জন্মগতভাবে, বা শারীরিকভাবে একজন নারী না পুরুষ, সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সেই লিঙ্গ-পরিচয় নয়, একজন মানুষ নিজে যে চেহারায় পরিচিত হতে চাইছেন, সেটাই হবে তাঁর পরিচয়৷ বললো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেশী বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, সম্প্রতি নেপালেও চালু হয়েছে সরকারি কাগজপত্রে, ফরমে, পুরুষ বা নারী ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় ঘোষণা করার সুযোগ৷ ভারতও এবার এই তৃতীয় পরিচয়কে বৈধ ঘোষণা করল৷ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছে, যাঁরা পুরুষ অথবা মহিলা নন, চলতি কথায় যাঁদের হিজড়া বা হিজরা বলা হয়, এবার থেকে তাঁদের সেই পরিচয়টি আইনসিদ্ধ হল৷ সরকারি পাসপোর্ট বা অন্য পরিচয়পত্রে এবার এই নিজস্ব পরিচয়েই তাঁরা পরিচিত হতে পারবেন৷
এই সূত্রে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্ট যে, যাঁরা জন্মসূত্রে অন্যরকম, তাঁরা তো বটেই, এমনকি যাঁরা নিজস্ব সিদ্ধান্তে লিঙ্গান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁদের পরিবর্তিত পরিচয়ও আইনত বৈধ বলে গণ্য করা হবে৷ অর্থাৎ ‘‘আমার জন্মগত লিঙ্গ পরিচয় কী ছিল, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকবে না৷ আমি কী হয়েছি বা হতে চাই, সেটাই বিচার্য'', বললেন শাওন৷ এটা যদিও তাঁর আসল নাম নয়, নেওয়া নাম৷ প্রচলিত অর্থে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াও নন ২৩ বছরের এই যুবক৷ তিনি আদতে একজন রূপান্তরকামী, যিনি শারীরিক লক্ষণে পুরুষ হয়েও মানসিকতায় মেয়েদের মতো৷
ইউরোপে সমকামীদের অধিকার
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের৷ ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ তবে পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ বিস্তারিত দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফ্রান্স
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার দিতে সরকারি পরিকল্পনার সমর্থনে গত রবিবার প্যারিসে হাজির হন লাখো মানুষ৷ কিছুদিন আগে অবশ্য সেখানে সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে লাখো মানুষ সমবেত হয়৷ এই ইস্যু নিয়ে বেশ উত্তপ্ত সেদেশ৷ বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ এবং ডানপন্থি বিরোধী দল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদকে এই আইন করা থেকে বিরত রাখতে চাইছে৷
ছবি: Reuters
নেদারল্যান্ডস
ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি মিশ্র৷ নেদারল্যান্ডস হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম দেশ যেখানে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ ঘোষণা করা হয়৷ ২০০১ সালের এপ্রিল থেকে সেদেশে এই আইন কার্যকর আছে৷
ছবি: AP
বেলজিয়াম
২০০৩ সালের জুন মাসে নেদারল্যান্ডসের প্রতিবেশী দেশ বেলজিয়ামে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহ বৈধ করা হয়৷ প্রথম দিকে সেদেশে বিদেশিদের মধ্যে এ ধরনের বিবাহে খানিকটা জটিলতা ছিল৷ কিন্তু ২০০৪ সালের অক্টোবর থেকে সকল দেশের নাগরিকদের এই সুবিধা দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে যে কোনো একজনকে কমপক্ষে তিন মাস বেলজিয়ামে থাকতে হবে৷ ২০০৬ সাল থেকে সমকামী পুরুষ এবং নারীকে সন্তান দত্তক নেওয়ার সুবিধাও প্রদান করা হয় বেলজিয়ামে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পেন এবং পর্তুগাল
খোসে লুইস রোদ্রিগেজ সাপাতেরো-র সমাজতন্ত্রী সরকারের মেয়াদকালে পৃথিবীর তৃতীয় দেশ হিসেবে স্পেন সমকামীদের মধ্যে বিয়ে বৈধ করে৷ ফ্রান্সের মতো সেদেশেও ক্যাথলিকদের শক্ত অবস্থান রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও ২০০৫ সালের জুলাই মাসে স্পেনে এ ধরনের বিয়ে বৈধ করা হয়৷ ২০১০ সাল থেকে পর্তুগালও একই পথের পথিক হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইওয়াহানা সিগুরডোটির এবং তাঁর সঙ্গিনী ইওহিনা লিওসডোটির সমকামীদের বিয়ে বৈধ ঘোষণার পর প্রথমেই সেই সুযোগ নিয়েছেন৷ সিগুরডোটির হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মেয়ে সমকামী রাষ্ট্রপ্রধান৷ ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি৷ এরপর ২০১০ সালে সেদেশে সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হলে সঙ্গিনী লিওসডোটিরকে বিয়ে করেন সিগুরডোটির৷
ছবি: Getty Images
স্ক্যান্ডিনেভিয়া
সমকামীদের অধিকারের বিষয়ে আইনিভাবেই সচেতন স্ক্যান্ডিনেভিয়া৷ সুইডেনে ২০০৯ সালে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ করা হয়৷ পুরুষ এবং নারী সমকামী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে সেদেশে কোনো বাধা নেই৷ নরওয়ে ২০০৮ সালে এ সংক্রান্ত এক বিল অনুমোদন করেছে৷ ২০১২ সালের গ্রীষ্ম থেকে ডেনমার্কেও সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হয়েছে৷ ফিনল্যান্ডও এ ধরনের বিয়েকে বৈধতা প্রদানের পথে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুক্তরাজ্য
এই ছবিটি গত শতকের ৮০-র দশকের৷ এতে দেখা যাচ্ছে, সমকামীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করছেন একদল মানুষ৷ এরপর অনেকদিন পেরিয়েছে৷ যুক্তরাজ্যে সমলিঙ্গের পুরুষ বা নারী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি রয়েছে৷ ২০০৫ সাল থেকে রয়েছে এই প্রথা৷ তবে চার্চে সমলিঙ্গের নারী বা পুরুষ বিয়ে করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জার্মানি
২০০১ সাল থেকে সমলিঙ্গের যুগলের রেজিস্ট্রেশন বৈধ করেছে জার্মানি৷ এই প্রক্রিয়ায় জার্মানিতে বিয়ের সুযোগ সুবিধার অনেকটাই পান সমকামীরা৷ কিন্তু যৌথভাবে সন্তান দত্তক নেওয়া কিংবা পূর্ণ আয়কর সুবিধা এখনো পায়না সমকামী দম্পতিরা৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জার্মানির ৬৬ শতাংশ জনসাধারণই সমকামীদের বিয়ের পক্ষে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পূর্ব ইউরোপ
তবে ইউরোপের পর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেখানকার সমাজে সমকামী নারী বা পুরুষকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়না৷ লিথুনিয়া, পোল্যান্ডের মতো লাটভিয়াতেও বিষমকামী দম্পতির মতো সমান অধিকার পায় না সমকামী দম্পতি৷ পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ জনগণই সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে৷
ছবি: Reuters
রাশিয়া
রাশিয়ার সংসদ সম্প্রতি শিশুদের মাঝে ‘সমকামীদের প্রচারণা’ নিষিদ্ধ করেছে৷ আর আগেই অবশ্য সেন্ট পিটার্সবুর্গের (ছবিতে) মতো বিভিন্ন শহরে সমকামিতাকে উৎসাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ নতুন এই আইনের ফলে সমকামীদের অধিকার বিষয়ক প্রচারণা রাশিয়ায় অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আয়োজকদের জরিমানা হবে৷ বলাবাহুল্য, রাশিয়াতে সমকামীদের বিয়ে বৈধ নয়৷
ছবি: Dmitry Lovetsky/AP/dapd
10 ছবি1 | 10
সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পরই অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আছেন শাওন৷ বললেন, ‘‘আমার পরিবার বা সমাজ আমাকে কোন পরিচয়ে দেখতে চাইছে, বা কোন লিঙ্গ-পরিচয় আমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকবে না৷ আমি কী হতে চাইছি, কোন পরিচয়ে আমি নিজে পরিচিত হতে চাইছি, সেটাই স্বীকৃতি পাবে৷ আধুনিক সভ্য সমাজে এটাই তো হওয়া উচিত! ''
যদিও পরিবর্তনকামী বা রূপান্তরকামী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন কলকাতায় এবং দেশজুড়ে, তাঁরা সবাই শাওনের মতো খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারছেন না৷ বহু বছর ধরে কলকাতা এবং মুম্বইতে সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন পবন ধল৷ তিনি তো পরিষ্কার বলেই দিলেন, সরকার আগে আদালতের এই নির্দেশ কতটা কার্যকর করে, সেটা দেখা যাক৷ সুপ্রিম কোর্ট যদিও রায় ঘোষণার সময়ই কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে, হিজড়াদের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করতে এবং সংরক্ষিত শ্রেণি হিসেবে তাঁদের যা সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য, সেসব দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে৷ অর্থাৎ চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ থেকে শুরু করে বিশেষ আর্থিক সাহায্য এবং বিবিধ সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আসা৷ কবে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে শুরু করবে, সে নিয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজেরও বেশ সন্দেহ রয়েছে৷
কলকাতার বিভিন্ন ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে আজকাল ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা গাড়ি থেকে হিজরাদের টাকা তুলতে দেখা যায়৷ এটা নতুন হয়েছে, চার-পাঁচ বছর আগেও দেখা যেত না৷ আসলে হিজরা সম্প্রদায়ের রোজগারের একটা বড় রাস্তা ছিল গৃহস্থের বাড়ির শুভ অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে শিশুজন্ম হলে দলবেঁধে গিয়ে নাচগান দেখিয়ে টাকা রোজগার৷ আজকাল বহুতল আবাসনের যুগে সেই সুযোগটা প্রায় নেই হয়ে গিয়েছে৷ চাকরি বা অন্য সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চয়ই ওদের খুশি করবে!
কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়া জানা গেল না৷ দু-এক মাস আগেও যে রাস্তার মোড়ে সকাল থেকে রাত ওঁদের দল বেঁধে টাকা তুলতে দেখা যেত, সকালে অফিস যাওয়ার ব্যস্ত সময়ে গিয়ে তাঁদের একজনকেও চোখে পড়লো না৷ মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানে খবর নিতে লোকটি জবাব না দিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকালো৷ আর তার পাশে তখনও বন্ধ থাকা চিকেন রোলের দোকানের বাচ্চা ছেলেটি বললো, স্থানীয় ভিখারিরা নাকি ওঁদের জবরদস্তি সরিয়ে দিয়েছে৷ ভিখারিদের নাকি রোজগার কমে যাচ্ছিল, তাই!