12 ছবি1 | 12
কূটনীতির প্রশ্ন
প্রশ্ন হলো কূটনীতির৷ শেখ হাসিনার এই বক্তব্য কি ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে? দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, তা নিয়ে বলতে গিয়ে হাসিনা যেভাবে সরাসরি ভারতকে টেনে এনেছেন, কোনো কোনো মহলের ধারণা, ভারত তা খুব ভালো চোখে দেখবে না৷ এমন নয় যে ভারতের কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আগুন ছড়িয়েছে৷ পুজোর সময় বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা একান্তই ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷ ফলে হাসিনার মন্তব্য কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক, কিছুটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, কিছুটা মূল ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা বলে মনে হতেই পারে৷ আর তা করতে গিয়ে যেভাবে ভারতকে টেনে এনেছেন তিনি, তা কূটনীতির ভাষায় যথেষ্ট লোডেড৷
ভারত অবশ্য সরকারি ভাবে বাংলাদেশ প্রশাসনের প্রশংসাই করেছে৷ ঘটনার পরপরই ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রশাসন যেভাবে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়৷ কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে দুই দেশের সম্পর্ক বার বার যেভাবে দড়ি টানাটানি খেলার মতো হয়েছে, তাতে হাসিনার মন্তব্যের জের সুদূরপ্রসারী হতেই পারে৷
কূটনীতির বাইরে রাজনীতি
কূটনীতিরও একরকম রাজনীতি থাকে৷ উপমহাদেশের কূটনীতিতে ইদানীং সেই রাজনীতি খানিক বেশিই ব্যবহৃত হচ্ছে৷ পাঠক খেয়াল করবেন, ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির সরকার আসার পরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি একদিকে যেমন ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তেমনই মুসলিম শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান নাম দুইটি৷ পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে গিয়ে অধুনা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ‘ছারপোকা’র মতো৷ আসামে এনআরসি করতে গিয়ে বাঙালি, বাংলাদেশি এবং মুসলিম-- তিনটি পরিচয়কে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এর পিছনে সংকীর্ণ রাজনীতি কাজ করেছে এবং করছে৷ সমাজমাধ্যমে এর সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরার বাঙালির মধ্যে দৃশ্যত লড়াইয়ের আবহ তৈরি হয়েছে৷ রাজনীতি এক তরফা হয় না৷ ফলে শেখ হাসিনার মন্তব্যে কূটনীতির রাজনীতি আছে বলেও মনে করতে পারেন অনেকে৷ বলা যেতেই পারে, এই সুযোগ ব্যবহার করে তিনি ভারতকে প্রত্যুত্তর দিলেন৷
আয়নার সামনে দাঁড়ান
কেউ কেউ বলছেন, সাম্প্রতিক ঘটনা আড়াল করতেই হাসিনা ভারতের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন৷ ভারতীয় হিসেবে মনে পড়ে যাচ্ছে দিল্লি দাঙ্গার স্মৃতি৷ চোখের সামনে এত কিছু ঘটতে দেখেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী নিশ্চুপ ছিলেন৷ কোনো কোনো নেতা দাবি করেছিলেন, ওই দাঙ্গায় বহিঃশত্রুর মদত আছে৷ কৃষক আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, আন্দোলনরত কৃষকরা খালিস্তানি৷ অর্থাৎ, প্রতিবেশীকে টেনে এনে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা৷ সমস্ত রাষ্ট্রনেতাই কোনো না কোনোভাবে এই এসকেপ রুট ব্যবহার করেন৷ অথবা নিশ্চুপ থাকেন৷
এতে সমস্যার সমাধান হয় না৷ অন্যের দিকে একটি আঙুল তুললে নিজের দিকে যে চারটি আঙুল ধেয়ে আসে, নেতারা ভুলে যান৷ কারণ তারা আয়নার সামনে দাঁড়ান না৷ নিজেদেরই আয়না মনে করেন৷ বাবরির ঘটনার পর আমার ওই বন্ধুকে যদি কলকাতায় চলে আসতে না হতো, গুজরাত দাঙ্গার পর কুতুবুদ্দিন আনসারিকে যদি কলকাতায় পালিয়ে আসতে না হতো, কথায় কথায় ভারতের মুসলিমদের পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশে চলে যাওয়ার হুমকি যদি দেওয়া না হতো-- তাহলে এক অন্যরকম সমাজের কথা ভাবা যেত৷ দেশের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব যারা নিয়ে বসে আছেন, এটুকু বোঝার ক্ষমতা তাদের আছে৷ চাইলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছোটছোট ঘটনার ছোট ছোট সমাধানের কথা তারা ভাবলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে না৷ সহজ বাংলায় একেই রাজধর্ম বলে৷
সমাজে নানা কিসিমের লোকের বাস৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অতীতেও উসকানিতে পা দিয়েছে, ভবিষ্যতেও দেবে৷ রাষ্ট্রের অভিভাবকরা চাইলে সেই উসকানি থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে৷ কিন্তু তারাই যদি উসকানির রাস্তা খুলে দেন, তখন যা হওয়ার সেটাই ঘটছে উপমহাদেশে৷
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিবৃত্ত
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন? এক কথায় তার মূল্যায়ন কঠিন৷ বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশটির সম্পর্ক মধুর যেমন বলা চলে, তেমনি আবার কিছু তিক্ততাও আছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
বিপদের বন্ধু
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় ছিল ভারত৷ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের পূর্ণ সমর্থন দেন৷ পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে বাঙ্গালীদের জন্য খুলে দেয়া হয় দেশটির সীমান্ত৷ নভেম্বরে গঠন হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড, যার পথ ধরে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা৷
ছবি: Getty Images/AFP/
মৈত্রী চুক্তি
দুই দেশের শান্তি ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ আঞ্চলিক অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার মোট ১২ টি ধারা ছিল এতে৷ ১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিটি আর নবায়ন হয়নি৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্ধনে সংস্কৃতি
ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য এক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক৷ এক সময় পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ ছিল একই অঞ্চল৷ দুই বাংলার মানুষের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতেও আছে মিল৷ আছে পারস্পরিক যোগাযোগ৷ দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তিও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যোগাযোগে মৈত্রী
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু আছে বহুদিন থেকে৷ কলকাতা-ঢাকা, শিলং-ঢাকা এবং ঢাকা হয়ে আগরতলা-কলকাতা নিয়মিত বাস যাতায়াত করে৷ ৬টি রেল লাইন ছাড়াও দু’টি ব্রডগেজ রেল সংযোগ আছে দুই দেশের মধ্যে৷ কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে 'মৈত্রী এক্সপ্রেস' চলে সপ্তাহে চারদিন৷ ২০১৭ সালে চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’৷ এছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি রেলযোগাযোগ চালুর কাজও চলছে৷
ছবি: DW/P. Mani
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
দুই দেশের বাণিজ্যের আকার ৯১৪ কোটি ডলার৷ ২০১৭-১৮ অথর্বছরে ভারত থেকে ৮৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ আর রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য৷ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশিরভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলেও ভারতের বিরুদ্ধে অশুল্ক বা শুল্কবহির্ভূত বাধা তৈরির অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ
২০১৭ সালে বাংলাদেশে ভারতের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫১ কোটি ডলার৷ টেলিযোগাযোগ, ঔষধ, অটোমোবাইলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা আছে৷ এছাড়া ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় ভারতের সঙ্গে ১০ বিলিয়ন ডলারের ১৩টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. U. Ekpei
বিদ্যুৎ আমদানি
বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ৷ ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)-র অংশীদারিত্বে রামপালে নির্মিত হচ্ছে বিতর্কিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ এছাড়াও ২০১৭ সালের এপ্রিলে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও অর্থায়ন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
জ্বালানি সহযোগিতা
বাংলাদেশে যেসব দেশের প্রতিষ্ঠান পরিশোধিত তেল সরবরাহ করে তার একটি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড৷ সেখান থেকে ডিজেল আমদানির জন্য শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশের সরকার৷ ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে এর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী৷
ছবি: Reuters/E. Gaillard
সমুদ্র বিরোধের নিষ্পত্তি
বঙ্গোপসাগরে ২৫,৬০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধ ছিল৷ তার মধ্যে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়ে ১৯,৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পেয়েছে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/Str
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে আর সেখানকার বাসিন্দারা পায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও লীন হয়ে যায় দেশটির সাথে৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণঘাতী সীমান্ত
দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷ সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার করবে না দুই দেশ, ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে এমন চুক্তি হলেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা৷
ছবি: AP
ফারাক্কা বাঁধ
গঙ্গা নদীতে বাংলাদেশ সীমান্তের ১৮ মাইল উজানে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে ভারত৷ ১৯৬১ সালে শুরু হয়ে কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে৷ শুস্ক মৌসুমে বাঁধের গেট বন্ধ রেখে বাংলাদেশে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি করে ভারত৷ অন্যদিকে বর্ষায় খুলে দেয়া হয় সবগুলো গেট, যার ফলে উত্তরাঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা৷
তিস্তা চুক্তি
১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি৷ ফলে বাংলাদেশ অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে এই বিষয়ে চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
রোহিঙ্গায় পাশে নেই
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে নেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি৷ শুরু থেকেই এ বিষয়ে মিয়ানমারের অবস্থানকেই বরং সমর্থন জানিয়ে আসছে দিল্লি৷ এমনকি সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক ভোটাভুটিতেও বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটি৷
ছবি: Getty Images/P. Bronstein
নতুন জটিলতা এনআরসি
সম্প্রতি হালনাগাদ নাগরিকঞ্জি প্রকাশ করে ভারতের আসাম রাজ্য৷ তাতে রাতারাতি নাগরিকত্ব হারিয়েছেন ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগ মুসলিম৷ বাদ পড়াদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলে আসছে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
ক্রিকেটের উত্তেজনা
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ক্রিকেটের সম্পর্কটাও রাজনীতির মতোই ঐতিহাসিক৷ টাইগাররা ঢাকায় প্রথম টেস্ট খেলেছিল ভারতের বিপক্ষেই, ২০০০ সালে৷ তবে ভারতে টেস্ট খেলার সুযোগের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হয় বাংলাদেশকে৷ দুই দলের মধ্যে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্ট অবশ্য হয়েছে অনেক৷ সেখানে বেশ কিছু টানটান উত্তেজনার ম্যাচও হয়েছে৷ আগামী নভেম্বরে এই প্রথম দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে ভারত সফরে যাবে বাংলাদেশ দল৷