পদার্থবিদ্যায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন হিগস-বোসন কণা তত্ত্বের প্রবক্তা ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রঁসোয়া অঁগল্যার৷ ২০১২-তে এঁরাই এই কণার অস্তিত্ব খুঁজে পান৷
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর চেষ্টার পর অবশেষে গত বছর হিগস-বোসন কণার অস্তিত্ব খুঁজে পান এই দুই বিজ্ঞানী৷ এরপর জেনেভায় ‘লার্জ হেডরন কোলাইডার'-এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কণা ভেঙে বিভক্ত করতে সমর্থ হন তাঁরা এবং সেসময়ই এই কণার জন্ম হয়৷ পদার্থবিদ্যায় এই আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত৷
রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স তাদের বিবৃতিতে বলেছে, পুরস্কৃত তত্ত্বটি পার্টিক্যাল সায়েন্সে একটি আদর্শ মডেল উপস্থাপন করেছে, যার মাধ্যমে বোঝা যায় বিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে৷ আদর্শ এই মডেল অনুযায়ী, ফুল থেকে মানুষ পর্যন্ত, নক্ষত্র থেকে গ্রহ পর্যন্ত – সব কিছুই আণবিক পদার্থ দিয়ে তৈরি৷
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, হিগস-বোসন পদার্থবিদ্যার শেষ আদর্শ মডেল, যেখানে বিশ্বের মৌলিক মেক-আপ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে৷ মহাজাগতিক রশ্মি থেকে ‘বিগ ব্যাং' সৃষ্টির কারণে কেউ কেউ একে ঈশ্বরকণা বলেও সম্বোধন করে থাকেন৷
পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার
পদার্থবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৩ সালের নোবেল পাচ্ছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রঁসোয়া অঁগল্যার৷ দেখে নেওয়া যাক নোবেল পাওয়া আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং তাঁদের দারুণ সব উদ্ভাবনের কথা৷
ছবি: Fotolia/miket
ঈশ্বরকণা
ঈশ্বরকণা তত্ত্বের প্রবক্তা ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রঁসোয়া অঁগল্যার এবার পেয়েছেন পদার্থবিদ্যার নোবেল৷
ছবি: Reuters
১৯০১: যখন হাড় দেখা গেল
পদার্থবিদ্যায় প্রথম নোবেল পেয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী ভিলহেল্ম কনরাড ব়্যোন্টগেন৷ এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কার করে এ পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি৷ হাড় ভেঙেছে? দাঁতে সমস্যা? নাকি শরীরের অন্য কোথাও রোগ বাসা বেঁধেছে? এ সবের উত্তর জানায় এক্স-রে যে এখনো সবাইকে সহায়তা করছে, সে তো ব়্যোন্টগেনের কল্যাণেই৷ জার্মানি তাঁকে এখনো মাথায় তুলেই রেখেছে৷ জার্মানরা এখনো এক্স-রে-কে বলে ‘ব়্যোন্টগেন রেজ’৷
ছবি: Fotolia/Denis
১৯০৩: অণুর ক্ষয় হয়ে যাওয়া
ইউরেনিয়ামের মতো ভারি ধাতুর অনুকণাও যে ক্ষয় হয় এবং তার ফলে শক্তিশালী রশ্মি বেরিয়ে আসে তা সবার আগে দেখেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী অঁতোয়ান অঁরি বেকেরেল৷ এ ধারণা থেকে কাজ শুরু করেই পরে মারি কুরি আর তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি আবিষ্কার করেন রেডিও অ্যাক্টিভিটি৷ তিনজনের সমন্বিত প্রয়াসে এগিয়ে যায়ে বিজ্ঞান৷ তাই ১৯০৩ সালে তিনজনকেই পুরস্কৃত করে নোবেল কমিটি৷
ছবি: PD
১৯২১: আলোর রেখা
আলো ধাতব যে কোনো বস্তুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদানকে স্থানান্তর করতে পারে৷ আলবার্ট আইনস্টাইন এই ফোটো-ইলেক্ট্রিক এফেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন৷ অনেক গবেষণার পর তিনি বলেন, আলো আর বস্তু আসলে এক মুদ্রারই দুই পিঠ, তাই আলো বস্তু হতে পারে আবার বস্তুও আলো হতে পারে৷ অন্যভাবে বলা যায়, ফোটন ধাতব বস্তুর রূপান্তর ঘটাতে পারে৷ আধুনিক বিশ্বের সোলার প্যানেলগুলো এই তত্ত্বের ওপরই চলছে৷
ছবি: Ramona Heim/Fotolia
১৯৫৬: কম্পিউটারের আদিসত্য
স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা আইপড যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রের তিন বিজ্ঞানী উইলিয়াম শকলে, জন বার্দিন এবং ওয়াল্টার ব্র্যাটেইনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷ তাঁরাই প্রথম ট্র্যানজিস্টর বা এমন ইলেক্ট্রনিক সার্কিট আবিষ্কার করেন, যা এক অবস্থা থেকে দ্রুত অন্য অবস্থায় যেতে পারে৷ ছবির এই কম্পিউটার প্রসেসরটির মতো বিজ্ঞানের অনেক উপহারই লক্ষ লক্ষ সার্কিট দিয়ে তৈরি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
১৯৬৭: তারার আগুন
তারা কেন এত তাপ ছড়ায়? ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে জন্ম নেয়া মার্কিন বিজ্ঞানী হান্স বেথ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সূর্যটাকে ভালো করে দেখেছিলেন৷ সূর্য দেখেই জেনেছিলেন যে, তারা হাইড্রোজেনের অণু গলিয়ে আরো বড় এক ধরণের বর্ণহীন অণু তৈরি করে৷ অণুর এই সংমিশ্রণ প্রচুর শক্তি উৎপাদন করে, যা উপগ্রহে ছড়ায়৷ সেই শক্তি পৃথিবীতেও আসে৷ সূর্যালোক তো আমরা সে কারণেই পাই!
ছবি: AP/NASA
১৯৭১: ত্রিমাত্রিক ছবি
হলোগ্রাম বিষয়টি হাঙ্গেরির প্রকৌশলী ডেনিস গেবরের ভাবনাপ্রসূত৷ তিনিই প্রথম ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করেছিলেন৷ ছবিগুলো এমন দেখাচ্ছিল যেন সেগুলো শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে, মনে হচ্ছিল যেন চোখের পলকে ছবি বদলে যাচ্ছে৷ এমন ছবি শুধু দেখতেই ভালো নয়, হালে ‘কালো’ টাকা রুখতেও খুব কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন ছবি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
১৯৮৬: সামান্যে অসামান্য সন্ধান
অণু-পরমাণুর হাঁড়ির খবর নিয়ে মানুষের কত কল্যাণই না করছে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ৷ ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ জার্মান বিজ্ঞানী এর্নস্ট রুসকার আবিষ্কার৷ তাঁর মাইক্রোস্কোপ দিয়ে একটা মাছিকে কেমন দৈত্যের মতো দেখায়, দেখুন৷ সাধারণ মাইক্রোস্কোপের চেয়ে রুসকার মাইক্রোস্কোপের ক্ষমতা সাধে কী এক হাজার গুণ বেশি!
ছবি: picture-alliance/dpa
১৯৮৯: এখন ঠিক ক’টা বাজে?
শুধু ঘণ্টা-মিনিট এবং সেকেন্ডের ভগ্নাংশই নয়, ভগ্নাংশেরও ভগ্নাংশ হিসেব করে সময় বলার ব্যবস্থাটি করেন যুক্তরাষ্ট্রের নরম্যান রামসে৷ প্রকৃত সময় নিরূপণের জন্য তিনি আবিষ্কার করেন অ্যাটোমিক ক্লক, অর্থাৎ আণবিক ঘড়ি৷ বছরে এক সেকেন্ডের ২৫ বিলিয়ন ভাগের মাত্র একভাগ সময়ের বিচ্যুতি হয় এই ঘড়িতে৷ জার্মানিতে এমন ঘড়ি আছে চারটি৷ সেগুলোই এ দেশের সব ঘড়ির সময় ঠিক রাখে৷
ছবি: Fotolia/Paylessimages
২০০৭: ছোট জায়গায় বিশাল হার্ডড্রাইভ
ল্যাপটপের হার্ডড্রাইভ দিন যত যাচ্ছে ততই ছোট থেকে আরো ছোট হচ্ছে৷ এইটুকু একটা জিনিসে কত লক্ষ কোটি তথ্য রাখা থাকে বলুন! এসবই চুম্বকের প্রতিরোধ ক্ষমতার কেরামতি৷ এই বিষয়টি প্রথমে আবিষ্কার করেছিলেন জার্মানির পেটার গ্র্যুনব্যার্গ আর ফ্রান্সের আলবেয়ার ফ্যার্ট৷ এ কারণে দু’জনকেই দেয়া হয়েছিল নোবেল পুরস্কার৷
ছবি: DW/A. Bach
২০০৯: ডায়াল আপ মোডেমের বিদায়
ফাইবার অপ্টিক কেবেলের উদ্ভাবক চীনা বংশোদ্ভূত অ্যামেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী চার্লস কুয়েন কাও৷ ফলে ছুটি হয়ে যায় ডায়াল আপ মোডেমের৷ খুব দ্রুত গতিতে তথ্য সরবরাহ করে কাও-এর ফাইবার অপ্টিক ক্যাবল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০১১: দ্রুত বড় হচ্ছে মহাবিশ্ব
মহাবিশ্ব বড় হচ্ছে৷ এটা জানেন বিজ্ঞানীরা৷ কিন্তু তিন অ্যামেরিকান সল পার্লমুটার, ব্রায়ান স্মিড আর অ্যাডাম রিস বললেন, মহাবিশ্ব ভবিষ্যতে আগের তুলনায় অনেক দ্রুত গতিতে আরো অনেক বেশি বড় হবে৷ কেন এমন হবে? সেটা অবশ্য তাঁরা বলতে পারেননি৷
ছবি: Fotolia/miket
12 ছবি1 | 12
হিগস-বোসন কণা নিয়ে ১৯৬৪ সালে ছয়জন বিজ্ঞানী প্রথম তাঁদের গবেষণাকাজ প্রকাশ করেন৷ ‘লার্জ হেডরন কোলাইডার' বা এলএইচসি-তে হিগস কণার অস্বিত্ব খুঁজতে কাজ করেন হাজারো মানুষ৷ কিন্তু নোবেল পুরস্কারটি তিনজনের বেশি মানুষের মধ্যে দেয়ার নিয়ম না থাকায় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রঁসোয়া অঁগল্যার পেলেন এটি৷
৮০ বছর বয়সি অঁগল্যার এবং তাঁর সহকর্মী রবার্ট ব্রট, যিনি ২০১১ সালে মারা যান, এঁরা দু'জনে এ কণার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার আগেই ৮৪ বছর বয়সি হিগস এই কণিকার অস্তিত্ব খুঁজে পান৷ সে যাই হোক, এবার সম্মানা বাবদ একটি মেডেল, ডিপ্লোমা এবং ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রাউন পাবেন এই দুই পদার্থবিদ৷
অনেকেই মনে করেন, হিগস-বোসন কণার বোসন শব্দটি বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসুর নামে হয়েছে৷ সার্নের গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সুবীর সরকার ডয়চে ভেলেকে জানান, পার্টিক্যাল সায়েন্সে সত্যেন বসুর অবদান অনস্বীকার্য৷ এছাড়া, পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদ্র ‘বোসন' জাতের কণা সত্যেন বসুর সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে৷ কিন্তু এই কণা আবিষ্কারে সত্যেন বসুর কোনো অবদান নেই৷