আমার ইদানিং উপলব্ধি হয়,ভীষণ ভাবে উপলব্ধি হয় যা বলা উচিত, যা নিয়ে বলা উচিত,যা সময়ের দাবি তা কি আদৌ আমি বলতে পারি? আমার উপর অদৃশ্য হয়ে ঝুলে আছে নানান কিসিমের খড়্গ। কখনো আইনের নামে, কখনো ধর্মের নামে,কখনো রাজনীতির পেশিশক্তি ও সামাজিক রক্ষণশীলতা ও সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার সুতোর পিছুটান। এতোসব খড়্গ ঘাড়ের উপর ঝুলন্ত রেখে আদৌ কি কোনো শিল্পী মনখুলে কিংবা হাতখুলে কিছু লিখতে পারেন? যা বলার তা বলতে পারেন? পারেন না।
লেখক,শিল্পী সংস্কৃতি কর্মীরা সামাজিক মানুষ। কিন্তু এর বাইরে তাদের যে সংবেদনশীলতা সৃজন প্রতিভাকে আশ্রয় করে সমকালীন অসমতা, অন্যায় অবিচার আর জুলুম-নির্যাতনের বিপরীতে কথা বলে, মূলত ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে করেই তার সমকালকে অতিক্রম করতে হয় কিংবা করে। কিন্তু আমরা কতোটা পারি? মধ্যযুগের রাজকবিদের মতো রাজ বন্দনা না হলেও জুজুর ভয় তাড়িত আমরা লেখক, শিল্পী,সংস্কৃতিকর্মীরা অদৃশ্য শৃঙ্খলে শৃঙ্খলে বন্দী।আমরা সাহিত্য এবং শিল্পের কোনো শাখাতেই ল্যাটিনদের জাদু বাস্তবতার মতো কোনো বিকল্প পথ আবিষ্কার করতে পারছি না,সমকালীন অসমতা আর অনায্যতার শিল্পীতভাবে প্রকাশের জন্য।
সম্প্রতি এক যুবক স্টোরিতে দুই লাইন গান লিখেছিলেন,
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কি হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি করে।'
যুবকের নাম সঞ্জয় রক্ষিত (৪০)। তিনি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার ইউনিয়নের হরি নারায়ণ রক্ষিতের ছেলে। সঞ্জয় পেশায় স্বর্ণকার। অনুভূতিতে আঘাতের কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
বাণীটি লালনের,বহুল শ্রুত ও বহুল চর্চাকৃত। আমরা পূর্ব বাংলার বাঙালিরা যে কয়জন মহাত্মা দার্শনিককে নিয়ে গর্ব করি তার মাঝে লালন অন্যতম। কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ছেঁউরিয়ায় বসে যে গানের বাণী তিনি লিখে গেছেন, তা নেহাৎ গান নয়৷ অভূতপূর্ব মানবিক দর্শন। জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা তাঁকে এসব গানের বাণী লিখিয়ে নিয়েছে। সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে-লিখে তিনি জাতপাতের অসারতা দেখাতে নিজেকেই দাঁড় করিয়েছেন ভেদ বিভেদের মুখোমুখি। তাঁর জীবনী নিয়ে অসংখ্য চলচ্চি,বই পুস্তক বই বাজারে সহজলভ্য।
আমাদের কাছে লালন, গৌরবের। উচ্চতর দার্শনিক মহত্ত্বের শ্লাঘা।
কুষ্টিয়া তখন আলাদা কোনো জেলা নয়। নদীয়ার অন্তর্গত। তারই এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে লালন যে আদর্শে তাঁর বাণী ভক্তকুলের মধ্যে প্রচার করছেন, তখনই ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে তিতুমীরের সংগ্রাম, সিপাহী বিদ্রোহ, ওহাবি-ফারায়জী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ। শুরু হয়েছে হিন্দু মেলা, জাতীয় কংগ্রেস গঠনের মাধ্যমে ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে গণজাগরনের কাজ। রামমোহনের ব্রাম্মধর্ম প্রবর্তন, বিদ্যাসাগরের সংস্কার কার্যক্রমও শুরু হয়ছে এই সময়েই। কোলকাতা কেন্দ্রিকতার বাইরে প্রত্যন্ত গ্রামে বসে বাউল গানের মাধ্যমে মানব ধর্মের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লালন। লালনের সে গান গ্রামের মেঠো পথ ছাড়িয়ে কোলকাতা শহরে তখনো পৌঁছেনি।
লালন যখন আবিষ্কৃত হন, ভদ্র সমাজ হতচকিত হয়ে পড়েন,বিস্মিত হন। শিক্ষা দীক্ষা,আধুনিক চিন্তা ভাবনার সংস্পর্শ হীন একজন গ্রাম্য বাউলের চিন্তা আর দর্শনের গভীরতা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির কেন্দ্র কলকাতার শিক্ষিত সংস্কার বাদী মানুষকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করে।
সময়ে লালন হয়ে উঠেছেন পূর্ববাংলার গর্বের ধন। যাঁকে নিয়ে আমরা বিশ্বের দরবারে উঁচু গলায় বলতে পারি আমাদের একজন লালন আছেন। আড়াইশ বছর আগে এই বাংলায় এমন একজন দার্শনিক জন্মেছিলেন, যিনি সময়ের স্রোতকে উপেক্ষা করেছিলেন সময়ের চেয়ে সহস্র গুন অগ্রসরমান চিন্তা দিয়ে। সময়কে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন জাত-ধর্মের উর্দ্ধে মানবিক সমাযে। এ যে কী ভীষণ গর্বের উত্তরাধিকার, প্রগতিবাদী মানুষ সে বিশ্বের যে প্রান্তেরই হোক,যে জাতেরই হোক,যে ভাষারই হোক সেটা উপলব্ধি করেন। লালনের খোঁজে হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতি ধর্ম গোষ্ঠীর মানুষের আগমন ঘটে এই বাংলায়। এর সবই আমাদের জানা বয়ান।
সেই লালনের দুই লাইন গান ফেইসবুকের স্টোরি অপশনে শেয়ার করে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন সঞ্জয় রক্ষিত। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে কেউ একজন অভিযোগ করেছে এই দুই পংক্তিতে তার ধর্ম সংশ্লিষ্ট "অনুভূতিতে আঘাত" লেগেছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ সঞ্জয় রক্ষিতকে গ্রেফতার করেছে।
কী ভয়ানক ব্যাপার! যে ব্যক্তি অভিযোগ করেছে,এবং যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেফতার করেছে তাদের কেউ জানেনা এই দুটি পংক্তি লেখা হয়েছে আড়াইশ বছর আগে। লিখেছেন বাংলার এক মহান দার্শনিক।
যে অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনেছে সে যেমন জানে এই একটি শব্দবন্ধ উচ্চারণ করলে তার কোনো সাক্ষী প্রমাণ লাগে না। আর যে গ্রেফতার করেছে,সেও তেমন জানে এই একটি শব্দবন্ধ এতোই স্পর্শকাতর যে, কেউ অভিযোগ দিলে, তা নিয়েই তুলকালাম বাধানো যায় খুব সহজে। কাজেই কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সঞ্জয় রক্ষিতকে গ্রেফতার করে দায়িত্ব সেরেছে।
এ এক অদ্ভুত স্বদেশ! এখানে "অনুভূতিতে আঘাত" দিনে দিনে এক ভয়ংকর শব্দ হয়ে উঠেছে। যে শব্দটি দিয়ে হেলাফেলা করেও যে কাউকে বিপদে ফেলা যায় । বিপন্ন করা যায় যে কোন জাতি গোষ্ঠীকে। অস্থিতিশীল করে তোলা যায় সমগ্র দেশকে। অনুভূতিতে আঘাত এখন এক স্পর্শকাতর শব্দের নাম,যাতে আঘাতের কথা বললেই অস্থির হয়ে উঠে সামাজিক পরিবেশ। আইনের শাসনের অভাব সামষ্টিক মানসিক অবনমন শব্দটিকে সবল কর্তৃক দুর্বলকে ঘায়েল করার অস্ত্রে পরিণত করেছে৷
বলা বাহুল্য সেই অনুভূতির আবার সুষম গূঢ়লিপি নেই। স্থান, কাল,পাত্র,ক্ষমতা, মর্যাদা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভেদে প্রতিকার প্রচেষ্টা ভিন্ন হয়। অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে যে স্বদেশ অনুভূতিতে আঘাতের ইস্যু উসকে দিয়ে নির্দ্বিধায় হেনস্থা করা যায় প্রতিপক্ষকে, যে কোন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যায় যে কোন দাপট থাকলে। লালনের বাণী সেখানে উপলক্ষ মাত্র। যে উপলক্ষের সুযোগ গ্রহন করেছে মূর্খরা। সব দেখেশুনে তাই বলতে ইচ্ছে হয়,অনুভূতি তোমার সংজ্ঞা কী? কোন কথায় কার অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে তা বিধিবদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নয়তো নিরীহের প্রতি অবিচার চলতেই থাকবে।
আপাতত যে নিরীহ ছেলেটি সঞ্জয় রক্ষিত মুক্ত হয়েছে এবং খুব উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছি অনেক তথাকথিত সচেতন নাগরিকদের আচরণ৷ অন্য অনেক ব্যপারে তাদের অনেককেই রাজপথে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবল প্রতিবাদী দেখতে পেলেও এক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। আমরা সবাই ফেসবুকে দু লাইন গানের পংক্তি নানা নান্দনিক ভঙ্গীতে উপস্থাপন করে আমাদের বিপ্লবী দায়িত্ব শেষ করেছি।
শিল্পের দায় বোধকরি আরও অনেক বেশি।