ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনা মন্ত্রণালয় গতমাসের শেষদিকে ২০ জন অভিনেত্রীর নাম প্রকাশ করে বলেছে, হিজাব পরে বাইরে বের না হওয়ায় তারা কাজ করতে পারবেন না৷
বিজ্ঞাপন
সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনা বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ মেহদি এসমাইলি জানান, বাধ্যতামূলক হিজাব আইন না মানায় তাদের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব ছিল না৷
এই অভিনেত্রীদের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত অভিনেত্রী তারানেহ আলিদুস্তি রয়েছেন৷ ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য সেলসম্যান' মুভিতে আলিদুস্তি অভিনয় করেছিলেন৷ এই চলচ্চিত্রের পরিচালক আসগার ফারহাদি সেরা বিদেশি ভাষার মুভি ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতেছিলেন৷
আলিদুস্তি আগে হেডস্কার্ফ পরতেন৷ বিদেশে গেলেও এর ব্যতিক্রম করতেন না৷ কিন্তু গতবছর নীতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২২ বছর বয়সি জিনা মাশা আমিনির মৃত্যু হলে ইরানে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল৷ সেই সময় বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানাতে আলিদুস্তি ইনস্টাগ্রামে তার একটি ছবি প্রকাশ করেছিলেন, যেটিতে তার মাথায় হিজাব ছিল না৷ আর তার হাতে ধরা কাগজে লেখা ছিল ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা'৷
ছবিটি প্রকাশের পর আলিদুস্তিকে আটক করা হয়েছিল৷ দুই সপ্তাহ পর তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন৷
কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় আলিদুস্তি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘আমি তোমাদের হেডস্কার্ফ পরার বাধ্যবাধকতা মানব না, যেটা থেকে এখনও আমার বোনদের রক্তে ঝরছে৷''
ইরানে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ঠেকাতে বিষ প্রদান!
ইরানের ১৫টি শহরের অন্তত এক হাজার মেয়ে শিক্ষার্থী বিষাক্ত গ্যাস হামলার শিকার হয়েছে৷ ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রীর দাবি- মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ঠেকাতে এমন হামলা চালানো হয়েছে৷
ছবি: Hasan Sarbakhshian/AP/picture alliance
এক হাজার ছাত্রী আক্রান্ত
গত কয়েক মাসে ইরানের ১৫টি শহরের বিভিন্ন স্কুলের প্রায় এক হাজার ছাত্রী বিষাক্ত গ্যাস হামলার শিকার হয়েছেন৷ অভিভাবকদের অভিযোগ, পরিস্থিতি সামলাতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: Social Media/via REUTERS
আক্রান্তদের অভিজ্ঞতা
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা হঠাৎ করেই বিশেষ ধরনের গন্ধ পাচ্ছিল৷ যেমন পচা ডিমের, পচা ফলের বা শক্তিশালী পারফিউমের৷ এরপর তাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল৷ কারো কারো মাথা ঘুরছিল৷ এর ফলে অনেতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন৷
ছবি: Allison Bailey/NurPhoto/picture alliance
যেখান থেকে শুরু
ইরানের কোম শহরে একটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রথম এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন৷ এরপর একে একে ইরানের ১৫টি শহরের বিভিন্ন স্কুল থেকে একই ধরনের অভিযোগ আসে৷
ছবি: Diego Radames/SOPA Images/ZUMA Press Wirepicture alliance
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য
এমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেশটির স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ ভাহিদি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, মানসিক চাপে থাকার কারণে এবং ভয় পেয়েই নাকি মেয়েরা শারীরিকভাবে অসুস্থ অনুভব করছিল৷ যদিও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এমনটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই৷
ছবি: Allison Bailey/NurPhoto/picture alliance
সন্দেহ স্বাস্থ্য উপমন্ত্রীর
ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ইউনেস পাহানি অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন৷ তার বক্তব্য, ‘‘মেয়েদের স্কুল বন্ধ করতেই এমন হামলা চালানো হচ্ছে৷’’ বিষয়টি ইতিমধ্যে দেশের সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে৷ বিস্তারিত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি৷
ছবি: tejaratnews
আতঙ্কে অভিভাবকেরা
ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্কুলের সামনে প্রতিবাদ করছেন অভিভাবকেরা৷ রাজধানী তেহরানের বাসিন্দা এক মা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অনেক অভিভাবাকই মেয়েদের স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷’’
ছবি: Isna
শিক্ষকদের বিক্ষোভ
এদিকে ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে ইরানিয়ান টিচার্স ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে সংগঠনটির সদস্য মোহাম্মদ হাবিবি বলেন, ‘‘এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের জানা থাকা উচিত যে, আমাদের সর্বোচ্চ সীমারেখা হলো শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা৷’’
ছবি: eghtesadnews
7 ছবি1 | 7
এদিকে, অক্টোবর মাসের শুরুতে ১৭ বছর বয়সি আরমিতা জেরাভান্দ নামের এক শিক্ষার্থী হিজাব না পরে স্কুলে যাচ্ছিলেন৷ সেই সময় নীতি পুলিশ তাকে ধরেছিল৷ এক পর্যায়ে জেরাভান্দ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ সেখানে কয়েকদিন কোমায় থাকার পর তাকে ‘ব্রেন ডেড' ঘোষণা করা হয়৷ ২৯ অক্টোবর জেরাভান্দকে সমাহিত করা হয়৷
তেহরানের এক শিক্ষার্থী ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘বাইরে বের হওয়ার সময় হেডস্কার্ফ না পরে আমরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছি৷ অনেক অভিনেত্রীকে এখনও হিজাব পরতে দেখাটা কষ্টকর৷'' এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইরানে সাম্প্রতিক সময়ে আয়োজিত এক শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন৷ ইরানের চলচ্চিত্র পরিচালক দারিউশ মেরজুই ও তার স্ত্রী চিত্রনাট্যকার ভাহিদেহ মোহাম্মাদিফারের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান ছিল সেটি৷ সেখানে চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা অংশ নিয়েছিলেন৷
দারিউশ মেরজুই ও ভাহিদেহ মোহাম্মাদিফারকে ১৮ অক্টোবর নিজ বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল৷ তাদের শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল৷ কর্তৃপক্ষ বলছে, ঐ দম্পতির বাড়িতে কাজ করা সাবেক মালি ডাকাতি করতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে৷ তবে অনেকেই এতে সন্দেহ পোষণ করেছেন৷ কারণ ইরানি অনেক পরিচালকের মতো মেরজুইও প্রায়ই সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন৷ ২০২২ সালের মার্চে তার পরিচালিত শেষ ছবি ‘লা মাইনর' এর উপর সেন্সর আরোপের পর ৮৩ বছর বয়সি মেরজুই সামাজিক মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে একটি কঠোর বার্তা দিয়েছিলেন: ‘‘আমাকে মেরে ফেলুন, যা করতে ইচ্ছা করে করুন... কিন্তু আমি আমার অধিকার চাই৷''
মেরজুই ও মোহাম্মাদিফারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অনেক পরিচিত অভিনেত্রী হেডস্কার্ফ পরে উপস্থিত হয়েছিলেন৷ একমাত্র একজন নারী হিজার পরেননি৷ তিনি হচ্ছেন, ঐ দম্পতির ১৬ বছর বয়সি মেয়ে মোনা মেরজুই৷
২০১৭ সাল থেকে জার্মানিতে বাস করা ইরানি মঞ্চ অভিনেত্রী ও লেখিকা শোলে পাকরাভান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি জানি, তরুণ প্রজন্ম আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ৷ আমাদের প্রজন্ম রক্ষণশীল এবং সতর্ক৷'' জার্মানিতে আসার তিন বছর আগে তার মেয়ে রায়হানেহ জব্বারি তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল৷ পরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ পাকরাভান তার মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি৷ এখন তিনি অন্যদের হয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন৷ ‘‘আমি জানি বর্তমানে ইরানে প্রতিরোধের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়,'' বলেন পাকরাভান৷ ‘‘আপনি যদি দৃষ্টির বাইরে অদৃশ্য হতে না চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেডস্কার্ফ পরতে হবে৷''
ইরানে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা!’ প্রতিবাদের তিন মাস
গত সেপ্টেম্বরে মাহসা আমিনির মৃত্যু ইরানে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদের সূচনা করেছিল৷ সেই প্রতিবাদ দমনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে দেশটির শাসকগোষ্ঠী৷ তবুও থামেনি প্রতিবাদ৷
ছবি: LOUISA GOULIAMAKI/AFP/Getty Images
বিপ্লবের প্রতীক
চুল হিজাবে ঠিকভাবে ঢাকা না হওয়ার অভিযোগে আমিনিকে ১৩ সেপ্টেম্বর আটক করেছিল ইরানের নীতি পুলিশ৷ এর কদিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুর ঘোষণা আসে৷ তার আগে আমিনি হাসপাতালে কোমায় ছিলেন৷ আমিনির এই অস্বাভাবিক মৃত্যু গোটা ইরানে প্রতিবাদের সূচনা করে৷
ছবি: Kenzo Tribouillard/AFP
‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা!’
আমিনির কুর্দি জন্মস্থান সাক্কাজে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবাদের শুরু হয়৷ নারীরা তাদের হিজাব খুলে বাতাসে উড়িয়ে ইরানি ভাষায় ‘‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা!’’ বলে শ্লোগান দিয়েছেন৷ ২৬ অক্টোবর আমিনির কবরস্থানে হাজির হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ৷ ছবিটি সেখানে তোলা৷
ছবি: UGC/AFP
আয়াতুল্লাহদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিদ্রোহ
আমিনির মৃত্যু ঐতিহাসিক এক আন্দোলনের শুরু করেছে৷ উৎপীড়নকারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে গোটা ইরান৷ ছবিটি সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তেহরানে তোলা৷ শুধু নারীরা নয়, সব বয়সের, জাতের মানুষ এই আন্দোলনে শরিক হয়েছেন৷
ছবি: AFP
হিজাব এবং ভয় ছাড়া
গত তিনমাসে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের রাস্তায় হিজাব ছাড়া নারীর সংখ্যা বেড়েছে৷ ইরানের আইন অনুযায়ী, হিজাব ছাড়া বাইরে গেলে বেত্রাঘাত এবং কারাদণ্ড হতে পারে৷ কিন্তু নারীরা তাসত্ত্বেও সাহস দেখাচ্ছেন৷
ছবি: SalamPix/abaca/picture alliance
শাসক গোষ্ঠীর সহিংস প্রতিরোধ
প্রতিবাদকারীদের দমনে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে ইরানের শাসকগোষ্ঠী৷ এজন্য পুলিশ এবং কুখ্যাত এক আধাসামরিক বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসেব অনুযায়ী, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন চারশোর বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে অনেক শিশু এবং তরুণ রয়েছে৷
ছবি: AFP
নির্মম আক্রমণ
প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানান, পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা প্রতিবাদকারীদের নির্মমভাবে পেটানোর পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে৷ তেহরানের পুলিশ ভ্যানে আটক এই নারীর মতো ১৪ হাজার মানুষকে কারাবন্দি করেছে ইরানের শাসকগোষ্ঠী৷
ছবি: SalamPix/ABACA/picture alliance
চুল কেটে প্রতিবাদ
ইরানের শাসকগোষ্ঠীর পতনের দাবিতে প্যারিস থেকে সান ফ্রান্সিসকো অবধি সারা বিশ্বে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ৷ ইস্তাম্বুলে ইরানি কনস্যুলেটের সামনে এক নারী চুল কেটে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷
ছবি: YASIN AKGUL/AFP/Getty Images
প্রতীকী সমর্থন
গত ১৩ ডিসেম্বর বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের উপর আলো ফেলে কুর্দি ভাষায় লেখা হয় ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা!’৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিন ইরানি নারীদের ‘হিরোস অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা দিয়েছে৷
ছবি: Markus Schreiber/AP/picture alliance
দুই বন্দিকে ফাঁসি
ইরানে সরকারবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া দুই প্রতিবাদকারী ব়্যাপার মোহসিন শেখারি এবং মজিদরেজা রাহনাভার্দকে ইতোমধ্যে মৃত্যদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ অন্তত ৩৮ জনকে কথিত ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে শত্রুতার’ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান৷ দেশটিতে শিশুদেরও মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে৷